‘ওরা আমাদের কবরের ওপর বুট পরে হেঁটে বেড়াচ্ছে’, শ্রীলঙ্কার ভিসুভামাডুতে একটি পুরোনো কবরস্থানের জায়গায় দাঁড়িয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কথাগুলো বলছিলেন তামিল নারী কাবিতা। তাঁর সঙ্গে যখন আমি কথা বলছিলাম, তখন বৃষ্টির ঝাপটা এসে পড়ছিল। সেই ঝাপটা তাঁর চোখের পানি ধুয়ে দিচ্ছিল।

শ্রীলঙ্কার তামিলদের মুক্তি চেয়ে লড়াই করা সশস্ত্র গোষ্ঠী লিবারেশন টাইগার্স অব তামিল ইলম বা এলটিটিইর নিহত যোদ্ধাদের এই কবরস্থানে কবর দেওয়া হয়েছিল। সেখানে কাবিতার ভাইয়েরও কবর আছে। কিন্তু রাজাপক্ষে সরকার সে কবরগুলোর ওপর সামরিক ঘাঁটি বানিয়েছে। সরকারের এই কাজে ক্ষোভ প্রকাশ করছিলেন কাবিতা।

এলটিটিই শ্রীলঙ্কার উত্তর ও পূর্বাঞ্চলে প্রভাবশালী ছিল। তারা প্রায় তিন দশক ধরে একটি স্বাধীন তামিল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করেছিল। তবে ২০০৯ সালে তারা চূড়ান্তভাবে পরাজিত হয় এবং শ্রীলঙ্কার সে সময়কার সরকারের কাছে আত্মসমর্পণ করে। যুদ্ধের সময় সরকার এই কবরস্থানের মতো এলটিটিই নিয়ন্ত্রিত অনেক স্থাপনাকে ধ্বংস করেছিল বা অন্য কাজে ব্যবহার করেছিল।

গত নভেম্বরের শেষ দিকে কাবিতাসহ হাজারো মানুষ এলটিটিইর পুরোনো কবরস্থানে জড়ো হয়েছিলেন ‘মাভিরার নাল’ পালনের জন্য। এটি একটি বিশেষ দিন। দীর্ঘ যুদ্ধে মারা যাওয়া এলটিটিই যোদ্ধাদের এই দিনে স্মরণ করা হয়। এটি কোনো একক বা ছোটখাটো স্মরণানুষ্ঠান নয়।

সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ভিসুভামাডু ছাড়াও শ্রীলঙ্কার উত্তর-পূর্বে আরও দুই শর বেশি জায়গায় (যেমন বিশ্ববিদ্যালয়, উপাসনালয় ও পুরোনো কবরস্থানে) এই অনুষ্ঠান পালিত হয়। সেখানে হাজার হাজার মানুষ অংশ নেন।

২০২৪ সালের মাভিরার নাল পালনের প্রতি মানুষের এত আগ্রহ শ্রীলঙ্কাবাসীকে দেখিয়ে দিয়েছে, যাঁরা ভাবছিলেন, তামিল জাতীয়তাবাদ শেষ হয়ে গেছে, তাঁরা আসলে ভুল। এর মাত্র দুই সপ্তাহ আগে ১৪ নভেম্বর শ্রীলঙ্কার জাতীয় নির্বাচনের ফল দেখে অনেকেই এমনটা ধারণা করেছিলেন।

ওই নির্বাচনে বামপন্থী সিংহলি দল ন্যাশনাল পিপলস পাওয়ার (এনপিপি) বিশাল জয় পেয়েছে। তারা আগের সব রেকর্ড ভেঙে পার্লামেন্টে ১৫৯টি আসন জিতেছে। এ ছাড়া তারা উত্তর-পূর্বের তামিল-সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাগুলোর প্রায় সব কটিতে জয় পেয়েছে। তামিল জাতীয়তাবাদী দল তেমন ভোট পায়নি।

এই কারণে অনেকে মনে করেছিলেন, তামিলরা তাদের স্বাধীনতা বা স্বায়ত্তশাসনের স্বপ্ন বাদ দিয়েছে।

কিন্তু তামিলদের নিজস্ব ভূমির দাবি ও তাদের রাজনৈতিক বাস্তবতা অনেক জটিল। আদতে দীর্ঘদিনের অর্থনৈতিক সমস্যা এবং দুর্নীতির কারণে রাজাপক্ষে সরকারের বিরুদ্ধে মানুষের মনে যে ক্ষোভ জন্মেছিল, সেই ক্ষোভের কারণেই মূলত এনপিপি ক্ষমতায় এসেছে।

২০০৫ সাল থেকে শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে প্রভাবশালী অবস্থানে থাকা রাজাপক্ষে পরিবারের পতন খুবই চমকপ্রদ ছিল। এই পরিবারকে তামিলরা কখনোই সমর্থন করেনি। কারণ, তামিলরা মাহিন্দা রাজাপক্ষে ও তাঁর ভাই গোতাবায়ে রাজাপক্ষকে গণহত্যার জন্য দায়ী করে। তবে দক্ষিণের সিংহলি–অধ্যুষিত এলাকায় রাজপক্ষে পরিবারকে বীর হিসেবে দেখা হতো, কারণ তারা এলটিটিইকে দমন করেছিল।

