আত্মহত্যা: প্রেসক্রিপশনের ময়নাতদন্ত হোক
Published: 14th, January 2025 GMT
বছরের শুরুতেই দুটি ‘আত্মহত্যার’ ঘটনা (৯ ও ১১ জানুয়ারি) সংবাদ শিরোনামে ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার পায়। ঘটনা আর কালের মধ্যে মিল থাকলেও স্থান ও পাত্রের মধ্যে কোনো মিল নেই। একজন কম বয়সের ছাত্র, আরেকজন পরিণত বয়সের ঘোর সংসারী দুই সন্তানের বাবা পুলিশ কর্মকর্তা। তবে দুজনই থাকতেন একাকী এক ঘরে; পরিবার থেকে দূরে।
শিক্ষার্থী মেহেদী হাসানের বয়স ২২ কি ২৩ হবে। তিনি ছিলেন রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) নগর ও অঞ্চল–পরিকল্পনা (ইউআরপি) বিভাগের শিক্ষার্থী। রংপুরের আলমনগরের (বনানীপাড়া) ছেলে মেহেদী ছিলেন ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। তাঁর সঙ্গে যাঁরা ভর্তি হয়েছিলেন, তাঁরা পাস করে বেরিয়ে গেলেও মেহেদী থেকে যান।
রুয়েটের ছাত্রকল্যাণ পরিচালক অধ্যাপক মো.
শরীয়তপুরের জাজিরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আল-আমিনের ‘আত্মহত্যা’র ঘটনা সবাইকে বিস্মিত করেছে। বরিশালের মুলাদী উপজেলার কাচিচর গ্রামের আল-আমিন ২০০৭ সালে পুলিশের চাকরিতে যোগ দেন। গত বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর তিনি বরগুনার আমতলী থেকে বদলি হয়ে জাজিরা থানায় আসেন। থাকতেন থানা ভবনের দোতলার একটি ঘরে।
ঘটনার দিন সকালে তিনি থানায় তাঁর কাজের টেবিলে না এলে তাঁর সহকর্মী এক কনস্টেবল বেলা ১১টার দিকে তাঁকে ফোন করেন। ফোনে ওসি আল-আমিন পরে আসবেন জানিয়ে ফোন রেখে দেন। দুই ঘণ্টা পরও তিনি তাঁর কার্যালয়ে না আসায় থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আবদুস সালাম দোতলায় ওসির ঘরে গিয়ে তাঁকে গ্রিলের সঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায় দেখতে পান।
বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার গণমাধ্যমকর্মীদের বলেন, ‘আল-আমিন কোনো একটি বিষয় নিয়ে হতাশায় ভুগতেন। তিনি থানা ভবনের যে ঘরে থাকতেন, সেখানে আমরা কিছু ওষুধ পেয়েছি, যা হতাশা কাটানোর জন্য খাওয়া হয়।’
আমরা ওষুধের সঙ্গে থাকা কাগজ পড়ি না, চিকিৎসকেরাও কি পড়েন? পড়তে দু–তিন মিনিটের বেশি লাগে না। রোগী বা রোগীর স্বজনেরা পড়েন না, কারণ চিকিৎসককে সবাই বিশ্বাস করি। মনে করি, আমরা ওসবের কী বুঝব। চিকিৎসকদের জিজ্ঞাসা করার সাহস নেই, এ ওষুধ কেন দিচ্ছেন? এটি না খেলে কী হবে? খেলে কী কী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে? কত দিন খেতে হবে?দুটি ঘটনার মধ্যে সবচেয়ে বড় মিল—দুজনেই মানসিক পরিস্থিতি সামাল দিতে ওষুধ খাচ্ছিলেন; বলা যায় চিকিৎসাধীন ছিলেন। খটকাটি এখানেই। যেসব ওষুধ মানসিক উদ্বেগ–উৎকণ্ঠার চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়, তার মাত্রা আর সেবনবিধি একটু এদিক-ওদিক হলে যে বিপর্যয় ঘটতে পারে, তা অনেক চিকিৎসকের বোধের মধ্যেই নেই।
বিষণ্নতা দূর করার বহুল ব্যবহৃত ওষুধের সবচেয়ে বড় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হচ্ছে, এটি কোনো কোনো ক্ষেত্রে রোগীর মধ্যে আত্মহত্যার চিন্তা নিয়ে আসতে পারে। এ জাতীয় ওষুধের কাগজে খুব পরিষ্কার করে সেটা লেখা থাকে। তাই খুবই সতর্কতার সঙ্গে এটি ব্যবহারের নির্দেশ আছে। ওষুধ ব্যবস্থাপনার কেতাবে এটিকে বলা হয় ব্ল্যাক বক্স সতর্কীকরণ।
আমরা ওষুধের সঙ্গে থাকা কাগজ পড়ি না, চিকিৎসকেরাও কি পড়েন? পড়তে দু–তিন মিনিটের বেশি লাগে না। রোগী বা রোগীর স্বজনেরা পড়েন না, কারণ চিকিৎসককে সবাই বিশ্বাস করি। মনে করি, আমরা ওসবের কী বুঝব। চিকিৎসকদের জিজ্ঞাসা করার সাহস নেই, এ ওষুধ কেন দিচ্ছেন? এটি না খেলে কী হবে? খেলে কী কী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে? কত দিন খেতে হবে?
