চার লেন মহাসড়ক: রাতারাতি উঠছে ‘তাসের ঘর’
Published: 14th, January 2025 GMT
পোঁতা হয়েছে বাঁশের খুঁটি, কড়ি–বর্গায় লেগেছে কাঠের পাতলা ফালি, চাল আর বেড়ায় দেওয়া হয়েছে পাতলা টিন। কম দামি এসব উপকরণ দিয়ে রাস্তার দুই পাশে রাতারাতি উঠছে একের পর এক দোকানঘর। দেখলেই মনে হবে, এ যেন ‘তাসের ঘর’। সামান্য বাতাসেই ভেঙে পড়বে।
কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া আঞ্চলিক মহাসড়কের কুমিল্লা সেনানিবাস এলাকা থেকে বুড়িচং উপজেলার অংশে ঢুকতেই এমন অনেক ঘর চোখে পড়বে। দুই লেনের সড়কটি চার লেন করা হবে। সম্প্রতি প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু করেছে জেলা প্রশাসন। এরপর থেকেই সড়কের দুই পাশে এমন পলকা ঘর তোলার হিড়িক পড়েছে।
অতীতে দেখা গেছে, এভাবে স্থাপনা নির্মাণ করে মোটা অঙ্কের অর্থ লোপাট করা হয়েছে। জমি অধিগ্রহণের সময় অসাধু ও সুযোগসন্ধানী লোকেরা চেষ্টা করেন অর্থ লুটের জন্য। এই ধারাবাহিকতা বন্ধ করতে হলে এখন থেকেই প্রশাসনকে কঠোর হতে হবে। আলী আকবর মাসুম, সাবেক সভাপতি, সনাক, কুমিল্লাস্থানীয় প্রশাসন ও বাসিন্দারা বলছেন, এসব ঘর তোলার আসল উদ্দেশ্য ব্যবসা নয়; ফাঁকা জায়গায় বাণিজ্যিক স্থাপনা দেখিয়ে সরকারের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেওয়া। মূলত অধিগ্রহণ করা জমিতে বাণিজ্যিক স্থাপনা হলে সরকার বেশি ক্ষতিপূরণ দেয়। একশ্রেণির দালাল চক্র স্থানীয় লোকজনকে এ কাজে উদ্বুদ্ধ করছে বলে জানা গেছে।
এভাবে রাতারাতি দোকান তুলেও লাভ হবে না বলে জানিয়েছেন কুমিল্লার জেলা প্রশাসক মো.
বর্তমানে অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে উল্লেখ করে জেলা প্রশাসক আরও বলেন, ‘আমরা পূর্বের অবস্থার বাইরে বাড়তি কোনো টাকা দেব না।’
সড়ক ও জনপথ বিভাগ (সওজ) সূত্র জানায়, ২০২২ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া আঞ্চলিক মহাসড়ক ছয় লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্পটি অনুমোদিত হয়। মূল মহাসড়কটি হবে চার লেনের। ধীরগতির যানবাহন চলাচলের জন্য দুই পাশে থাকবে সার্ভিস লেন। কুমিল্লা সেনানিবাস এলাকার ময়নামতি থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ধরখার পর্যন্ত ৫৪ কিলোমিটার আঞ্চলিক মহাসড়কের প্রায় ৪০ কিলোমিটার অংশ পড়েছে কুমিল্লা জেলায়। সড়কটি এখন ১৮ ফুট চওড়া। চার লেন হলে এটি প্রস্থে ৬০ ফুট হবে। প্রকল্পটির বাস্তবায়ন ব্যয় ধরা হয়েছে ৭ হাজার ১৮৮ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। ২০২২ সালেই প্রকল্পের কাজ শুরু হয়ে ২০২৬ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা। তবে নানা জটিলতায় প্রকল্পের কাজ এখনো শুরুই হয়নি। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে কুমিল্লা ও চট্টগ্রামের সঙ্গে সিলেটের যোগাযোগ মসৃণ হবে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
৫ জানুয়ারি সকালে মহাসড়কের বুড়িচং উপজেলার রামপাল এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, মহাসড়কের পশ্চিম পাশে বেশ কয়েকটি বড় দোকানঘর উঠেছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, খালি জায়গায় কয়েক দিন আগে টিন দিয়ে এসব ঘর তোলা হয়েছে। এখনো মেঝে সমান করা হয়নি। ‘সর্দার মার্কেট ও সরদার ফার্নিচার’ নাম দিয়ে এসব দোকানে বালুর মেঝেতে রাখা হয়েছে কয়েকটি আসবাব।
