অন্তর্বর্তী সরকার অনুমোদিত সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ ২০২৪-এর খসড়ার সমালোচনা করেছে জাতীয় নাগরিক কমিটি। কমিটি বলেছে, পূর্বসূরি আইনগুলোর পুরোনো-ঔপনিবেশিক যুগের ধারণা উত্তরাধিকার সূত্রে এই খসড়ায় গ্রহণ করা হয়েছে। খসড়া নিয়ে থাকা উদ্বেগের সমাধান না হলে ক্ষমতার অপব্যবহার ও মৌলিক স্বাধীনতা লঙ্ঘনের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে। এ অবস্থায় অধ্যাদেশটি ঢেলে সাজানোর আহ্বান জানিয়েছে কমিটি।

গতকাল সোমবার রাতে জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখপাত্র সামান্তা শারমিনের পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব কথা বলা হয়। গত ২৪ ডিসেম্বর উপদেষ্টা পরিষদ অধ্যাদেশটির খসড়া অনুমোদন দেয়।

বিতর্কিত সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল ও সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ প্রণয়নের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে নাগরিক কমিটি। তবে কমিটি বলেছে, অনুমোদিত সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশের খসড়ার ব্যাপ্তি, উদ্দেশ্য ও অপব্যবহারের আশঙ্কা নিয়ে তারা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। এটি তার পূর্বসূরি আইনগুলো থেকে পুরোনো ও ঔপনিবেশিক যুগের ধারণাগুলোকে উত্তরাধিকার সূত্রে গ্রহণ করেছে।

নাগরিক কমিটি বলেছে, খসড়ায় ‘ধর্মীয় অনুভূতি বা মূল্যবোধ’ ও ‘অশ্লীল’-এর মতো শব্দের অন্তর্ভুক্তি ঔপনিবেশিক যুগের দণ্ডবিধি ১৮৬০ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া। এই শব্দগুলো বিস্তৃত ও ব্যক্তিপর্যায়ের ব্যাখ্যার সুযোগ দেবে। ধারার অপব্যবহারের পথ সুগম করবে। খসড়ায় ব্যবহৃত, ‘শৈল্পিক’ বা ‘শিক্ষাগত মূল্য’–সম্পর্কিত অস্পষ্ট ভাষা কার্টুনিস্ট, শিল্পী ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য কাজ করা অধিকারকর্মীদের জন্য বড় হুমকি তৈরি করবে, যা সৃজনশীলতা, ভিন্নমত প্রকাশ ও গঠনমূলক সমালোচনাকে দমন করতে পারে।

অধ্যাদেশের খসড়ার ৮ ধারায় বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনকে (বিটিআরসি) আধেয় (কনটেন্ট) ব্লকের ক্ষমতা দেওয়ার সমালোচনা করেছেন নাগরিক কমিটি। তারা বলেছে, বহু বছরের সমালোচনার পরও বিটিআরসির দায়িত্বের সঙ্গে একত্র করে জাতীয় সাইবার সুরক্ষা সংস্থার মহাপরিচালককে অতিরিক্ত ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। তিনি ‘অখণ্ডতা, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা, ধর্মীয় মূল্যবোধ বা জনশৃঙ্খলা ক্ষুণ্ন’ হওয়ার মতো অস্পষ্ট ভিত্তিতে বিষয়বস্তু ব্লক বা অপসারণের অনুরোধ করতে পারেন। এ শব্দগুলোর কোনো স্পষ্ট সংজ্ঞা না থাকায়, তা স্বেচ্ছাচারী সিদ্ধান্ত এবং সম্ভাব্য অপব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি করবে। এ ছাড়া অধ্যাদেশটি তথ্য ব্লক বা অপসারণ করার ক্ষেত্রে একটি স্বাধীন তদারকি ব্যবস্থা করতে ব্যর্থ হয়েছে।

