গত বিজয় দিবসে জাতির উদ্দেশে ভাষণে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস চলতি বছরের শেষ বা আগামী বছরের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করা হবে বলে ধারণা দিয়েছিলেন। কিছু রাজনৈতিক দল, বিশেষত বিএনপি বারবার জাতীয় নির্বাচনের সময়সূচি জানতে চাওয়ার মধ্যেই তিনি ওই সময়ের কথা বলেন। কিন্তু এক মাস পর এসে বিএনপি আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ায় জানাল, এক থেকে দেড় বছর সময় মানে অনেক বিলম্ব। তারা চলতি বছর জুলাইয়ের মধ্যে নির্বাচন চায়।
কেন দ্রুত নির্বাচন দরকার? বিএনপি বলছে– ‘যত বিলম্ব হচ্ছে, ততই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট বৃদ্ধি পাচ্ছে। কারণ গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচিত সরকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়’ (সমকাল, ১৪ জানুয়ারি ২০২৫)। তারা প্রকারান্তরে যা বলতে চাইছে, নির্বাচন হলে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট কেটে যাবে এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পাবে।
বিএনপির বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, এখনকার রাজনৈতিক সংকট কী? সে বিষয়ে তারা কোনো ব্যাখ্যা অবশ্য দেয়নি। এখন রাজপথে রাজনৈতিক আন্দোলন, হরতাল-ধর্মঘট ইত্যাদি নেই; সংঘাত-সহিংসতা সেভাবে ঘটছে না; দলীয় রেষারেষিও তেমন দেখা যাচ্ছে না। তাহলে ‘রাজনৈতিক সংকট’ কোথায়? দলীয় নেতাকর্মী সরকারি পদ-পদবিতে নেই, সেটিই কি সংকট?
আমরা দেখতে পাচ্ছি, শুধু এমপি-মন্ত্রীর পদগুলোতে কোনো দলীয় লোক নেই। বাকি প্রায় সব জায়গায় দলীয় লোকের দাপট। পুলিশ-প্রশাসনেও রাজনৈতিক ধ্বজাধারীদের ক্ষমতায়ন। সারাদেশের মাঠঘাট, বাজার, স্ট্যান্ড-স্টেশনসহ ‘উপার্জন’-এর সম্ভাব্য সব ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক লোকজন ক্ষমতায়িত।
ইউনিয়ন পরিষদে চেয়ারম্যান-মেম্বার রয়েছেন; উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা, সিটি করপোরেশনে জনপ্রতিনিধিরা নেই। ফলে সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলোতে জনদুর্ভোগ বেড়েছে, সত্য। তবে সেগুলোতেও প্রশাসক থাকায় মোটাদাগে দেশে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা চালুই আছে। খালি জায়গাগুলো পূরণের জন্য বিভিন্ন মহল থেকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে করার দাবি আছে। কিন্তু বিএনপির আবার সে ক্ষেত্রে উল্টো মত। তারা আগে স্থানীয় নির্বাচন চায় না।
তাহলে বিএনপি কি প্রকারান্তরে এটিই বলছে না, সংসদ সদস্য নির্বাচিত হতে পারলেই রাজনৈতিক সংকট কেটে যাবে? রাজনীতি যদি জনগণের জন্য, জনগণের সঙ্গে কাজ করা হয়, তাহলে স্থানীয় সরকার কি রাজনীতির বড় অংশ নয়? শুধু এমপিদের অভাবই রাজনৈতিক সংকট?