স্থানীয় বাসিন্দা আবুল কালাম সর্দার ও তাঁর ভাই হারুনুর রশিদ সর্দার এসব ঘর তুলেছেন। জানতে চাইলে আবুল কালাম সর্দার প্রথম আলোকে বলেন, ‘মহাসড়কের পশ্চিম পাশে আমাদের ৬০ শতক জমি আছে। সেখানেই এসব দোকান নির্মাণ করেছি কিছুদিন আগে। এখন শুনছি এসব জায়গা অধিগ্রহণ হবে। আমাদের ডিসি অফিস থেকে চিঠিও দিয়েছে। সরকারের দরকার হলে সরকার নেবে, আর না হলে আমরা এসব দোকানে ব্যবসা করব।’ কোনো খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে দোকান নির্মাণ করেননি বলে দাবি করেন এই ব্যবসায়ী।
উপজেলার দেবপুর এলাকায় দেখা গেছে, সম্প্রতি ভরাট হওয়া একটি ডোবার মধ্যে বাঁশ ও কাঠ দিয়ে দোকানঘর তোলার কাজ চলছে। সেখানে ঘর তুলছেন দেবপুর গ্রামের বাসিন্দা শাকিল। তবে ঘটনাস্থলে তাঁকে পাওয়া যায়নি। ঘর নির্মাণের কাজ করা রুহুল আমিন ও সুজন বলেন, শাকিল তাঁদের দোকানঘর নির্মাণের কাজ দিয়েছেন।
অনেকে পুরোনো বাড়িকেও বাণিজ্যিক স্থাপনা হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ফরিজপুর এলাকায় মহাসড়কের পূর্ব পাশের মিজানুর রহমানের বাড়িটি ‘হাবিব মঞ্জিল’ নামে পরিচিত। তিনতলা ভবনটির নিচতলার সামনের অংশ সম্প্রতি ভেঙে শাটার লাগিয়ে সাইনবোর্ডে লেখা হয়েছে ‘হাবিব মার্কেট’।
জানতে চাইলে মিজানুর রহমান বলেন, ‘দোকানের ভাড়া বেশি। তাই নিচতলায় সম্পূর্ণ দোকান করা হয়েছে। এখানে আগেও দোকান ছিল। আমরা নাম পরিবর্তন করেছি দোকান ভাড়া দেওয়ার জন্যই।’
একই এলাকায় মহাসড়কের পশ্চিমপাশে কাঠ ও বাঁশ দিয়ে বড় আকৃতির দোকান তুলছেন স্থানীয় বাসিন্দা আরিফুর রহমান। তবে এ বিষয়ে বারবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।
সম্প্রতি সরেজমিনে বুড়িচং উপজেলার ফরিজপুর, দেবপুর, ময়নামতি, কংসনগর, দেবীদ্বারের জাফরগঞ্জসহ বিভিন্ন স্থানে ঘুরে এমন অন্তত ৩০টি স্থাপনা দেখা গেছে। কোথাও কোথাও মহাসড়কের দুই পাশে আধা পাকা ও টিনশেড ঘর নির্মাণ করে রাখা হয়েছে। পুরো মহাসড়কের অন্যান্য স্থানেও একই অবস্থা।
দালাল চক্র মানুষকে মোটা অঙ্কের টাকা পাইয়ে দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে এসব স্থাপনা নির্মাণ করাচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন দেবপুর বাজারের প্রবীণ ব্যবসায়ী আবদুর রহিম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার দোকানটি টিনশেডের। আমাকে প্রস্তাব দিয়েছে ওপরে ছাদ করার জন্য। এতে নাকি প্রচুর টাকা পাব; কিন্তু আমি বলেছি, কোনো অন্যায় করব না। মূলত অধিগ্রহণ করা জমিতে বাণিজ্যিক স্থাপনা হলে সরকার বেশি ক্ষতিপূরণ দেয়। এ জন্য এভাবে দোকানঘর নির্মাণের হিড়িক পড়েছে।’
সওজ কুমিল্লার উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মোহাম্মদ সফিকুল ইসলাম ভূঁঞা প্রথম আলোকে বলেন, একনেকে পাস হওয়া প্রকল্পটির কাজ এখনো শুরু হয়নি। বর্তমানে প্রকল্পের ঠিকাদার চূড়ান্ত করার প্রক্রিয়া চলছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যেই কাজটি শুরু হবে বলে তাঁরা আশা করছেন। অধিগ্রহণের পুরো বিষয়টি দেখছে জেলা প্রশাসন।
সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) কুমিল্লার সাবেক সভাপতি আলী আকবর মাসুম প্রথম আলোকে বলেন, অতীতে দেখা গেছে, এভাবে স্থাপনা নির্মাণ করে মোটা অঙ্কের অর্থ লোপাট করা হয়েছে। জমি অধিগ্রহণের সময় অসাধু ও সুযোগসন্ধানী লোকেরা চেষ্টা করেন অর্থ লুটের জন্য। অনেক সময় প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরাও ঠিকভাবে ক্ষতিপূরণ পান না। এই ধারাবাহিকতা বন্ধ করতে হলে এখন থেকেই প্রশাসনকে কঠোর হতে হবে।
উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
দুর্ঘটনায় আহত অভিনেত্রী খুশি, চোখের ওপর পড়েছে ১০ সেলাই
দুর্ঘটনার শিকার হয়ে গুরুতর আহত হয়েছেন ছোটপর্দার অভিনেত্রী শাহনাজ খুশি। বুধবার সকালে রমনা পার্ক থেকে বাড়ি ফেরার সময় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার ধাক্কায় তিনি আহত হন। অভিনেত্রীর ছেলে সৌম্য জ্যোতি সমকালকে বিষয়টি জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, বুধবার সকালে আম্মু রমনা পার্কে হাটতে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে বাসায় ফেরার সময় গলির মধ্যে একটি অটোরিকশা তাকে ধাক্কা দিলে আম্মু ছিটকে পড়ে যায় এবং তার ঠিক চোখের ওপর জখম হয়। পরে দ্রুত তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। সিটি স্ক্যানসহ বিভিন্ন পরীক্ষা করা হয়েছে। এখন তিনি আপাতত ভালো আছেন।’
এদিকে কিছুটা সুস্থ হওয়ার পর শুক্রবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দুর্ঘটনার বিষয়টি জানান শাহনাজ খুশি। সেখানে তিনি বলেন, ‘বেশি না, মাত্র ১০টা সেলাই পড়েছে। এ আর এমন কি বলেন? চোখটা অন্ধ হয় নাই, হয় নাই ব্রেইন হ্যামারেজের মত শেষ অবস্থা! সেটাই তো অনেক বেশি পাওয়া! এ তেমন কিছু না, চোখের উপরের সেনসেটিভ জায়গায় মাত্র ১০ টা সেলাই লেগেছে! আমি যে প্রাণে বেঁচে আছি এ জন্য মহান সৃষ্টিকর্তা কাছে শুকরিয়া আদায় করছি!’
তিনি আরও লিখেছেন, ‘কিচ্ছু চাই না আমি, শুধু যে মায়েরা/বাবারা ছোট্ট বাচ্চাটার হাত ধরে রাস্তা পার হয়ে স্কুলে আসেন অথবা নানান প্রয়োজনে রাস্তায় যান, তাদের সতর্ক করতে পোস্টটা দিলাম। আমি হয়ত ভেঙেচুরে বেঁচে গেছি। কোন বাচ্চা এ আঘাত নিতে পারবে না! ব্যাটারি চালিত অসভ্য/বর্বর যানবাহনটি এবং তার অসভ্য চালক থেকে সর্বদা সতর্ক থাকবেন। যদিও আমি গলির ভেতরের রাস্তায়, প্রাতঃ ভ্রমণ শেষে অতি সর্তকতার সাথেই একেবারে কিনার দিয়ে হেঁটে ফিরছিলাম! ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে বীরদর্পে চলে গেছে! ওরা মেধাবী যান চালক, কারো জীবনের ক্ষতির তোয়াক্কা করে না! আপনার এবং আপনার সন্তানের দায়িত্ব একান্তই আপনার। আজ চারদিন পরও মাথার অর্ধেকে কোন বোধশক্তি নাই!
সবশেষে তিনি লিখেছেন, ‘জানি না স্বাভাবিক চেহারায় ফিরবো কিনা, সেটা যদিও ফিরি রক্তাক্ত সেই পথে পড়ে থাকা সকালের ট্রমা অনেককাল ভুলবো না! কাতর অবস্থায় বিছানায় পরে থেকে বারবার একটা প্রশ্ন মনে আসছে, এই যে যত্রতত্র কুপিয়ে জখম, ট্রেন-বাস, রিকশা কিংবা প্রাইভেট গাড়িতে দিনেরাতে ছিনতাই। কার কাছে চাইব আমাদের সন্তানদের নিরাপদ পথচলা।’