বছরের শুরুতেই দুটি ‘আত্মহত্যার’ ঘটনা (৯ ও ১১ জানুয়ারি) সংবাদ শিরোনামে ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার পায়। ঘটনা আর কালের মধ্যে মিল থাকলেও স্থান ও পাত্রের মধ্যে কোনো মিল নেই। একজন কম বয়সের ছাত্র, আরেকজন পরিণত বয়সের ঘোর সংসারী দুই সন্তানের বাবা পুলিশ কর্মকর্তা। তবে দুজনই থাকতেন একাকী এক ঘরে; পরিবার থেকে দূরে। 

শিক্ষার্থী মেহেদী হাসানের বয়স ২২ কি ২৩ হবে। তিনি ছিলেন রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) নগর ও অঞ্চল–পরিকল্পনা (ইউআরপি) বিভাগের শিক্ষার্থী। রংপুরের আলমনগরের (বনানীপাড়া) ছেলে মেহেদী ছিলেন ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। তাঁর সঙ্গে যাঁরা ভর্তি হয়েছিলেন, তাঁরা পাস করে বেরিয়ে গেলেও মেহেদী থেকে যান।

রুয়েটের ছাত্রকল্যাণ পরিচালক অধ্যাপক মো.

রবিউল ইসলাম সরকার জানান, এক বিষয়ে অকৃতকার্য হওয়ায় মেহেদীর বাড়ি ফেরা হয়নি। এটি নিয়ে তাঁর মধ্যে হতাশা ছিল। তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন এবং মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। ছাত্রকল্যাণ পরিচালকের ধারণা, এ হতাশার কারণেই তিনি আত্মহত্যা করতে পারেন। 

শরীয়তপুরের জাজিরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আল-আমিনের ‘আত্মহত্যা’র ঘটনা সবাইকে বিস্মিত করেছে। বরিশালের মুলাদী উপজেলার কাচিচর গ্রামের আল-আমিন ২০০৭ সালে পুলিশের চাকরিতে যোগ দেন। গত বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর তিনি বরগুনার আমতলী থেকে বদলি হয়ে জাজিরা থানায় আসেন। থাকতেন থানা ভবনের দোতলার একটি ঘরে।

ঘটনার দিন সকালে তিনি থানায় তাঁর কাজের টেবিলে না এলে তাঁর সহকর্মী এক কনস্টেবল বেলা ১১টার দিকে তাঁকে ফোন করেন। ফোনে ওসি আল-আমিন পরে আসবেন জানিয়ে ফোন রেখে দেন। দুই ঘণ্টা পরও তিনি তাঁর কার্যালয়ে না আসায় থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আবদুস সালাম দোতলায় ওসির ঘরে গিয়ে তাঁকে গ্রিলের সঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায় দেখতে পান। 

বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার গণমাধ্যমকর্মীদের বলেন, ‘আল-আমিন কোনো একটি বিষয় নিয়ে হতাশায় ভুগতেন। তিনি থানা ভবনের যে ঘরে থাকতেন, সেখানে আমরা কিছু ওষুধ পেয়েছি, যা হতাশা কাটানোর জন্য খাওয়া হয়।’

আমরা ওষুধের সঙ্গে থাকা কাগজ পড়ি না, চিকিৎসকেরাও কি পড়েন? পড়তে দু–তিন মিনিটের বেশি লাগে না। রোগী বা রোগীর স্বজনেরা পড়েন না, কারণ চিকিৎসককে সবাই বিশ্বাস করি। মনে করি, আমরা ওসবের কী বুঝব। চিকিৎসকদের জিজ্ঞাসা করার সাহস নেই, এ ওষুধ কেন দিচ্ছেন? এটি না খেলে কী হবে? খেলে কী কী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে? কত দিন খেতে হবে? 

দুটি ঘটনার মধ্যে সবচেয়ে বড় মিল—দুজনেই মানসিক পরিস্থিতি সামাল দিতে ওষুধ খাচ্ছিলেন; বলা যায় চিকিৎসাধীন ছিলেন। খটকাটি এখানেই। যেসব ওষুধ মানসিক উদ্বেগ–উৎকণ্ঠার চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়, তার মাত্রা আর সেবনবিধি একটু এদিক-ওদিক হলে যে বিপর্যয় ঘটতে পারে, তা অনেক চিকিৎসকের বোধের মধ্যেই নেই।

বিষণ্নতা দূর করার বহুল ব্যবহৃত ওষুধের সবচেয়ে বড় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হচ্ছে, এটি কোনো কোনো ক্ষেত্রে রোগীর মধ্যে আত্মহত্যার চিন্তা নিয়ে আসতে পারে। এ জাতীয় ওষুধের কাগজে খুব পরিষ্কার করে সেটা লেখা থাকে। তাই খুবই সতর্কতার সঙ্গে এটি ব্যবহারের নির্দেশ আছে। ওষুধ ব্যবস্থাপনার কেতাবে এটিকে বলা হয় ব্ল্যাক বক্স সতর্কীকরণ।  