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘স্থানীয় সরকার দেশ চালায় না। দেশ চালায় জাতীয় সংসদ।’ সংবিধান বা আইনানুগভাবে যদি দেখি, আসলেই কি এমপিরা দেশ চালান? তারা আইনপ্রণেতা মাত্র; দেশের জন্য ভালো-মন্দ আইন তৈরি করেন। কিন্তু আমাদের পুরোনো ধারার রাজনৈতিক দলগুলো তার বদলে এমপিদের বানিয়েছে নির্বাচনী এলাকার ‘রাজা’। বিএনপির ভাষ্যে সেই হারানো সুরই পাওয়া যাচ্ছে।
দেশ চালায় সরকার; আইনসভা পথনির্দেশনা তৈরি করে। দৈনন্দিন কাজকর্মে এমপি নয়; জনগণের প্রয়োজন স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি। ফলে জনগণের দিক থেকে দেখলে স্থানীয় সরকারকে ছোট করে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
আরেকটি বিষয় খেয়াল করা দরকার। নেতারা প্রায়ই বলেন, ‘গণতন্ত্রের মূল বিষয় হলো জাতীয় সংসদ।’ জাতীয় সংসদ অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু গণতন্ত্রের এটাই কি মূল? গণতন্ত্রের মূল বিষয় কি জনগণের ক্ষমতায়ন নয়? হ্যাঁ, এমপিরা জনগণের প্রতিনিধিত্ব করেন আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে। কিন্তু তার আগে জনগণের সঙ্গে যোগাযোগ, আলোচনা, মতবিনিময় কি তারা করেন? জনগণের ইচ্ছা ও আকাঙ্ক্ষার কথা তারা কীভাবে জানেন? এক দিনের ভোটেই কি জনগণ সত্তা বিসর্জন দিয়ে দেয়? গণতন্ত্র কার্যকর করতে হলে এসব বিষয়েই বেশি নজর দেওয়া প্রয়োজন।
যেসব রাজনৈতিক দল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলছে, তারা জনগণের ক্ষমতায়ন নিয়ে কি মতবিনিময় করছে জনগণের সঙ্গে? সে রকম কোনো কর্মসূচি আজও দেখা যায়নি। রাষ্ট্রের সর্বত্র জনগণের মর্যাদা ও ক্ষমতা বৃদ্ধির তৎপরতা চোখে পড়েনি। শুধু ভোটকেই মূল বিষয়ে পরিণত করা পুরোনো ব্যবস্থার ভেতরে থাকার কূট কৌশল।
ধরে নিলাম, ভোট হলে বিএনপি সরকার গঠন করবে। কিন্তু তারা নির্বাচনের পর সংস্কারের যে কথা বলছে, সেসব বাস্তবায়নের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা কি পাবে? কিংবা সংবিধান সংশোধন বা পরিবর্তনের ম্যান্ডেট নিয়ে কি তারা ক্ষমতায় যাবে? যদি বিএনপিকে ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংস্কার করতে হয়, তাহলে তার উদ্যোগ এখনই শুরু করতে দোষ কোথায়? প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোকেও গণতান্ত্রিক বা গণতন্ত্রমনা করে তুলতে হবে। সে রকম কর্মসূচি নিতে হবে। শুধু সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে তা হবে না।
গত বছর ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত ‘ডামি ভোটের’ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি; ঠেকাতেও পারেনি। দলটি বলতে গেলে চুপসে যায় এবং ৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর এক অর্থে প্রাণ ফিরে পায়। রাষ্ট্র কাঠামোর ভেতরে নানা ক্ষেত্রে সুবিধাভোগীও হয়ে ওঠে। এখন জুলাইয়ের মধ্যে ভোট চাচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশের ইতিহাসে কখনোই জুলাই-আগস্টে নির্বাচন হয়নি; কারণ তখন ভরা বর্ষাকাল। আমাদের নির্বাচনের মৌসুম সাধারণত অক্টোবরের শেষ থেকে মার্চের প্রথম দিক। জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত বর্ষা মৌসুমে জনদুর্ভোগ ও প্রাকৃতিক পরিবেশ বিবেচনায় নির্বাচনের আয়োজন হয় না।
