ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে অবশেষে খেলাপি ঋণ পুনঃতপশিলে আবার বিশেষ সুবিধা দিতে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর মাধ্যমে ডাউন পেমেন্টের শর্ত শিথিল, সুদ মওকুফ ও ঋণের মেয়াদ বাড়ানোর সুযোগ দেওয়া হবে। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিরা এই সুযোগ পাবে না। পুরো প্রক্রিয়াটি স্বচ্ছভাবে করতে বিভিন্ন খাতের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে পাঁচ সদস্যের একটি যাচাই-বাছাই কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটি সাম্প্রতিক আন্দোলন, অগ্নিকাণ্ড, করোনা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ প্রকৃত ক্ষতির মুখে পড়া ২০ কোটি টাকা বা তার বেশি ঋণে বিশেষ পুনঃতপশিলের প্রস্তাব কমিটির কাছে দেওয়া হবে। এ বিষয়ে শিগগির নীতিমালা জারি করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

ব্যাংক খাত-সংশ্লিষ্টরা জানান, বিগত সরকারের সময় ঢালাওভাবে ঋণখেলাপিদের বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়। বিভিন্ন নীতি ছাড়ের মাধ্যমে খেলাপি ঋণ কম দেখানো হচ্ছিল। আবার প্রভাবশালীরা কিস্তি না দিলেও খেলাপি দেখানো হচ্ছিল না। আইএমএফের ঋণ নেওয়ার কারণে গত বছর থেকে কঠিন শর্ত মানতে হচ্ছে। এর মধ্যে গত ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর অনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে নেওয়া অনেক ঋণ এখন খেলাপি হতে শুরু করেছে। আগের মতো বিশেষ সুবিধা বন্ধ হয়েছে। এসব কারণে খেলাপি ঋণ দ্রুত বাড়ছে। গত বছরের ৯ মাসে খেলাপি ঋণ বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। গত সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা। ব্যাংক খাতের মোট ঋণের যা প্রায় ১৭ শতাংশ। খেলাপি ঋণ হু-হু করে বৃদ্ধির মধ্যে ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন সংগঠন ঋণ পুনঃতপশিলে বিশেষ সুবিধার আবেদন জানিয়ে আসছিল। এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক বিশেষ ছাড়ে পুনঃতপশিলের উদ্যোগ নিয়েছে।

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান সমকালকে বলেন, সাম্প্রতিক পরিস্থিতির কারণে প্রকৃত ব্যবসায়ীদের অনেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে শুধু ক্ষতিগ্রস্তদের সুবিধা দেওয়া হলে ভালো হবে। আগের মতো কোনোভাবেই ঢালাও সুবিধা দেওয়া ঠিক হবে না। ব্যাংকই ভালো জানে, কে ক্ষতিগ্রস্ত এবং কে ইচ্ছাকৃত খেলাপি। এ প্রক্রিয়া যেন দ্রুত সম্পন্ন করা যায় সে ব্যবস্থা করতে হবে। আর কোনোভাবেই যেন ইচ্ছাকৃত খেলাপিরা সুবিধা না পায়।

বিশেষ কমিটিতে কারা থাকছেন, কী কাজ
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হকের নেতৃত্বে গঠিত পাঁচ সদস্যের কমিটিতে সাবেক ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক মামুন রশীদ এবং ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের একজন করে প্রতিনিধি থাকবেন। আর সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালন করবেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগের (বিআরপিডি) পরিচালক মোহাম্মদ শাহরিয়ার সিদ্দিকী। 

বিদ্যমান ঋণ পুনঃতপশিল নীতিমালার বাইরে ২০ কোটি টাকা বা তার বেশি ঋণ নিয়মিত করার ক্ষেত্রে কী সুবিধা দেওয়া যায়, তা কমিটি যাচাই করবে। আর এ জন্য প্রথমে ব্যাংক গ্রাহকের কাছ থেকে আবেদন নিয়ে তা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পাঠাবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রাথমিক বাছাই শেষে কমিটিতে পাঠাবে। কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে বিআরপিডির অনাপত্তি নিয়ে বিশেষ সুবিধা কার্যকর হবে।

ইতোমধ্যে যেসব বড় ঋণখেলাপি হয়েছে, পুনঃতপশিলের পরও কেন আদায় হচ্ছে না, তার কারণ পর্যালোচনা করবে কমিটি। এর বাইরে বিগত সরকারের সময় জারি করা সুদ মওকুফ, ঋণ পুনঃতপশিল, পুনর্গঠন, অবলোপন নীতিমালা পর্যালোচনা করে সম্ভাব্য পরিবর্তনের বিষয়ে প্রতিবেদন দেবে। সরকার পরিবর্তনের পর গত ২৭ নভেম্বর জারি করা ঋণ শ্রেণীকরণ ও প্রভিশন নীতিমালা পরিবর্তনের প্রয়োজন হলে সে বিষয়েও সুপারিশ করবে এই কমিটি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, খেলাপি ঋণ পুনঃতপশিলের সাধারণ নীতিমালা রয়েছে। সাম্প্রতিক আন্দোলন, করোনা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ বিভিন্ন কারণে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের ঋণ পুনঃতপশিলে বিশেষ ছাড়ের প্রয়োজন হলে যাচাই-বাছাই করার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। পাশাপাশি সুদ মওকুফ, ঋণ পুনঃতপশিল, শ্রেণীকরণসহ বিভিন্ন নীতি পর্যালোচনা করবে এই কমিটি। তিনি আরও বলেন, খেলাপি ঋণ দ্রুত বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্যের খরচ বাড়ছে। আগামীতে খেলাপি আরও বাড়লে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে এবং বিদেশি বিনিয়োগে প্রভাব পড়তে পারে। এ অবস্থায় প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য বিশেষ সুবিধায় ঋণ পুনঃতপশিলের নীতিমালা করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম মেনে নির্ধারিত ডাউনপেমন্ট দিয়ে ব্যাংক যে কোনো সর্বোচ্চ চারবার ঋণ পুনঃতপশিল করতে পারে। আব্দুর রউফ তালুকদার গভর্নরের দায়িত্ব নিয়ে ২০২২ সালে ঋণ পুনঃতপশিলের নীতিমালায় ব্যাপক শিথিলতা আনেন। আগে যেখানে ঋণ পুনঃতপশিলে ১০ থেকে ৩০ শতাংশ ডাউনপেমন্ট দিতে হতো, তা কমিয়ে আড়াই থেকে সাড়ে ৪ শতাংশ করা হয়। পটপরিবর্তনের পর এখন আবার বিশেষ বিবেচনায় পুনঃতপশিলের উদ্যোগ নেওয়া হলো। এর মাধ্যমে ২০২২ সালে জারি করা নীতিমালার চেয়েও বাড়তি সুবিধা পাবেন ব্যবসায়ীরা।