ঐশীর কথা মনে পড়েবিষণ্নতার চিকিৎসায় থাকা ঐশীর মৃত্যু নিয়ে তাঁর সাহসী মা–বাবা বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলে (বিএমডিসি) অভিযোগ করেছিলেন। অনেক চড়াই–উতরাই ডিঙিয়ে চিকিৎসকদের অবহেলা আর ক্রমাগত ভুল চিকিৎসার প্রমাণ পেয়েছে কাউন্সিল। এর জন্য ঐশীর মা–বাবাকে দীর্ঘ পাঁচ বছর অপেক্ষা আর চরম ধৈর্যের পরিচয় দিতে হয়েছে।
শেষ পর্যন্ত কাউন্সিল ২০১০ সালের আইনের আওতায় বিএমডিসি চিকিৎসক নুরুল আজিমের (সাবেক কর্নেল) রেজিস্ট্রেশন পাঁচ বছরের জন্য ও চিকিৎসক তানজিমা তাজরিনের এক বছরের জন্য স্থগিত করেছে, যা ২০২৪ সালের ২৮ জুন থেকে কার্যকর হয়েছে। এ সময়ে চিকিৎসক হিসেবে কোথাও চিকিৎসাসেবা দিতে পারবেন না তাঁরা।
এমনকি তাঁরা নিজেদের চিকিৎসক হিসেবেও পরিচয় দিতে পারবেন না। কাউন্সিল এ বিষয়ে এক গণবিজ্ঞপ্তিও জারি করেছে। (বিস্তারিত জানতে পড়ুন ‘মেয়েটির আত্মহত্যা নিয়ে বাবা-মায়ের অভিযোগই সত্য হলো’, প্রথম আলো, ১ জুলাই ২০২৪)
লাশের ময়নাতদন্ত হোক বা না হোক, বিষণ্নতার চিকিৎসা চলছিল—এমন ব্যক্তিদের আত্মহত্যার ঘটনার পর পুলিশের উচিত তাঁর প্রেসক্রিপশন ও ওষুধের তত্ত্বতালাশ করা। না হলে কোনো দিনও জানা যাবে না, ঘটানাগুলো স্রেফ আত্মহত্যা, না ওষুধ–উদ্গত আত্মহত্যা?
