ভারত থেকে ১১০০ কোটি টাকার ডিজেল আমদানি করছে বাংলাদেশ
Published: 14th, January 2025 GMT
জুলাই গণঅভ্যুত্থান ও ভারত-বাংলাদেশের মধ্যকার সীমান্ত উত্তেজনা চললেও বাণিজ্যিক স্থিতিশীলতা লক্ষ্য করা গেছে দুই দেশের মাঝে। দেশটি থেকে ডিজেল আমদানি অব্যাহত রেখেছে বাংলাদেশ। সম্প্রতি অনুমোদিত এক সিদ্ধান্তের আলোকে শিগগিরই ভারত থেকে ১ লাখ ৩০ হাজার মেট্রিক টন ডিজেল আমদানি করবে বাংলাদেশ। এতে খরচ হবে ১ হাজার ১৩৭ কোটি টাকা।
মঙ্গলবার এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম টাইমস অব ইন্ডিয়া।
টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রোববার বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) পরিচালনা পর্ষদের সভায় ভারতের নুমালিগড় রিফাইনারি লিমিটেড (এনআরএল) থেকে ১ লাখ ৩০ হাজার মেট্রিক টন ডিজেল আমদানির সিদ্ধান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে এই ডিজেল আমদানি করা হবে।
এ বছর বিপিসির পরিশোধিত জ্বালানি তেলের চাহিদা ৭৪ লাখ মেট্রিক টন। এর মধ্যে ৪৬ লাখ টন ডিজেল, যার ৮০ শতাংশই সরাসরি আমদানি করা হয়ে থাকে। আর বাকি অংশ স্থানীয় শোধনাগার থেকে পাওয়া যায়। মূলত বিপিসি নিয়মিতভাবে ভারতের নুমালিগড় রিফাইনারি লিমিটেড (এনআরএল) থেকে পরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করে থাকে। ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে এই তেল ট্রেনে করে বাংলাদেশে আসছে।
এর আগে অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে ভারত থেকে ৫০ হাজার টন অ-বাসমতি সিদ্ধ চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
.উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
কৃষকের ফসল গেল, জীবনও গেল...
সাইফুল শেখের পরিবারকে দেখতে আমরা মুজিবনগর ভবেরপাড়া গ্রামে যাই। এক জীর্ণ মাটির ঘর। কৃষক সাইফুল শেখ কয়েক দিন আগেই চাষে লোকসান আর ঋণের ভার সইতে না পেরে আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন।
মা রমেসা খাতুন হাহাকার করে কেঁদে উঠলেন– ‘আমার ছেইলে, আমার পাখি তো আর নাই রে বাবু!’ পক্ষাঘাতগ্রস্ত, চলাফেরায় অক্ষম সাইফুল শেখের স্ত্রী হতবিহ্বল সোনাভানু একবার কথা বলেন আবার চুপ হয়ে যান। পেঁয়াজ, কচু চাষ করে, বর্গার গরু-ছাগল পালন করে জীবিকা নির্বাহ করতেন সাইফুল শেখ। কন্যা রোজেফাকে খুব আগ্রহে পড়াশোনায় উৎসাহ দিতেন। বিষপানের দু’দিন আগে তাকেই বলছিলেন ধারদেনা, লোকসান আর হতাশার কথা।
২৫ মার্চ প্রতিদিনের মতো মাঠে গিয়েছিলেন তিনি। বিকেলে বাড়ি ফিরেই হঠাৎ বমি করে ফেলেন। বমি থেকে অস্বাভাবিক গন্ধ পেয়ে জানতে চাইলে কচুক্ষেতে ব্যবহার্য বিষ পান করেছেন বলে জানান তিনি। দু’দিন ধরে এই হাসপাতাল ওই হাসপাতাল করেও শেষ রক্ষা হয়নি। ২৭ মার্চ চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান কৃষক সাইফুল শেখ।