নাগরিক কমিটি বলেছে, অধ্যাদেশের খসড়ায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে সন্দেহের ভিত্তিতে পরোয়ানা ছাড়া যেকোনো স্থানে প্রবেশ, তল্লাশি, জব্দ ও গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি আইন প্রয়োগকারী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ব্যবহারকারীর কাছ থেকে ট্রানজিট ডেটাসহ যেকোনো তথ্য চাওয়ার ক্ষমতা রাখে। এই বিধানগুলো সংবিধান দ্বারা প্রদত্ত গোপনীয়তার অধিকারের লঙ্ঘন করে। আইন প্রয়োগকারী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে ব্যাপক ক্ষমতা প্রদান করে। অতীতে এ ধরনের আইনের মাধ্যমে ক্ষমতার অপব্যবহার হয়েছে।

নাগরিক কমিটি আরও বলেছে, কম্পিউটার–সংক্রান্ত অপরাধ ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামোকে মতপ্রকাশসংক্রান্ত অপরাধের সঙ্গে এক করার মাধ্যমে অধ্যাদেশটি অনলাইন–জগতের ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে পার্থক্য নির্ধারণ করতে ব্যর্থ হয়েছে, যা আইনের উদ্দেশ্যকে দুর্বল ও অস্পষ্ট করে তোলে।

খসড়াটি পুনর্বিবেচনা করে একটি স্বচ্ছ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক আলোচনার মাধ্যমে আইন প্রণয়নের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে নাগরিক কমিটি। তারা বলেছে, অধ্যাদেশ প্রণয়নে নিযুক্ত পরামর্শকদের পরিচয় ও যোগ্যতা প্রকাশ করা উচিত, যাতে জনসাধারণের কাছে সরকারের জবাবদিহি নিশ্চিত হয়। মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে অগ্রাধিকার দিয়ে আন্তর্জাতিক সনদের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বিধান আইনে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন।

নাগরিক কমিটি বলেছে, সরকার প্রতিশ্রুতি দিলেও এখন পর্যন্ত ডিজিটাল নিরাপত্তা বা সাইবার নিরাপত্তা আইনের অধীন কোনো মামলাকে বাতিল বা নিষ্পত্তি করেনি। ভুক্তভোগীরা আজও ভোগান্তি পোহাচ্ছেন।

নাগরিক কমিটি বলেছে, পূর্বের আইন ও এই খসড়ার উদ্বেগগুলো সমাধান করতে ব্যর্থ হলে সেন্সরশিপের সংস্কৃতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, মৌলিক স্বাধীনতা লঙ্ঘনের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে। এটি জুলাই বিপ্লবের চেতনাকে সম্মান করতে ব্যর্থ হবে।

.

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

মানুষের মতো আইনগত অধিকার পেল নিউজিল্যান্ডের পাহাড়

মানুষের মতো আইনগত অধিকার পেল নিউজিল্যান্ডের একটি পাহাড়। বহু বছর পর এমন আইন প্রণয়ন করা হয়। এর মানে তারানাকি মাউঙ্গা (মাউন্ট তারানাকি) নিজের মালিকানা কার্যকরভাবে পাবে। এটি পরিচালনায় একসঙ্গে কাজ করবে স্থানীয় উপজাতি, ইউয়ি এবং সরকারের প্রতিনিধিরা। খবর বিবিসির

এই আইন প্রণয়নের লক্ষ্য উপনিবেশ আমলে তারানাকি অঞ্চলে ভূমি বাজেয়াপ্ত, অবিচারের শিকার হওয়া মাওরিরা ক্ষতিপূরণ দেওয়া।

আলোচনার জন্য সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী পল গোল্ডস্মিথ বলেছেন, ‘অতীতের ভুলের কারণে যে বেদনা রয়ে গেছে, তা আমাদের অবশ্যই স্বীকার করতে হবে। যাতে ইউয়িদের নিজস্ব আকাঙ্ক্ষা ও সম্ভাবনাকে উপলব্ধি করে তাদের ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে আমরা সহায়তা করতে পারি।’

