পাহাড়ে অপহরণ আতঙ্কে খামারি ও বাগান মালিক
Published: 14th, January 2025 GMT
অপহরণ আতঙ্ক পেয়ে বসেছে খামারি ও বাগান মালিকদের। কাজে গেলেই হানা দেয় অস্ত্রধারীরা। ধরে নিয়ে যায় বাগান মালিক-শ্রমিকদের। এমন অবস্থা চট্টগ্রামের পটিয়া ও চন্দনাইশের পাহাড়ি এলাকায়। গত আট মাসে তারা প্রায় ৫০ জনকে অপহরণ করার পর মুক্তিপণ নিয়ে ছেড়ে দেয়।
ভুক্তভোগী কয়েকজন জানান, সন্ধ্যা হলেই ভারী অস্ত্র নিয়ে লোকালয়ে আসে অপহরণকারীরা। ক্ষেতখামার, বাগান মালিক ও শ্রমিকদের ধরে নিয়ে যায়। পরে মুক্তিপণ নিয়ে ছেড়ে দেয়। তাই পাহাড়ি এলাকায় কাজে যেতে ভয় পান খামারি ও শ্রমিকরা।
গত সোমবার পটিয়া উপজেলার হাইদগাঁও-পাহাড়ের পূর্ব পাশে শসা ক্ষেতে কাজ করার সময় সাদা পোশাকে অস্ত্রধারী লোকজন খামারি ও শ্রমিকদের ঘিরে ফেলে। কৌশলে কয়েকজন পালিয়ে যেতে পারলেও হাইদগাঁও ২ নম্বর ওয়ার্ডের হামিদ শেখ ও ৬ নম্বর ওয়ার্ডের মুজিবকে ধরে ফেলে। তাদের ধরে সন্ত্রাসীদের আস্তানায় নিয়ে গেলে কৌশলে পালিয়ে আসেন মুজিব। তবে ৩০ হাজার টাকা মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পান হামিদ।
কেলিশহর খীল্লাপাড়া-দারোগাহাট এলাকার মনছুর আলম ও মো.
নিয়ে যায় অপহরণকারীরা। তাদের রাঙামাটির রাজস্থলী নিয়ে যাওয়ার পর মনছুরের থেকে ৮০ হাজার এবং নাছির থেকে ৪০ হাজার টাকা মুক্তিপণ নিয়ে ছেড়ে দেয়।
৩ জানুয়ারি লেবু বাগানে কাজ করতে যান বোয়ালখালী কড়লডেঙ্গা এলাকার বাগান মালিক রুবেল ও তাঁর ৪ জন শ্রমিক। বিকেল ৫টার দিকে তাদের অপহরণ করে নিয়ে যায় অস্ত্রধারীরা। পাঁচজনের থেকে ৬০ হাজার টাকা মুক্তিপণ নিয়ে রাতে ছেড়ে দেয়।
১১ জানুয়ারি বিকাল ৫টার দিকে চন্দনাইশের হাশিমপুর ও কাঞ্চননগর এলাকার পেয়ারা বাগান থেকে ফেরার পথে আহমদ হোসেন, মোহাম্মদ রহিম, রবিউল আলম, মোহাম্মদ কামাল, জুনাইদকে অপহরণ করা হয়। ওই রাতেই ১ লাখ ১০ হাজার টাকা মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পান তারা।
গত বছরের জুনে পটিয়া-চন্দনাইশের সীমান্ত এলাকা থেকে পাঁচজন, ২০ মে কাঞ্চননগর থেকে ৯ জনকে অপহরণ করা হয়। তিন থেকে চার দিন পরে মুক্তিপণ নিয়ে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়।
গত বছর চট্টগ্রাম নগরীর সাবেক মেয়র মঞ্জুরুল আলমের কেয়ারটেকার নূরুল আলমের বাবা আবদুছ ছাত্তারকে অপহরণ করা হয়। চার দিন পর ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা নিয়ে ছেড়ে দেয় তাঁকে।
বর্তমানে রাঙ্গুনিয়া সরফভাটা পেকুয়াপাড়া, চেমিপাকা, মীরের খীল এলাকার কিছু সন্ত্রাসী অপহরণ কর্মকাণ্ডে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এর মধ্যে রয়েছে কল্লাকাটা কামালের নেতৃত্বে একটি চক্র। রাঙামাটির চাকমাদের একটি পক্ষ, বান্দরবানের মারমা গ্রুপ, ত্রিপুরার একটি চক্রও সক্রিয়। অপহরণকারীরা ভারী অস্ত্র নিয়ে পাহাড়ি লোকজনকে অপহরণ করে অজ্ঞাত স্থানে আটকে রাখে। বাড়িতে খবর দিয়ে দালালের মাধ্যমে টাকা আদায় করে তাদের ছেড়ে দেয়।
মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পাওয়া হামিদ শেখের সঙ্গে যোগাযোগ করলে মুখ খুলতে রাজি হননি। তবে বাগান মালিক হামিদের বড় ছেলে মোহাম্মদ কায়সার সমকালকে বলেন, শ্রীমাই পাহাড়ে তাদের একটি বাগান রয়েছে। বাগানে ৪০ বছর ধরে লেবু, নানা জাতের সবজি, শসার চাষ করেন তারা। রয়েছে মাছের খামারও। গত সোমবার সকাল তাঁর বাবা আবদুল হামিদ, ছোট ভাই মো. দিদার ও আরও দুই শ্রমিক বাগান থেকে শসা ও লেবু তুলতে যান। তাঁর বাবা ও ছোট ভাইয়ের তথ্যমতে, ১১ থেকে ১২ জন পাহাড়ি সন্ত্রাসী তাদের অপহরণ করে। এ সময় দুই শ্রমিক ও ছোট ভাইকে ছেড়ে দিয়ে তাঁর বাবাকে আটকে রাখে সন্ত্রাসীরা। ৪ লাখ টাকা মুক্তিপণ নিয়ে তাঁর বাবাকে ছাড়িয়ে নিতে বলেন। পরে মুঠোফোনে বেলা ১টার দিকে ৩০ হাজার টাকা পাঠানোর পর সন্ধ্যার আগে তাঁকে ছেড়ে দেয়।