আমরা ওষুধের সঙ্গে থাকা কাগজ পড়ি না, চিকিৎসকেরাও কি পড়েন? পড়তে দু–তিন মিনিটের বেশি লাগে না। রোগী বা রোগীর স্বজনেরা পড়েন না, কারণ চিকিৎসককে সবাই বিশ্বাস করি। মনে করি, আমরা ওসবের কী বুঝব। চিকিৎসকদের জিজ্ঞাসা করার সাহস নেই, এ ওষুধ কেন দিচ্ছেন? এটি না খেলে কী হবে? খেলে কী কী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে? কত দিন খেতে হবে? 

ঐশীর কথা মনে পড়ে

বিষণ্নতার চিকিৎসায় থাকা ঐশীর মৃত্যু নিয়ে তাঁর সাহসী মা–বাবা বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলে (বিএমডিসি) অভিযোগ করেছিলেন। অনেক চড়াই–উতরাই ডিঙিয়ে চিকিৎসকদের অবহেলা আর ক্রমাগত ভুল চিকিৎসার প্রমাণ পেয়েছে কাউন্সিল। এর জন্য ঐশীর মা–বাবাকে দীর্ঘ পাঁচ বছর অপেক্ষা আর চরম ধৈর্যের পরিচয় দিতে হয়েছে।

শেষ পর্যন্ত কাউন্সিল ২০১০ সালের আইনের আওতায় বিএমডিসি চিকিৎসক নুরুল আজিমের (সাবেক কর্নেল) রেজিস্ট্রেশন পাঁচ বছরের জন্য ও চিকিৎসক তানজিমা তাজরিনের এক বছরের জন্য স্থগিত করেছে, যা ২০২৪ সালের ২৮ জুন থেকে কার্যকর হয়েছে। এ সময়ে চিকিৎসক হিসেবে কোথাও চিকিৎসাসেবা দিতে পারবেন না তাঁরা।

এমনকি তাঁরা নিজেদের চিকিৎসক হিসেবেও পরিচয় দিতে পারবেন না। কাউন্সিল এ বিষয়ে এক গণবিজ্ঞপ্তিও জারি করেছে। (বিস্তারিত জানতে পড়ুন ‘মেয়েটির আত্মহত্যা নিয়ে বাবা-মায়ের অভিযোগই সত্য হলো’, প্রথম আলো, ১ জুলাই ২০২৪)

লাশের ময়নাতদন্ত হোক বা না হোক, বিষণ্নতার চিকিৎসা চলছিল—এমন ব্যক্তিদের আত্মহত্যার ঘটনার পর পুলিশের উচিত তাঁর প্রেসক্রিপশন ও ওষুধের তত্ত্বতালাশ করা। না হলে কোনো দিনও জানা যাবে না, ঘটানাগুলো স্রেফ আত্মহত্যা, না ওষুধ–উদ্‌গত আত্মহত্যা? 

গওহার নঈম ওয়ারা লেখক ও গবেষক

ই–মেইল: [email protected]

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

অভিযানসংক্রান্ত ভুল বোঝাবুঝি থেকে গাজায় চিকিৎসকদের হত্যা : আইডিএফ

অভিযানসংক্রান্ত ভুল বোঝাবুঝি থেকে গাজায় চিকিৎসকদের হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি ঘটেছে বলে জানিয়েছে ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্সেস (আইডিএফ)। তাদের তদন্তে বিষয়টি উঠে এসেছে। গত মাসে ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে গাজায় ১৫ জন চিকিৎসক নিহত হন।

ইসরায়েলি বাহিনী তদন্ত করে বলেছে, তাদের নির্দেশ সংক্রান্ত ভুল বোঝাবুঝি ও আদেশ লঙ্ঘনের কারণে এ ঘটনা ঘটে।

ইসরায়েল প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) এ ঘটনার তদন্তে বেশ কিছু ব্যর্থতার কথা উঠে এসেছে। তদন্তের সময় অসম্পূর্ণ এবং ভুল প্রতিবেদন দেওয়ার সঙ্গে জড়িত ইউনিটের ডেপুটি কমান্ডারকে বরখাস্ত করা হয়েছে।

গত ২৩শে মার্চ ফিলিস্তিনি রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির (পিআরসিএস) অ্যাম্বুলেন্স, জাতিসংঘের একটি গাড়ি এবং একটি ফায়ার সার্ভিস ট্রাকের একটি বহরে হামলা করে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। এতে জাতিসংঘের এক কর্মীসহ ১৫ জন নিহত হন।