গত বৃহস্পতিবার জীবন্ত সত্তা ঘোষণার তারানাকি মাউঙ্গা কালেক্টিভ রিড্রেস বিলটি নিউজিল্যান্ডের পার্লামেন্টে পাস হয়। তাতে পর্বতটি একটি আইনি নাম পেয়েছে এবং এর আশপাশের চূড়া ও জমিকে দেওয়া হয়েছে সুরক্ষা।

পর্বত, পূর্বপুরুষ, জীবিত প্রাণীসহ প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে যে মাওরি বিশ্বদর্শন রয়েছে, সেটির স্বীকৃতি মিলেছে বিলটি পাসের মধ্য দিয়ে।

রাজনৈতিক দল থে পাথি মাওরির (মাওরি পার্টি) সহ-নেতা ডেবি নারওয়ে-প্যাকা বলেন, ‘আমাদের মাউঙ্গা টুপুনা (পূর্বপুরুষের পর্বত) অবিচার, অজ্ঞতা ও ঘৃণার শৃঙ্খল থেকে আজ মুক্তি পেয়েছে।’

নারওয়ে প্যাকা নিউজিল্যান্ডের পশ্চিম উপকূলে আটজন তারানাকি ইউয়িদের মধ্যে একজন, যার কাছে পর্বতটি পবিত্র। এলাকাটির আরও শত শত মাওরি নাগরিক বৃহস্পতিবার পার্লামেন্টে উপস্থিত হয়েছিলেন বিলটির আইনি রূপান্তর দেখতে।

বিবিসি লিখেছে, পর্বতটি আর আনুষ্ঠানিকভাবে ‘এগমন্ট’ নামে পরিচিত হবে না, যে নামটি ১৮ শতকে দিয়েছিলেন ব্রিটিশ পরিব্রাজক জেমস কুক। এখন এটি ‘তারানাকি মাউঙ্গা’ নামে পরিচিত হবে। আর চারপাশ ঘিরে থাকা জাতীয় উদ্যানটিও পাবে মাওরি নাম।

যে চুক্তির মাধ্যমে নিউজিল্যান্ড একটি দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আদিবাসীরা জমি ও সম্পদের নির্দিষ্ট অধিকার পেয়েছিল; সেই ওয়েটাঙ্গি চুক্তি লঙ্ঘনের জন্য ক্ষতিপূরণের সর্বশেষ প্রয়াস তারানাকি মাউঙ্গা বন্দোবস্ত।

১৮৬০ এর দশকে তারানাকি পর্বত এবং স্থানীয় মাওরিদের কাছ থেকে ১০ লাখেরও বেশি একর জমি বাজেয়াপ্তের ঘটনায় সরকারের তরফে ক্ষমা প্রার্থনার অংশ হিসেবেও দেখা হচ্ছে এই বন্দোবস্তকে।

পল গোল্ডস্মিথ স্বীকার করেছেন যে, ‘চুক্তি লঙ্ঘনের অর্থ হল হোয়ানু (বৃহত্তর পরিবার), হাপু (উপ-উপজাতি) এবং তারানাকির ইউয়ির ব্যাপক পরিসরের ক্ষতি; যা বহু দশক ধরে অপূরণীয় হয়ে দাঁড়ায়।’

তিনি আরও বলেন, পর্বতটিতে প্রবেশাধিকার আর পরিবর্তন হবে না এবং নিউজিল্যান্ডের সব বাসিন্দা এই জায়গাটি পরিদর্শন করতে পারবে এবং আগামী প্রজন্ম সবচেয়ে দুর্দান্ত এ জায়গাটি উপভোগ করতে পারবে। 

নিউজিল্যান্ডে এর আগেও প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের জীবন্ত সত্তার স্বীকৃতি পাওয়ার নজির রয়েছে। ২০১৪ সালে উরেওয়েরা বন প্রথম এই জাতীয় মর্যাদা অর্জন পায়। এরপর ২০১৭ সালে এমন স্বীকৃতি পায় হোয়াংগানুই নদী।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • মানুষের মতো আইনগত অধিকার পেল নিউজিল্যান্ডের পাহাড়