অপহরণের বিষয়টি ভাবিয়ে তুলেছে স্থানীয় প্রশাসন-রাজনীতিবিদদেরও। অপহরণ থামাতে কঠোর আইনি পদক্ষেপের দাবি তুলেছেন স্থানীয় রাজনীতিবিদরা।
পটিয়ার বনকর্মী মুহাম্মদ মহিউদ্দিন বলেন, ‘১৫ বছর ধরে পাহাড়ে বন বিভাগের কাজ করছি। আগের তুলনায় পাহাড়ে অপহরণের ঘটনা বেড়েছে। কাজ করতে গেলে সব সময় আতঙ্কে থাকি।’
হাইদগাঁও ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য আবদুল গণি জানান, অপহরণ আতঙ্কে রয়েছেন পাহাড়ি এলাকার বাগান মালিকরা।
বিষয়টি নিয়ে কথা হয় পটিয়া বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক খোরশেদ আলমের সঙ্গে। তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাসিক সভায় আমরা বলেছি শক্ত হাতে অপহরণকারীদের দমন করতে হবে। অপহরণ বাণিজ্য বন্ধ করতে হলে পাহাড়ি এলাকায় যৌথ বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযান দরকার।
ইউএনও ফারহানুর রহমানের ভাষ্য, অপহরণসহ যে কোনো ধরনের অপরাধ দমনে কাজ করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। অপহরণের ঘটনাগুলো কোন কোন স্থানে, সেটি নির্ধারণ করে নজরদারি বাড়ানো হচ্ছে। সবাই একসঙ্গে কাজ করলে বিষয়টি নিয়ন্ত্রণে আনা সহজ হবে।
পটিয়া সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আরিফুল ইসলাম বলেন, পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের
ভারী অস্ত্র রয়েছে। তাদের সঙ্গে পুলিশের একা লড়া সম্ভব না। যৌথ বাহিনীর মাধ্যমে এদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে হবে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: অপহরণক র ক জ কর এল ক য় এল ক র আতঙ ক
এছাড়াও পড়ুন:
বৈঠকে অভিযোগ শুনেই ওসিকে প্রত্যাহারের নির্দেশ দিলেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
কক্সবাজারের চকরিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মনজুরুল কাদের ভূঁইয়াকে এক দিনের মধ্যেই প্রত্যাহার করার নির্দেশ দিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। আজ শনিবার সকালে এক মতবিনিময় সভায় ওসির বিরুদ্ধে অভিযোগ শোনার পর পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজিকে ফোন দিয়ে তিনি এ নির্দেশ দেন।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের সম্মেলনকক্ষে স্বরাষ্ট্র ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সরকারি দপ্তরের কর্মকর্তাদের নিয়ে এই মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়। সভায় চকরিয়া থানার ওসি মিথ্যা মামলা দিয়ে লোকজনকে হয়রানি করছেন জানিয়ে এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এক সাংবাদিক। এরপর স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা চকরিয়া থানার ওসিকে প্রত্যাহারের নির্দেশ দিয়েছেন।