এক বিবৃতিতে আইডিএফ জানিয়েছে, তাদের সৈন্যরা শত্রু বাহিনীর হুমকির সম্মুখিন হয়েছে ভেবে গুলি চালিয়েছে। তারা তদন্ত করে দেখেছে, নিহতদের মধ্যে ছয়জন হামাস সদস্য ছিলেন। সেখানে কোনো বাছবিচার ছাড়াই হত্যার বিচারের বিষয়টি অস্বীকার করেছে।

নিহতদের নাম প্রকাশ্যে থাকা সত্ত্বেও, হামাসের সঙ্গে তাদের কোনও সম্পৃক্ততার প্রমাণ তারা উপস্থাপন করতে পারেনি।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঘটনাটি প্রতিকূল এবং বিপজ্জনক যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে এলাকায় ঘটেছে অভিহিত করা হয়েছে এবং দ্রুতগতিতে যান এগিয়ে আসার পর ঘটনাস্থলে থাকা কমান্ডার তাৎক্ষণিক এবং স্পষ্ট হুমকি অনুভব করেছিলেন।

এ ছাড়া সেখানে যথেষ্ট আলো ছিল না বলেও আইডিএফ দাবি করেছে। তারা বলেছে, অ্যাম্বুলেন্স শনাক্ত করতে পারেনি তারা।

ইসরায়েল প্রথমে দাবি করেছিল, সন্দেহজনক গাড়ি অন্ধকারে আসতে দেখে সৈন্যরা গুলি চালিয়েছে । গাড়িতে হেডলাইট জ্বালানো ছিল না। এ ছাড়া গাড়ি চালানোর আগে অনুমতিও নেওয়া হয়নি।

ফিলিস্তিনি রেড ক্রিসেন্ট জানিয়েছে, তারা হামলায় নিহত চিকিৎসাকর্মী রিফাত রাদওয়ানের মুঠোফোন থেকে সম্পূর্ণ ভিডিওটি উদ্ধার করেছে। আইডিএফ তাঁকে হত্যা করে ছোট একটি গর্তে কবর দিয়ে দেয়।

রিফাত রাদওয়ানের ধারণ করা ভিডিওতে দেখা গেছে, রাতে সম্মুখ বাতি ও জরুরি ফ্লাশলাইট জ্বালিয়ে গাড়িতে করে যাচ্ছিলেন চিকিৎসাকর্মীদের ওই দল। এ সময় হাই-ভিউ জ্যাকেট পরে থাকায় কমপক্ষে একজন কর্মীকে হলেও দেখা যাওয়ার কথা।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী দাবি করেছিল, গাড়িতে থাকা ওই দলটির গতিবিধি সন্দেহজনক ছিল এবং তাঁরা গাড়ির বাতি নিভিয়ে অগ্রসর হচ্ছিল। কিন্তু রিফাত রাদওয়ানের করা ভিডিওটি প্রকাশিত হওয়ার পর সেনাবাহিনী তাদের বক্তব্য পরিবর্তন করে স্বীকার করেছে যে তাদের দাবি ভুল ছিল।

আরও পড়ুনগাজায় সেই চিকিৎসাকর্মীদের ওপর কাছ থেকে ১০০টির বেশি গুলি ছুড়েছে ইসরায়েলি বাহিনী: অডিও বিশ্লেষণের তথ্য১১ এপ্রিল ২০২৫

১৫ জন নিহত কর্মীর মৃতদেহ বালিতে পুঁতে রাখা হয়েছিল। ঘটনার এক সপ্তাহ পরেও তাদের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়নি। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো ওই এলাকায় নিরাপদে যাতায়াতের ব্যবস্থা করতে পারেনি বা ঘটনাস্থল সনাক্ত করতে পারেনি।
রেড ক্রিসেন্ট এবং আরও বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থা  এ ঘটনার স্বাধীন তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে।

এর আগে বিবিসি জানায়, গাজায় ১৫ জন চিকিৎসাকর্মীকে হত্যার সময় ইসরায়েলি সেনারা ১০০টিরও বেশি গুলি ছুড়েছে। এর মধ্যে কিছু গুলি মাত্র ১২ মিটার (৩৯ ফুট) দূর থেকে করা হয়েছে। একটি মুঠোফোনে ধারণ করা ভিডিওর ফরেনসিক অডিও বিশ্লেষণে এমনটি দেখা গেছে।

একজন কমান্ডারকে বরখাস্ত করা এবং অন্য একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে শাস্তি দেওয়ার আইডিএফের সিদ্ধান্ত অস্বাভাবিক নয় - গত বছরের এপ্রিলে ওয়ার্ল্ড সেন্ট্রাল কিচেনের সাতজন সাহায্য কর্মী নিহত হওয়ার পর সামরিক বাহিনী দুই কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করে এবং অন্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • অভিযানসংক্রান্ত ভুল বোঝাবুঝি থেকে গাজায় চিকিৎসকদের হত্যা : আইডিএফ