ফলে বিএনপি যে ভরা বর্ষাকালে নির্বাচনের কথা বলছে, সেটিও সুবিবেচনার পরিচায়ক নয়। এর পরও সেই সময়ই নির্বাচন আয়োজনের দাবির অর্থ হতে পারে– তারা নিজেরা কোনো চাপ অনুভব করছে। হতে পারে, বিলম্ব হওয়া মানে তাদের নির্বাচনী ভাবমূর্তি ক্ষয়ে যাওয়ার ভয়। কারণ নেতাকর্মীর ‘কীর্তি’ সামলানো যাচ্ছে না। আরেকটি কারণ হতে পারে, সরকারকেই চাপে রাখা, যাতে নির্বাচন জুলাইয়ে না হলেও ডিসেম্বরে হয় কিংবা নিদেনপক্ষে সরকার তার ঘোষিত সময়সীমার বাইরে না যায়।
অর্থনৈতিক সংকট প্রসঙ্গে না বললেই নয়। বিগত সরকারের ব্যাপক দুর্নীতি, পাচার, স্বেচ্ছাচার অর্থনীতিকে যে তলানিতে নামিয়েছে, সেখান থেকে দ্রুত টেনে তোলার জাদুর কাঠি কি বিএনপির কাছে আছে? যদি থাকে, জনগণের স্বার্থে কেন তা ব্যবহার করছে না বা সহায়তা নিয়ে এগিয়ে আসছে না? তারা যেহেতু জনগণের জন্যই রাজনীতি করে, সেহেতু জনগণের মঙ্গলার্থে করণীয়গুলো নিয়ে এগিয়ে আসাও তাদের কর্তব্য। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান তাদের রাজনীতিতে প্রাণ ফিরিয়ে দিয়েছে; প্রতিদানে হলেও তাদের কিছু করণীয় নিশ্চয় থাকা উচিত।
রফিকুল রঞ্জু: অতিরিক্ত বার্তা সম্পাদক, সমকাল
.উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
রাজনীতিবিদ, প্রশাসন ও জনগণের ‘ম্যাট্রিক্স’
ব্যক্তির ইচ্ছা ও চাহিদার বেশির ভাগই রাষ্ট্র ও বৃহত্তর সমাজের নিয়মবহির্ভূত। এ কারণে নাগরিকের ভেতর রাষ্ট্র ও সভ্যতার প্রতি সব সময় অসন্তোষ থাকে। যুক্তিটি দিয়েছিলেন সিগমন্ড ফ্রয়েড তাঁর ‘সিভিলাইজেশন অ্যান্ড ইটস ডিসকনটেন্ট’ গ্রন্থে। মানুষের রাজনৈতিক আচরণ কী দিয়ে নিয়ন্ত্রিত, তা নিয়ে আরও মতবাদ ও তত্ত্ব রয়েছে।
কোনো রাজনৈতিক ব্যবস্থায় শাসক কী কারণে শোষকে পরিণত হয় বা জনগণ কেন তাকে শোষক মনে করে; ভোট ব্যবস্থায় নাগরিক মনস্তত্ত্ব কীভাবে প্রার্থীরা নিজ স্বার্থে কাজে লাগায়; কেন জনতা দাবি আদায়ে সহিংস হয়ে যেতে পারে– এসব বিষয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, রাজনীতিবিদ, আমলা ও নাগরিক প্রতিনিধিদের ধারণা থাকা অপরিহার্য। ক্ষমতা নিয়ে কাজ করতে হলে ক্ষমতা কাঠামো ও ক্ষমতার বিপজ্জনক দিকগুলো নিয়ে জানা থাকতে হবে– অনেকটা ওষুধের প্যাকেটের ব্যবহারবিধির মতো। ক্ষমতাচর্চা করলে ক্ষমতার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কেও জানতে হবে বৈ কি!
রাজনীতিতে শক্তি প্রয়োগ, বিরোধী মতবাদ নিশ্চিহ্ন করার প্রবণতা এ অঞ্চলের প্রবহমান রাজনৈতিক সংস্কৃতি; আর রাজনৈতিক হত্যা, নির্যাতন, অসহিষ্ণুতা আমাদের লালিত রাজনৈতিক মনস্তত্ত্ব। যে কারণে রাজনৈতিক সংকট মোকাবিলায় মানুষের রাজনৈতিক আচরণ ও মনস্তত্ত্ব বুঝে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হয়।
অনেকের ধারণা, জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম কারণ বিগত সরকারের নাগরিক মনস্তত্ত্ব বোঝার ব্যর্থতা; রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অকার্যকারিতা; সর্বোপরি জনগণের সিদ্ধান্ত গ্রহণের সবচেয়ে প্রভাবশালী পদ্ধতি ভোটাধিকার প্রক্রিয়া অংশগ্রহণমূলক না হওয়া। প্রশ্ন হচ্ছে, গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে মানুষের রাজনৈতিক আচরণ কীভাবে শান্তি প্রতিষ্ঠার দিকে ধাবিত করা যায়?