২০১৯ সালে গোতাবায়ে রাজাপক্ষে বিপুল ভোটে প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। কিন্তু নির্বাচিত হওয়ার তিন বছরের কম সময়ের মধ্যে ২০২২ সালে সিংহলি দক্ষিণে গণ-আন্দোলনে তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন। এরপর রাজাপক্ষে পরিবার দ্রুত তাদের সব রাজনৈতিক ক্ষমতা হারায়। ২০২৪ সালের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তাদের দল মাত্র তিনটি আসন জিততে পেরেছে।

এনপিপি নভেম্বরের ভোটে এমন এক বিজয় অর্জন করেছে, যা দেশের দীর্ঘদিনের জাতিগত বিভাজনকে ছাপিয়ে গেছে। এমনকি তারা তামিল জাতীয়তাবাদের সবচেয়ে শক্ত ঘাঁটি জাফনাতেও জিতেছে।

নতুন সরকার চাইলে তামিলদের স্বায়ত্তশাসনসহ কিছু দাবি মেটাতে পারে। এর জন্য রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি, সন্ত্রাসবিরোধী আইন বাতিল, সামরিক বাহিনীর দখলে থাকা জমি ফেরানো এবং উত্তর-পূর্বে ভূমি দখল ও সিংহলি বসতি স্থাপন বন্ধ করা জরুরি। নতুন সরকার যদি এসব দাবি না মানে, তাহলে শ্রীলঙ্কার বিভাজন একই রকম থেকে যাবে।

এটি অনেককে, বিশেষ করে যাঁরা বাইরে থেকে তামিল রাজনীতি পর্যবেক্ষক করে থাকেন, তাঁদের অবাক করেছে। কেউ কেউ এই ভোটের ফলকে তামিল জাতীয়তাবাদের ‘শেষের শুরু’ বলেও ভেবেছেন। এমনকি এনপিপির কিছু নেতা বলেছিলেন, জাফনায় তাদের জয়ের অর্থ হলো তামিলরা ‘বর্ণবাদ’ ছেড়ে দিয়েছে।

কিন্তু উত্তর-পূর্বে এনপিপির জয় মানে তামিল জাতীয়তাবাদকে প্রত্যাখ্যান করা—এই ধারণা সর্বাংশে ভুল।

যাঁরা তামিল জনগণের মনের কথা বোঝেন, তাঁরা জানেন, এবারের ভোটে পরিবর্তনের কারণ তামিল জাতীয়তাবাদ ছেড়ে দেওয়া নয়। বরং এটি তামিল রাজনীতিবিদদের প্রতি তামিল নাগরিকদের অসন্তোষের প্রকাশ।

পাশাপাশি নির্বাচনের ফল দেখিয়েছে, তামিলরা বাস্তববাদী। তাঁরা ভোট দেওয়ার সময় তাঁদের অর্থনৈতিক স্বার্থ ও রাজনৈতিক চাহিদা—দুটিকেই বিবেচনায় রাখে।

অনেক তামিল জাতীয়তাবাদী এনপিপিকে ভোট দিয়েছেন। কারণ তাঁরা ভেবেছেন, এনপিপি অর্থনৈতিক উন্নতি আনতে পারবে। আবার অনেকে দুর্নীতিগ্রস্ত ও অযোগ্য স্থানীয় রাজনীতিবিদদের শাস্তি দিতে চেয়েছেন। এনপিপি নিজেদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করা দল হিসেবে তুলে ধরেছিল, যা কিনা তামিল ভোটারদের তাদের দিকে টেনেছে।

কলম্বোর একটি জনপ্রিয় জায়গায় বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের জব্দ করা বিলাসবহুল গাড়ি প্রদর্শন এনপিপির জনপ্রিয়তা বাড়ায়। এটি ধনী অভিজাতদের প্রতি একটি প্রতীকী চপেটাঘাত ছিল। তামিলদের প্রতি তাদের ইতিবাচক বার্তা, বর্ণবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান, মাভিরার নাল পালনের অনুমতি দেওয়া এবং তামিলদের দমনে ব্যবহৃত সন্ত্রাসবিরোধী আইন বাতিলের প্রতিশ্রুতি উত্তর-পূর্বে তাদের সমর্থন বাড়ায়।

কাবিতা নিজেও একজন দৃঢ় তামিল জাতীয়তাবাদী। কিন্তু তিনিও এনপিপিকে ভোট দিয়েছেন। তবে তিনি স্পষ্ট করেছেন, তিনি তামিল দলের (আইটিএকে) প্রতি হতাশা এবং তাৎক্ষণিক অর্থনৈতিক প্রয়োজন মেটানোর জন্য এনপিপিকে ভোট দিয়েছেন।

তবে এনপিপির প্রতি তামিলদের এই সমর্থন শর্তসাপেক্ষ এবং ইতিমধ্যে সে সমর্থনে ফাটল দেখা যাচ্ছে।