সভায় মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে অনুপ্রবেশ ও মাদক চোরাচালান ঘটতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা। তিনি বলেন, যেকোনো মূল্যে মাদকের চোরাচালান ও অনুপ্রবেশ ঠেকাতে হবে। গুজব-ছিনতাই, অপহরণ নিয়ন্ত্রণে রেখে জনশৃঙ্খলা বজায় রাখতে হবে। দুর্নীতি ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির ক্ষেত্রে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহউদ্দিনের সভাপতিত্বে এক ঘণ্টার ওই সভায় শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি); সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, এপিবিএন, আনসার, কারা অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর, পাসপোর্ট অধিদপ্তর, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর এবং কৃষি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের বর্তমান পরিস্থিতি, দেশটির সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মি (এএ) এবং সীমান্তনিরাপত্তা নিয়ে আলোচনা হয়। উপস্থিত কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘রাখাইন রাজ্যের বিপুল এলাকা এখন আরাকান আর্মির দখলে থাকলেও কাগজে–কলমে সেটি মিয়ানমারের। তারপরও আমরা নানাভাবে আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করছি।’
বৈঠক শেষে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা সাংবাদিকদের বলেন, ‘কক্সবাজারে অপহরণের ঘটনা বেশি, এর কারণ রোহিঙ্গা। ১২ লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে এখানে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। তারা বিভিন্ন অপকর্মের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। রোহিঙ্গাদের যত তাড়াতাড়ি মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে যাবে, ততই আমাদের জন্য মঙ্গল।’
বৈঠক শেষে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, বৈঠকে স্বরাষ্ট্র ও কৃষি উপদেষ্টা কক্সবাজারের মাদক চোরাচালান, গুজব, ছিনতাই, অপহরণ, সীমান্তনিরাপত্তা, হাইওয়ের নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছেন। পর্যটক ও স্থানীয় ব্যবসায়ীদের জন্য অনুকূল পরিবেশ যেন বজায় থাকে, সে বিষয়েও নির্দেশনা দিয়েছেন। পাশাপাশি দুর্নীতি ও আইনশৃঙ্খলার বিষয়ে কঠোর হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসনকে সার্বিক বিষয়ে নজরদারি রাখতে নির্দেশনা দেওয়া হয়।
উখিয়াতে বিজিবির নতুন ব্যাটালিয়নের যাত্রা শুরুদুই দিনের সরকারি সফরে গতকাল শুক্রবার দুপুরে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা কক্সবাজার আসেন। আজ শনিবার সকাল ১০টায় জেলা প্রশাসনের সম্মেলনকক্ষে সরকারি দপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় শেষে দুপুরে কক্সবাজার ৩৪ ব্যাটালিয়নের প্রশিক্ষণ মাঠে উখিয়াতে নবগঠিত ব্যাটালিয়ন (৬৪ বিজিবি) স্টেশনের সদর দপ্তর, গার্ড পুলিশ ব্যাটালিয়ন এবং কে-নাইন ইউনিট অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টারের আনুষ্ঠানিক পতাকা উত্তোলন করেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নিহত শহীদদের স্মরণ ও আন্দোলনে আহত ব্যক্তিদের সুস্থতা কামনা করে ব্যাটালিয়নের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, দেশের সীমান্ত রক্ষার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব বিজিবির ওপর ন্যস্ত। সীমান্তের নিরাপত্তা রক্ষা, চোরাচালান, নারী ও শিশু এবং মাদক পাচারসংক্রান্ত অপরাধ দমন, আন্তরাষ্ট্রীয় সীমান্ত অপরাধ প্রতিরোধ, অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলা রক্ষার্থে প্রশাসনকে সহায়তা দিচ্ছে বিজিবি। নবগঠিত উখিয়া ৬৪ ব্যাটালিয়নও বাহিনীর সুনাম ও মর্যাদা বৃদ্ধিতে অবদান রাখবে।