দৈবচয়নের ভিত্তিতে অনেককেই প্রশ্ন করেছিলাম, ‘রাজনীতিবিদ’ শব্দটি শুনলে মাথার মধ্যে কী ধারণা আসে? বেশির ভাগই বলেছেন, ক্ষমতাবান, উগ্র এবং জনসাধারণের অধিকার লুণ্ঠনকারীর ছবি মাথায় আসে। ‘আমলা’ শুনলে বেশির ভাগের অহংকারী, গোমড়ামুখো চেহারা মনে হয়। অপরদিকে কয়েকজন রাজনীতিবিদ ও আমলার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, তারা ‘জনগণ’ সম্পর্কে কী ধারণা পোষণ করেন? বেশির ভাগই উত্তরে বলেন, রাষ্ট্র কীভাবে চলে– সাধারণ মানুষ বোঝে না।
তার মানে, রাজনীতিবিদ, আমলা ও জনগণের সম্মানজনক সম্পর্ক রাষ্ট্র ও সমাজ পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় হলেও বাংলাদেশে সেটি অনুপস্থিত। কারণ সম্ভবত রাজনীতিবিদের ক্ষমতার অপব্যবহার, আমলার ক্ষমতা প্রদর্শন, জনসাধারণের আইন অমান্য করার প্রবণতা। বিস্ময়করভাবে আমাদের দেশে রাজনৈতিক ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখলবাজি, সন্ত্রাস সাধারণত ‘অপরাধ’ হিসেবে বিবেচিত হয় না; বরং এক ধরনের ‘রাজনৈতিক আচরণ’ হিসেবে বিবেচিত। দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা কাঠামোতে তাদের এমন অবস্থান সবাই যেন মেনে নিয়েছে। রাজনৈতিক ব্যবস্থায় দমন-পীড়নের জন্য তারাই ‘ফুট সোলজার’।
প্রশ্ন জাগে, স্বাধীনতার এত বছর পরও আমরা কেন সহাবস্থানের রাজনৈতিক সংস্কৃতি তৈরিতে ব্যর্থ? কেন এক দলের কর্মী অন্য দলের কর্মীকে রাস্তায় ফেলে বেদম লাঠিপেটা, এমনকি খুন করে ফেলে?
সহনশীল রাজনৈতিক ব্যবস্থা সৃষ্টিতে যেসব উপাদান প্রয়োজন, সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সবার জন্য সুশিক্ষা ও উন্নত মনোজগৎ। সহনশীলতার সংস্কৃতি সবার চিন্তা ও কাজে তখনই প্রতিফলিত হবে যখন শিক্ষার ভিত্তি হবে সহমর্মিতা, মর্যাদা ও সমাজের কল্যাণ। সুস্থভাবে জীবন যাপন করার জন্য মনস্তত্ত্বে দুটি আস্থার খুব প্রয়োজন। একটি আধ্যাত্মিক আস্থা, আরেকটি জাগতিক। আধ্যাত্মিক আস্থা হলো সৃষ্টিকর্তা; আর জাগতিক আস্থা রাষ্ট্র বা প্রতীকী অর্থে সরকার। যখন এই দুয়ের মধ্যে দুটির ওপর থেকেই মানুষের আস্থা ভঙ্গ হয়, তখন সে আত্মঘাতী হয়ে ওঠে।
প্রশ্ন হচ্ছে, রাষ্ট্রের ওপর মানুষের আস্থা উঠে যায় কখন? রাজনীতিবিদদের হঠকারিতা, আমলাদের দুর্নীতি, নাগরিক সমাজের ঢালাও সমালোচনামূলক কার্যক্রম এবং সংবাদমাধ্যমের পক্ষপাতিত্ব সাধারণ মানুষকে রাষ্ট্র ও সরকারের ব্যাপারে বিভ্রান্ত করে। তখন রাষ্ট্রের এক অংশের প্রতি আরেক অংশের অনাস্থা তৈরি হয়, অবিশ্বাস জন্ম নেয়। রাজনীতিবিদ, প্রশাসন ও সাধারণ জনগণের সম্পর্কের ম্যাট্রিক্স এলোমেলো হয়ে যায়।