মাভিরার নাল পালনের জন্য তামিলদের গ্রেপ্তার করা এবং কবরস্থান থেকে সামরিক ঘাঁটি সরানোর প্রতিশ্রুতি পূরণ না করার কারণে সরকারের প্রতি তাদের ক্ষোভ বাড়ছে। তামিলরা মনে করছে, নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিগুলো শুধুই ফাঁকা বুলি ছিল।

এনপিপি আগে কখনো ক্ষমতায় ছিল না, তাই তাদের অতীত শাসকদের মতো দায় নেই। তবে তাদের প্রধান দল জেভিপি একসময় ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে নিষিদ্ধ ছিল; কারণ তাদের বিদ্রোহে হাজার হাজার সিংহলি নিহত হয়েছিলেন।

শ্রীলঙ্কার রাজনীতি সিংহলি বৌদ্ধদের প্রাধান্য দেওয়ার ওপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে। সেখানে তামিলদের কখনো সমান নাগরিক হিসেবে দেখা হয়নি। তারা সব সময় অবহেলিত হয়েছে। এমনকি তামিল নেতারাও প্রায়ই তাঁদের দাবিগুলো থেকে সরে গিয়ে কলম্বোর ক্ষমতাবানদের সঙ্গে মিশে গেছেন।

তবে এবারের নির্বাচন দেখিয়েছে, তামিলদের রাজনৈতিক শক্তি শুধু ভোটের মাধ্যমে বোঝা যায় না। মাভিরার নাল এবং তামিল জাতীয়তাবাদী স্মরণানুষ্ঠানগুলো তামিলদের মানসিকতার গভীরে প্রোথিত। এই তামিল ইলমকেন্দ্রিক চেতনা নির্বাচনের বাইরে গিয়েও টিকে থাকবে এবং তাদের লক্ষ্যপূরণের চেষ্টা করবে।

নতুন সরকার চাইলে তামিলদের স্বায়ত্তশাসনসহ কিছু দাবি মেটাতে পারে। এর জন্য রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি, সন্ত্রাসবিরোধী আইন বাতিল, সামরিক বাহিনীর দখলে থাকা জমি ফেরানো এবং উত্তর-পূর্বে ভূমি দখল ও সিংহলি বসতি স্থাপন বন্ধ করা জরুরি। নতুন সরকার যদি এসব দাবি না মানে, তাহলে শ্রীলঙ্কার বিভাজন একই রকম থেকে যাবে।

মারিও আরুলথাস ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের এসওএএসের একজন গবেষক

আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

.

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

‘ডিসি-থানা সব বুক করে ফেলছি, আমাগো কথা ছাড়া পুলিশ আইলে বাইন্দা থুমু’

‘অনলাইনে জুয়া খেলার’ এক সঙ্গীর কাছে নিজের ক্ষমতা জাহির করতে পিরোজপুরের নাজিরপুরে বিএনপি নেতা মো. মন্টু হাওলাদার বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে মামলা করতে গেলে পুলিশ নাম শুনে মামলা নেয়নি। এমনকি ডিসি, থানা ও ফাঁড়ি সব বুক করে ফেলছি।’ বিএনপি নেতার এমন বক্তব্যের একটি অডিও ভাইরাল হয়েছে।   

মো. মন্টু হাওলাদার(৪৫) নাজিরপুর উপজেলার দেউলবাড়ি দোবরা ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক।

ভাইরাল হওয়া অডিওতে বিএনপি নেতাকে বলতে শোনা যায়, আমাগো কথা ছাড়া পুলিশ আইলে বাইন্দা থুমু জায়গার উপর। আমার বিরুদ্ধে মামলা করতে গেলে পুলিশ নাম শুনে মামলা নেয়নি। এমনকি ডিসি, থানা ও ফাঁড়ি সব বুক করে ফেলছি।’

অনলাইনে জুয়া খেলা নিয়ে দ্বন্দ্বে সম্প্রতি হাউল ও তার ভাই কাউয়ুম নামের দুই যুবককে পিটিয়ে আহত করেন বিএনপি নেতা মন্টু। এ নিয়ে ভুক্তভোগীরা থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করেন।
 
অভিযোগের বিষয়ে মন্তব্য জানতে মন্টু হাওলাদারের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলে তা বন্ধ পাওয়া যায়।

এ বিষয়ে উপজেলা বিএনপির সদস্য সচিব আবু হাসান খান জানান, মন্টুর দলীয় কোনো পদ নেই।

নাজিরপুর থানার ওসি মো. মাহমুদ আল ফরিদ ভূঁইয়া বলেন, অভিযুক্ত মন্টুর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়েছে। 

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ছাত্র আন্দোলনে নিহত মামুনের মরদেহ ছয় মাস পর কবর থেকে উত্তোলন
  • ‘ডিসি-থানা সব বুক করে ফেলছি, আমাগো কথা ছাড়া পুলিশ আইলে বাইন্দা থুমু’