‘মবের মুল্লুকে’ যখন ‘আদিবাসী’ শব্দ নিয়ে আপত্তি
Published: 14th, January 2025 GMT
নবম ও দশম শ্রেণির একটি পাঠ্যবইয়ে ‘আদিবাসী’ শব্দযুক্ত গ্রাফিতি বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। এনসিটিবির ওয়েবসাইটে দেওয়া ওই বইয়ের অনলাইন ভার্সন বা পিডিএফে আগের সেই গ্রাফিতি বাদ দিয়ে এরই মধ্যে নতুন একটি গ্রাফিতি যুক্ত করা হয়েছে। যেভাবে বা যে প্রক্রিয়ায় ‘আদিবাসী’ শব্দযুক্ত গ্রাফিতিটি বাদ দেওয়া হলো, তা নিয়ে নানা প্রশ্ন ও আলোচনা–সমালোচনা তৈরি হয়েছে।
প্রথম আলোয় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ‘শিক্ষার্থীদের একটি অংশের’ দাবির মুখে গ্রাফিতি বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এনসিটিবি। শিক্ষার্থীদের সেই একটি অংশ হলো ‘স্টুডেন্ট ফর সভারেন্টি’ নামে একটি সংগঠন। ‘আদিবাসী’ শব্দটি বাতিলসহ কয়েকটি দাবিতে এই সংগঠনের ব্যানারে গত রোববার মতিঝিলে এনসিটিবি ঘেরাও করে বিক্ষোভ করা হয়।
শিক্ষার্থী বা যেকোনো শ্রেণি–পেশার মানুষ বা সংগঠন তাদের নীতি–আদর্শ–চিন্তা–চাহিদা অনুযায়ী সরকারি কোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের কাছে যেকোনো দাবি জানাতেই পারে। বিভিন্ন পক্ষ বা অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে সেই দাবি কতটা যৌক্তিক, সেটা বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত দেওয়ার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের। দাবিদাওয়ার ক্ষেত্রে এভাবেই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বা পদ্ধতি অনুসরণ করতে হয়। কিন্তু বিক্ষোভের নামে জোরজবরদস্তি কিংবা মবের মাধ্যমে চাপ প্রয়োগ করে সেই দাবি আদায় গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। ‘আদিবাসী’ শব্দযুক্ত গ্রাফিতি বাদ দেওয়ার ক্ষেত্রে এ রকম কিছু ঘটেছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।
এ ক্ষেত্রে এনসিটিবিরও দায় এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। কারণ, কোনো একটি পক্ষ বা গোষ্ঠী কিছু একটা দাবি করলেই বিচার–বিবেচনা ছাড়াই সেটা মেনে নেওয়া কোনো ভালো দৃষ্টান্ত নয়। এর আগে একই প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে এইচএসসি পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ রকমটা চলতে থাকলে যে কেউ যেকোনো দাবি নিয়ে হাজির হতে পারে এবং সেটা মেনে নেওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করতে পারে। এই প্রবণতাকে অনেকেই ‘মবের মুল্লুকের’ সঙ্গে তুলনা করেছেন।
স্টুডেন্ট ফর সভারেন্টির ভাষ্য, সংবিধান অনুযায়ী ‘আদিবাসী’ শব্দটি ব্যবহারের সুযোগ নেই। সংবিধানে ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃগোষ্ঠীর কথা বলা হয়েছে। সংগঠনটির একজন নেতা জানান, তাঁদের বিক্ষোভ চলাকালে এনসিটিবির চেয়ারম্যানের প্রতিনিধিরা তাঁদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। সেখানে তাঁরা জানিয়েছেন ভুল থেকে এটি হয়েছিল। (প্রথম আলো, ১৩ জানুয়ারি ২০২৫)।
লক্ষণীয় হলো, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ও নৃগোষ্ঠীর মানুষেরা দীর্ঘদিন ধরে ‘আদিবাসী’ হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবি জানিয়ে আসছেন। রাষ্ট্র এখনো সেই দাবি পূরণ না করলেও তারা নিজেদের আদিবাসী হিসেবে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। ভবিষ্যতে তাঁরা আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি পাবেন কি না, সেটা রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তের বিষয়।
আমাদের স্মরণে থাকা উচিত, ‘আদিবাসী’ শব্দযুক্ত গ্রাফিতিটি আঁকা হয়েছিল জুলাই–আগস্ট গণ–অভ্যুত্থানের সময়। এই গ্রাফিতির স্পিরিট বা চেতনা হলো ধর্মীয় ও জাতিগত সম্প্রীতি এবং ফ্যাসিবাদবিরোধী ঐক্য। জুলাই–আগস্টে আন্দোলনমুখর দিনগুলোতে এই গ্রাফিতি নিয়ে কেউ কোনো আপত্তি জানায়নি। তাহলে এখন কেন এই আপত্তি?
ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পর দেশে মেজরটিরিয়ান বা সংখ্যাগরিষ্ঠবাদী কর্মকাণ্ড অনেক বেশি দৃশ্যমান হয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠতার অজুহাতে তারা ভিন্ন ধর্ম বা জাতিগোষ্ঠীর মানুষের ভূমিকাকে স্বীকার করতে চাচ্ছে না। তাদের এই কর্মকাণ্ড অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র গঠনে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, গণ–অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা ছিল গণতন্ত্র, বাক্স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার ইত্যাদি বিষয়। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে এখন অনেকের প্রধান প্রবণতা হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘মবোক্রেসি’ বা ‘মবের মুল্লুক’ অর্থাৎ ‘জোর যার মুল্লুক তার’। এই ‘মবোক্রেসি’ ডেমোক্রেসি বা গণতন্ত্রের জন্য একটি বড় বাধা।
২০২৪–এর ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থান আমাদের নিশ্চিতভাবেই আশাবাদী করেছে। এ রকম একটি ঐতিহাসিক ঘটনার পর ‘মবের মুল্লুক’ চলতে থাকলে তা গণ–অভ্যুত্থানের স্পিরিট বা চেতনাকে দিন দিন দুর্বল করবে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তি এবং গণ–অভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তিকে তাই অতি দ্রুত ‘মবের মুল্লুক’ থামাতে হবে।
মনজুরুল ইসলাম প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
ইউক্রেনে জেলেনস্কির বিকল্প নেতা খুঁজছে যুক্তরাষ্ট্র!
ইউক্রেনে শান্তিচুক্তির জন্য দেশটির প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির পদত্যাগ করা লাগতে পারে বলে জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইক ওয়ালৎস। তিনি বলেছেন, ‘ইউক্রেনের একজন নেতা প্রয়োজন, তিনি আমাদের সঙ্গে কাজ করতে পারবেন। তিনি শেষ পর্যন্ত রাশিয়ার সঙ্গে কাজ করতে পারবেন এবং এই যুদ্ধ থামাতে পারবেন।’ খবর- সিএনএন
গণমাধ্যমের সামনেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির নজিরবিহীন বাগবিতণ্ডার পর এ কথা বললেন তিনি। বাগবিতণ্ডার এ ঘটনাটি নিয়ে নানা আলোচনা চলছে বিশ্বজুড়ে। ওই ঘটনার পর ইউক্রেনের খনিজ সম্পদ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যে ঐতিহাসিক চুক্তি হওয়ার কথা ছিল, সেটিও বাতিল হয়ে যায়। আর এর পরই ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ কোন পথে, তা নিয়ে শুরু হয় আলোচনা।
এই প্রকাশ্য দ্বন্দ্ব ন্যাটোর ইউরোপীয় সদস্যদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বড় সংকটের ইঙ্গিত দিচ্ছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। শুক্রবারের ওই ঘটনায় সাবেক ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের গড়া ওয়াশিংটন-কিয়েভ সম্পর্ক ভেঙে পড়েছে। এই প্রকাশ্য দ্বন্দ্ব ন্যাটোর ইউরোপীয় সদস্যদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বড় সংকটের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
যদিও ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের বিষয়ে আবারও এক টেবিলে বসার ইঙ্গিত দিয়েছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও। তিনি বলেছেন, ইউক্রেন ও রাশিয়া-দুই পক্ষই আলোচনায় না বসলে যুদ্ধ থামবে না। হোয়াইট হাউসে শুক্রবার ট্রাম্প-জেলেনস্কি বিতণ্ডার পর থেকে ইউক্রেনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের আর কথা হয়নি। যুদ্ধ থামানোর জন্য রাশিয়াকে আলোচনার টেবিলে আনতে হবে। তবে তাদের প্রতি বৈরী মনোভাব রাখলে, মস্কোকে আলোচনায় যুক্ত করা সম্ভব হবে না। কোনো চুক্তি করার ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এই মনোভাবই দেখিয়ে আসছেন।
তিনি বলেন, ‘আমি আশা করি, সবকিছু আবার শুরু হতে পারে। আশা করি, তিনি (জেলেনস্কি) এটা বুঝতে পারবেন যে আমরা আসলে আরও হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুর আগে, তাঁর দেশকে সাহায্যের চেষ্টা করছি।’