তাঁর স্ত্রী, মা ও মেয়ে এখন আর কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না। শোক বড়; হঠাৎ ফাঁকা হয়ে যাওয়া সংসারটাও বড়। তার চেয়েও বড় আগামীকালের ভাতের দুশ্চিন্তা। একদিকে পরিবারের চরম অনিরাপত্তা, অন্যদিকে ক্ষুদ্রঋণ, সারের ডিলার, বর্গার জমি আর মুদি দোকানের ঋণের মতো নানাবিধ চাপ। বর্গা জমি, ধারে সার, কীটনাশক, ছত্রাকনাশকের ব্যবস্থা, ঋণ নিয়ে শ্রমিকের মজুরি, চাষ-সেচের খরচ, ফসল ওঠা পর্যন্ত সংসার চালাতে বিবিধ ধারদেনা, তারপর ফসলের দাম না পাওয়া, ঋণ পরিশোধের চাপ– এগুলো আমাদের প্রান্তিক কৃষকের জন্য চক্রাকারে চলতে থাকে। আমরা যখন সাইফুল শেখের বাড়ি থেকে ফিরছি, তখন জানা গেল রাজশাহীর বাঘায় আরও একজন কৃষক চলন্ত ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। তিনিও ঋণের দায় ও লোকসানের চাপে ছিলেন।
এসব মৃত্যু কেবল এক ব্যক্তির নয়, বরং একটি কাঠামোর ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি। যেখানে কৃষকের ঋণের হিসাব মেলে না, সেখানে ফসল ফলানো মানেই অনিশ্চয়তার আতঙ্ক। লোকসানের ধসেই ভেঙে পড়েছে সাইফুল শেখের গোটা পৃথিবী; সঙ্গে তাঁর পরিবারের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ। কথাটি শুনতে হয়তো পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তির জন্য এক রকমের স্বার্থপরতাই শোনায়, কিন্তু বাংলাদেশের বহু প্রান্তিক পরিবারের পরম্পরায় পরিবারের প্রধান পুরুষের ওপরে সবার এই নির্ভরতা সত্য। অপরিবর্তনীয় সত্য হলো, এই বাড়ির বাকি প্রত্যেক সদস্যই নারী। মা রমেসা বেগম কিংবা রোজেফা খাতুন যেভাবে বলতে পেরেছেন সাইফুল শেখ কী খেতে পছন্দ করতেন, কখন কাজে যেতেন, কখন ফিরতেন; সেভাবে বলতে পারেননি বর্গার এক বিঘা জমিটুকু ঠিক কত টাকায় বর্গা নেওয়া। তাদের না বোঝার আছে নিজের জমির খতিয়ান। না চেনেন বর্গা জমির মালিককে; না আছে কৃষিঋণের ভাষা বোঝার জ্ঞান; না আছে বাজারে দরদাম বোঝার সুযোগ। নারী হয়ে, গরিব হয়ে, প্রান্তিক গ্রামে থেকে তারা তিন গুণ ভঙ্গুর হয়ে পড়েছেন এই দুনিয়ার চোখে। তাদের দিন ও রাত এখন শুধুই শোক আর সংগ্রামের নাম।
আমাদের জানার ছিল, সাইফুল শেখ কেন আত্মহত্যা করলেন? কিন্তু ভবেরপাড়া থেকে ফিরে এসে আমাদের আজকের প্রশ্ন, আসলে সাইফুল শেখকে আমরা কেন বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখাতে পারিনি? ফসলের দাম ওঠানামা করে। জীবনও কি তা-ই করবে? সাইফুল শেখ কি আর কখনও ফিরবেন? তিনি জীবিকার জন্য কৃষিকাজ করছিলেন, নাকি অনিশ্চিত মূল্য তাঁর আত্মহত্যার জন্য জমি প্রস্তুত করছিলেন! লোকসান হলে কৃষক মরে। লাভ তাহলে কার ঘরে যায়?
আমার স্মৃতিতে একটা কোদাল আর একটি ছবি পড়ে আছে সাইফুল শেখের বাড়ি। কেউ আর সেই কোদাল নিয়ে ক্ষেতে বেরোবে না; ছেলেকে ক্ষেত থেকে ফিরে আসতে দেখে রমেসা খাতুন বলে উঠবেন না– ‘বাবা আইছো?’ রাষ্ট্র এই শূন্যতা, অসহায়ত্ব বোঝে কিনা; জানি না। তবে এই গল্প কেবল সাইফুল শেখের গল্প নয়; এটি আমাদের কৃষকের গল্প। একটি দেশের আত্মার ক্ষয় হয়ে যাওয়ার গল্প।
এখন সিদ্ধান্ত আমাদের। আমরা কী শুনতে চাই? আত্মহত্যায় কৃষকের মৃত্যুর খবর? রোজেফা, রমেসা, সোনাভানুদের হাহাকার! নাকি কৃষক বাঁচাতে, দেশের কৃষি বাঁচাতে কৃষকের চাওয়া?
দুর্দশা বা দরকারের কথা কে শুনবে; কৃষক কোথায় বলবে? সেই পথ কি আমরা তৈরি করছি?
উম্মে সালমা: উন্নয়নকর্মী
ummesalmapopi@gmail.com