নীতিমালার ছন্দপতন যেভাবে
বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ শ্রেণীকরণ ও প্রভিশনিংয়ের নীতিমালা ছিল আন্তর্জাতিক মানের। ২০১৪ সালের নির্বাচনের ঠিক আগে রাজনৈতিক বিবেচনায় ২০১৩ সালে নিয়ম শিথিল করা হয়। নামমাত্র ডাউনপেমেন্ট দিয়ে বিশেষ বিবেচনায় ঋণ পুনঃতপশিলের সুযোগ চালু করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর পর ২০১৫ এবং ২০১৮ সালে আবার ২ শতাংশ ডাউনপেমন্ট দিয়ে ঋণ নিয়মিত এবং পুনর্গঠনসহ বিভিন্ন সুবিধা দেওয়া হয়। করোনা শুরুর পর ২০২০ সালে ১ টাকা না দিলেও ঋণ নিয়মিত দেখানোর সুযোগ দেওয়া হয়। এর পর ২০২১ সালে কিস্তির ১৫ শতাংশ এবং ২০২২ ও ২০২৩ সালে অর্ধেক দিলেই নিয়মিত দেখানো যেত। অবশ্য এত সুযোগেও খেলাপি ঋণ আটকানো যায়নি। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা নেওয়ার সময় ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার কোটি টাকা। গত ১৬ বছরে তা ১৩ গুণ বেড়ে এখন তিন লাখ কোটি টাকা ছুঁইছুঁই। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আগে সুবিধা নেওয়া ঋণই বারবার সুবিধার জন্য এসেছে।

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ঋণখ ল প ব যবস য় দ র সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

সামারিক শক্তিতে মিয়ানমারের চেয়ে ২ ধাপ এগিয়ে বাংলাদেশ

চলতি বছর সামরিক শক্তির দিক থেকে মিয়ানমারের চেয়ে দুই ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ। চলতি সপ্তাহে সামরিক শক্তি পর্যবেক্ষক প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার প্রকাশিত সূচকে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

সংস্থাটি তাদের প্রতিবেদনে জানিয়েছে, এই র‌্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের সামরিক বাজেট। সেনাবাহিনীর আকার, নৌবাহিনী এবং বিমানবাহিনীর শক্তিকেও বিবেচনা করা হয়েছে সমীক্ষায়।

গ্লোবাল ফায়ারপাওয়ারের সূচক অনুযায়ী, বিশ্বে সামরিক শক্তির ক্ষেত্রে শীর্ষে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, এরপরে পরে রয়েছে রাশিয়া, চীন, ভারত ও দক্ষিণ কোরিয়া। পরমাণু শক্তিধর হলেও পাকিস্তানের অবস্থান ১২ নম্বরে। তালিকায় বাংলাদেশ রয়েছে ৩৫তম অবস্থানে। বাংলাদেশের আগে রয়েছে উত্তর কোরিয়া ও আর্জেন্টিনা। আর বাংলাদেশের প্রতিবেশী মিয়ানমার রয়েছে ৩৭তম অবস্থানে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটির বেশি। এর মধ্যে প্রায় ৬ কোটি ৬১ লাখ মানুষ সামরিক বাহিনীতে যুক্ত হওয়ার যোগ্য। বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীতে মোট সেনা সংখ্যা ১ লাখ ৬৩ হাজার। বাংলাদেশ বিমানবাহিনীতে রয়েছে ১৭ হাজার ৪০০ সদস্য এবং নৌবাহিনীতে রয়েছে ২৫ হাজার ১০০ সেনা। 

অন্যদিকে, মিয়ানমারের মোট জনসংখ্যা ৫ কোটি ৭৫ লাখ। এর মধ্যে প্রায় ২ কোটি ২০ লাখ মানুষ সামরিক বাহিনীতে যুক্ত হওয়ার যোগ্য। মিয়ানমারের সক্রিয় সৈন্য সংখ্যা ১ লাখ ৫০ হাজার। মিয়ানমারের রিজার্ভ সৈন্য রয়েছে ২০ হাজার। দেশটির বিমানবাহিনীতে রয়েছে ১৫ হাজার সদস্য এবং নৌবাহিনীতে রয়েছে ১৬ হাজার সেনা। 

ঢাকা/শাহেদ

সম্পর্কিত নিবন্ধ