কুষ্টিয়ায় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের অভিযান, ভাঙা হলো আ.লীগ নেতার দখলে থাকা স্থাপনা
Published: 14th, January 2025 GMT
কুষ্টিয়ায় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের জায়গা দখল করে সীমানাপ্রাচীর দিয়ে বিশাল ফটক নির্মাণ করেন জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান রবিউল ইসলাম। একই সঙ্গে গৃহায়ণের বিভিন্ন প্লট দখল করে সেখানে আইটি পার্ক, স্কুল ভবন, জেলা পরিষদের মিলনায়তন নির্মাণ করা হচ্ছিল।
আজ মঙ্গলবার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ গুঁড়িয়ে দিয়েছে বেশ কিছু স্থাপনা। গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ বলছে, জায়গা দখলমুক্ত করে প্রকৃত মালিকদের বুঝিয়ে দেওয়া হবে।
উচ্ছেদ অভিযানের নেতৃত্ব দেন জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের উপপরিচালক নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আর এম সেলিম শাহনেওয়াজ। এ সময় সেখানে অন্তত ৫০ জন প্লটের প্রকৃত মালিক উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা বলছেন, দীর্ঘ ৮ বছর ধরে তাঁরা দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন। বিগত আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকার সময় তাঁদের জায়গা দখল করে নেওয়া হয়েছিল। ক্ষমতার দাপটে আওয়ামী লীগের নেতারা তাঁদের বিভিন্ন সময়ে হুমকি দিয়ে এসব জমি দখল করে সরকারি স্থাপনা করার উদ্যোগ নেন।
জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ সূত্র জানায়, কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসংলগ্ন তাদের হাউজিং এলাকায় সাড়ে ১৯ একর জায়গা আছে। এসব জায়গা ২০১৮ সালের আগে লটারি করে বরাদ্দ দেওয়া হয়। আড়াই কাঠা, তিন কাঠা ও পাঁচ কাঠার প্লট রয়েছে। সব মিলিয়ে প্রায় ২১২টি প্লট রয়েছে। তবে ২০১৮ সালের দিকে জেলা প্রশাসন এসব জমি অধিগ্রহণের নামে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানকে দেয়। এদিকে প্লট বরাদ্দ পেয়ে অনেকে তাঁদের জমি নিবন্ধনও করে নেন। প্লটমালিকেরা তাঁদের জমি আর বুঝে পাননি।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা প্রশাসনের সঙ্গে যোগসাজশ করে বিভিন্ন সরকারি স্থাপনা করেন। এর মধ্যে রয়েছে বিশাল আকারের শাহি মসজিদ, এক হাজার আসনের অত্যাধুনিক জেলা পরিষদের মিলনায়তন, আইটি পার্ক। এ ছাড়া জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি রবিউল ইসলাম দুই বিঘা জমি দখল করে নেন। সেই জমি সীমানাপ্রাচীর দিয়ে বিশাল ফটক নির্মাণ করেন। শাহি মসজিদের কাজ প্রায় শেষ হয়ে গেছে। জেলা পরিষদের মিলনায়তনের ৫০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। আইটি পার্কের ১৫ থেকে ২০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে।
প্লটমালিকেরা বলেন, সরকারি কোষাগারে টাকা জমা দিয়েও প্লট বুঝে পাচ্ছিলেন না। তাঁরা রায় পেলেও প্রভাবশালী নেতারা জায়গা জোর করে দখল করে রেখেছিলেন উন্নয়ন করার নামে। উল্টো মামলা তুলে নিতে ভয়ভীতি দেখিয়ে আসছিলেন। ২০১৮ সালের দিকে ছয়জন প্লটমালিক তাঁদের জমি ফেরত পেতে উচ্চ আদালতে রিট করেন। গত বছরের ১৪ ডিসেম্বর তাঁরা তাঁদের পক্ষে রায় পান।
সরেজমিন দেখা যায়, পুলিশ-র্যাবের সহযোগিতায় ম্যাজিস্ট্রেট উচ্ছেদ অভিযান চালাচ্ছেন। আওয়ামী লীগ নেতা রবিউল ইসলামের দখলে থাকা জমির সীমানাপ্রাচীর ভেঙে ফেলা হয়। এরপর জেলা পরিষদের মিলনায়তনের সামনে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অস্থায়ী কার্যালয়ও ভাঙা হয়। আইটি পার্কে গিয়েও উচ্ছেদ চালানো হয়।
ভুক্তভোগী সাইফুল আলী প্রথম আলোকে বলেন, তিনি বি ব্লকে ৯ নম্বর প্লট পেয়েছিলেন। পাঁচ কাঠা জমি বরাদ্দ পেয়ে রেজিস্ট্রিও করেছিলেন। কিন্তু গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ বুঝিয়ে দিতে পারেনি। সে সময় জেলা প্রশাসক আসলাম হোসেন খাস দেখিয়ে এসব জমি অধিগ্রহণ করেন। কিন্তু তিনিসহ ছয়জন প্লটমালিক উচ্চ আদালতে রিট করেন। এরপর তাঁরা রায় পান।
গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মাহসুদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের প্রায় ২০ একর জায়গা নিয়ে সমস্যা আছে। আমরা সেগুলো আজ দখলমুক্ত করছি। নতুন করে নকশা করা হবে। যাঁরা রেজিস্ট্রি করেছেন, তাঁদের জায়গা বুঝিয়ে দেওয়া হবে।’
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
এক সময়ের বনদস্যুর ‘বয়ানে’ সুন্দরবনে দস্যুতার দিনগুলো
সুন্দরবনে দস্যুতায় টাকা ছিল। কিন্তু সে অবৈধ টাকা নিজেরা উপভোগ করতে পারতেন না। বনের মধ্যে সব সময় মৃত্যুঝুঁকি তাড়িয়ে বেড়াত, এক ঘণ্টা শান্তির ঘুমও হতো না। মোটেও সুখ ছিল না। দস্যুতার জগতে গিয়ে নিজের প্রাপ্তি বলতে নামের সঙ্গে জুড়ে গেছে ডাকাত শব্দটি। স্ত্রী-সন্তানদেরও চলতে হতো মাথা নিচু করে। কথাগুলো একসময়ের বনদস্যু আল-আমীনের।
আল-আমীন বলেন, দস্যুতা ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে তিনি ভালোই আছেন। আর কখনো ওই অন্ধকার পথে পা বাড়াতে চান না তিনি। সম্প্রতি তাঁর সঙ্গে দেখা হয় কয়রা উপজেলার সুন্দরবনঘেঁষা খোড়লকাঠি বাজারসংলগ্ন কয়রা নদীর তীরে। ছোট বাজারটিকে সুন্দরবন থেকে আলাদা করেছে পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া কয়রা নদী।
নদীর ওপারের সুন্দরবনের ত্রাস ছিলেন আল-আমীন। তিনি বলেন, তখন শরীফ বাহিনী ছিল বড় দস্যুদল। সেই দলে যোগ দিয়ে ডাকাত হয়েছিলেন। কিছুদিনের মধ্যে এলাকায় নাম ছড়িয়ে গেলে বাড়ি ফেরার পথ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। তাঁরা সুন্দরবনের মধ্যে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে বনজীবীদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করতেন। র্যাব আর কোস্টগার্ডের অভিযানের ভয়ে বনের মধ্যে প্রতিটি মুহূর্ত ভয় আর উৎকণ্ঠায় কাটত তাঁদের।
আল-আমীনের বলতে থাকেন, ধীরে ধীরে ছোট হয়ে আসছিল তাঁর গণ্ডি। বাড়ি ফেরার জন্য মনটা ব্যাকুল হয়ে উঠত। অপরাধের জগৎ ছেড়ে ভালো হতে চাইতেন, তবে সুযোগ পাচ্ছিলেন না। ২০১৮ সালের শেষের দিকে সুযোগ আসে। আত্মসমর্পণের মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফেরেন। দস্যুনেতা শরীফ না চাইলেও তাঁকে কৌশলে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করা হয়েছিল। তাঁরা দলের ১৭ জন সদস্য ১৭টি অস্ত্র আর ২ হাজার ৫০০ গুলিসহ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন।
দস্যুজীবন যাঁরা একবার দেখেছেন, তাঁরা না খেয়ে থাকলেও আর দস্যুতায় ফিরতে চান না—এমনটাই দাবি আল-আমীনের। নদীর তীরে দাঁড়িয়ে গল্প গল্পে তিনি বলেন, ডাঙায় থাকা মাছ ব্যবসায়ীরা ডাকাতদের বাজার, বন্দুক, গুলি সবই সাপ্লাই দিতেন। সব জিনিসের দাম নিতেন তিন থেকে চার গুণ বেশি।
বন বিভাগ ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ থেকে ২০১৮ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ধাপে ধাপে সুন্দরবন অঞ্চলের ৩২টি দস্যু বাহিনীর ৩২৮ জন দস্যু ৪৬২টি অস্ত্র, ২২ হাজার ৫০৪টি গোলাবারুদসহ আত্মসমর্পণ করেছিলেন। পরে ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর সব শেষ দস্যুদল হিসেবে আত্মসমর্পণ করে শরীফ বাহিনী। সেদিনই প্রাণবৈচিত্র্যে ভরা সুন্দরবনকে ‘দস্যুমুক্ত’ ঘোষণা করা হয়। তবে দস্যুনেতা শরীফ গত বছরের ৫ আগস্টের পর আবার সুন্দরবনে দস্যুতায় নেমেছেন বলে তাঁর একসময়ের সাথীদের ভাষ্য।
সুন্দরবন দস্যুমুক্ত করার কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সাংবাদিক মোহসীন-উল হাকিম। তিনি বলেন, দলনেতা শরীফের পুরো নাম করিম শরীফ। কয়রার আল-আমীন ছিল বাহিনীর সর্বকনিষ্ঠ সদস্য। শরীফ প্রথমে আত্মসমর্পণে রাজি থাকলেও পরে বেঁকে বসেন। অন্যরা আত্মসমর্পণ করেন। তবে শরীফ এখন পুনরায় সুন্দরবনে দস্যুতায় নেমেছেন।
কয়রা কপোতাক্ষ মহাবিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক অধ্যাপক আ ব ম আবদুল মালেক বলেন, বনের নিরাপত্তায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা কমে আসায় সুন্দরবনে আবারও দস্যুদের উৎপাত বেড়েছে। এভাবে দস্যুতা চলতে থাকলে বনজীবীদের জীবিকা, সুন্দরবন থেকে রাজস্ব আদায় ও পর্যটন হুমকির মুখে পড়বে; বিপন্ন হবে বন্য প্রাণী আর প্রাণবৈচিত্র্য। দস্যুতা দমনে প্রশাসনকে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার অনুরোধ করেন তিনি।