‘হোয়াই নেশনস ফেইল’ গ্রন্থে রবিনসন এবং ড্যারন অ্যাসমগলু বলেছেন, কোনো দেশের প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাধীনভাবে কাজ না করতে পারলে রাষ্ট্র ধ্বংসের দিকে যেতে থাকে; সাম্রাজ্যে অন্ধকার নেমে আসে। জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর এম. জেরল্ড বলেছেন, বর্তমানে অনেক দেশের রাজনৈতিক আচরণে আত্মপ্রেম প্রক্রিয়া চলমান। রাজনীতিবিদ নিজের প্রয়োজন নিয়ে ভাবিত, জনগণ গোষ্ঠীস্বার্থে বিভক্ত, আমলাদের অগ্রাধিকার তাদের সুযোগ-সুবিধা। কেউ ভাবছে না– কীসে সবার ভালো, সবাই মিলে ভালো থাকা যাবে।
কোনো রাষ্ট্র তখনই উন্নত হয় যখন সামাজিক সম্পর্কগুলো সুবিন্যস্ত থাকে। অপরাধীর সঙ্গে পুলিশের সম্পর্ক যেমন ব্যবস্থা নেওয়ার, জনসাধারণের সঙ্গে আমলার সম্পর্ক যেমন সেবা দেওয়া-নেওয়ার; তেমনি রাজনীতিবিদ, সেনাবাহিনী, নাগরিক সমাজ, শিক্ষক, গণমাধ্যমকর্মী, ব্যবসায়ী– প্রত্যেকের সঙ্গে প্রত্যেকের সুবিন্যস্ত সম্পর্ক রয়েছে। সেই সম্পর্কই বিভিন্ন পক্ষের রাজনৈতিক আচরণের মনোজগৎ নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে মিশে আছে ব্যক্তিস্বার্থ রক্ষা এবং বিপরীত ধারাকে দমন করার দীক্ষা।
রাষ্ট্র সংস্কারের প্রথম কথা সমাজে সম্প্রীতি ও সহনশীলতা নিশ্চিত করা। ব্যবসায়ী যদি নিশ্চিন্তে ব্যবসা করতে না পারেন; শিক্ষক যদি নির্ভয়ে পড়াতে না পারেন; জনগণ যদি বুক ফুলিয়ে চলতে না পারে, তাহলে রাষ্ট্রব্যবস্থা স্বয়ংক্রিয়ভাবে অকার্যকর হয়ে যাবে।
ব্যক্তির রাজনৈতিক আচরণ নির্ধারিত হয় রাষ্ট্রের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তার সম্পর্ক দ্বারা। কেউ যদি রাষ্ট্রের কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে নির্যাতিত হয়, তার কাছে সুনাগরিকসুলভ আচরণ আশা করা বৃথা। সে হয়ে উঠবে নৈরাজ্যবাদী, যে কিনা প্রাচীন দার্শনিক সিসেরোর মতো মনে করবে, রাষ্ট্র হলো সবচেয়ে বড় শোষক। অন্যদিকে নাগরিক যদি রাষ্ট্রের প্রতি দায়িত্বশীল না হয়, তাহলেও গণতন্ত্রের সঠিক স্বাদ থেকে বঞ্চিত হবে। রাষ্ট্র ও নাগরিকের সম্পর্কের ম্যাট্রিক্স যত ছন্দময় হবে দেশ তত এগিয়ে যাবে।
মো. সুমন জিহাদী; পিএইচডি ফেলো,
এআইটি, থাইল্যান্ড