গওহার নঈম ওয়ারা লেখক ও গবেষক
ই–মেইল: [email protected]
উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
চিকিৎসা ছাড়া মায়ের কোলে ফিরল সেই শিশু
বরিশাল নগরীর কীর্তনখোলার তীরে উদ্ধার হওয়া পরিচয়হীন সেই নবজাতক ফিরেছে আপন ঠিকানায়। বাবার কোলে চড়ে গত রোববার রাতে (ঈদের আগের দিন) ঢাকা থেকে বাগেরহাটে মায়ের কোলে পৌঁছায়। শিশুটি এখন মায়ের কাছে রয়েছে। তবে অনেকটা বিনা চিকিৎসায় শিশুটিকে বাড়ি ফিরতে হয়।
শিশুটির বাবা বাগেরহাট শহরে ফুটপাথের চা দোকানি গণেশ শ্যাম আজ বুধবার বিকেলে সমকালকে বলেন, গত রোববার দুপুরে শিশুটিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে রিলিজ দেয়। ওই রাতে তিনি ও তার শাশুড়ি সুমি দাস বাসে শিশুটিকে নিয়ে বাগেরহাটের বাসায় পৌঁছান।
রিলিজ দেওয়ার বিষয়ে চিকিৎসকদের বরাত দিয়ে গণেশ জানান, শিশুটির পিঠের টিউমার নিরসনে অস্ত্রোপচার করতে হবে। কিন্তু, একমাস বয়স হওয়ার আগে অস্ত্রোপচার সম্ভব নয়। যেহেতু শিশুর বয়স এক সপ্তাহ হয়েছে। তাই, আরও তিন সপ্তাহ পর ঢামেকে ভর্তির জন্য পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসক।
শিশুটির বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে বাবা গণেশ বলেন, পিঠের টিউমার থেকে পানি বের হচ্ছে। বাগেরহাটের স্থানীয় চিকিৎসকদের চিকিৎসা নিতে যোগাযোগ করছি। কিন্তু, ঈদের ছুটি হওয়ায় কোনো চিকিৎসক পাচ্ছেন না। এজন্য আগামী শনিবার পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতে পারে আশঙ্কার কথা জানান তিনি।
প্রসঙ্গত, গত ২২ মার্চ দিবাগত রাত আনুমানিক ১২টার দিকে নগরীর সংলগ্ন কীর্তণখোলার তীরে ত্রিশ গোডাউন এলাকায় পরিত্যক্ত বাথরুমে অজ্ঞাত নবজাতক উদ্ধার হয়। স্থানীয় বাসিন্দা ফুচকা বিক্রেতা পারভীন বেগম শিশুটিকে উদ্ধার করে বরিশাল শের-বাংলা চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় (শেবাচিম) হাসপাতালে নিয়ে যান। গত ২৮ মার্চ শিশুটির অভিভাবকের সন্ধান পাওয়া যায়। তার আগের দিন (২৭ মার্চ) উন্নত চিকিৎসার জন্য সমাজসেবা অধিদপ্তর ও শেবাচিম হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের তত্বাবধানে শিশুটিকে ঢাকায় পাঠানো হয়।
বাবা গণেশ দত্ত জানান, বরিশাল নগরীর সদর রোড মোখলেসুর রহমান ক্লিনিকে ২১ মার্চ স্ত্রী অন্তরা দাস সিজারের মাধ্যমে শিশুটির জন্ম দেন। এটি তাদের প্রথম সন্তান। জন্মগতভাবেই পিঠের মেরুদণ্ড টিউমার ধরা পড়ে। উন্নত চিকিৎসার জন্য ওইদিনই নবজাতককে শেবাচিম হাসপাতালে নিয়ে যান। হাসপাতালের শিশু সার্জারি ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন ছিলো। ব্যয়বহুল চিকিৎসা ও পুরো সুস্থ্য না হওয়ার আশঙ্কায় পরদিন ২২ মার্চ দুপুরে ওয়ার্ডে বসেই শিশুটিকে এক রিক্সাচালকের কাছে হস্তান্তর করেন। এরপর তাদের আর কিছু জানা নেই।
শেবাচিম হাসপাতালের পরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল ডা. একেএম মশিউর মুনীর জানান, শিশুটির পিঠে মেরদণ্ডের টিসু থেকে টিউমারের উৎপত্তি হয়েছে। এটি পুরোপুরি ভাল হওয়ার সম্ভাবনা কম। চিকিৎসাও অনেক ব্যয়বহুল। তিনি জানান, শিশুটি দত্তক নিতে অনেকে হাসপাতালে গিয়েছিলেন। শারীরিক অবস্থা দেখে ফিরে যান।
বরিশাল সমাজসেবা অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক সাজ্জাদ পারভেজ বলেন, শিশুটির চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। এজন্য কেউ সাহায্যে করতে চাইলে তার মুঠোফোন ০১৭১৫-৫৪৫১৪৫ নম্বরে যোগাযোগ করতে পারেন।