নতুন একটি পাখির সন্ধানে ‘বার্ডিংবিডি ট্যুরস’-এর তত্ত্বাবধানে ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ রাতে কক্সবাজারের উদ্দেশে রওনা হলাম। সকালে কক্সবাজার জেটিঘাটে পৌঁছেই নূরুল আফসারের স্পিডবোট সোনাদিয়ার দিকে ছোটালাম। চলার পথে প্রথমেই পাখিগুলোকে মহেশখালী চ্যানেলে খুঁজলাম। কিন্তু পেলাম না। এরপর সৈকত পাখির আসল আস্তানা কালাদিয়া চরের দিকে গেলাম।
সকাল ১০টায় যখন ওখানে পৌঁছালাম, তখন ভাটা শুরু হয়ে গেছে। জোয়ারের পানি নামার সঙ্গে সঙ্গে নোনাজলের ভেতর থেকে উঁকি মারছে টুকরা টুকরা বালুচর। চরের কাছাকাছি এসে চার-পাঁচ শ সৈকত পাখিকে সদ্য জেগে ওঠা বালুচরে খাদ্যের সন্ধান করতে দেখলাম। স্পিডবোট থেকে হাঁটুপানিতে নেমে ধীরে ধীরে ওদের দিকে এগোতে থাকলাম। খানিকটা এগোচ্ছি আর থেমে থেমে ক্লিক করছি। পাখি ও আমাদের মধ্যে নিরাপদ দূরত্বসীমা অতিক্রম করামাত্রই ওরা উড়ে আকাশে চক্কর মেরে পাশের ক্ষুদ্র চরে গিয়ে বসল।
এভাবে ঘণ্টাখানেক পাখিগুলোর পেছনে ঘুরে ১০ প্রজাতির ছবি তুললাম। তাদের মধ্যে বেশ কিছু জিরিয়াকে অন্য রকম লাগল। হঠাৎ দেখায় নতুন প্রজাতি বলে ভুল হলো। ওদের মুখমণ্ডল হয়ে দেহের নিচটা, বিশেষত পেটের অংশ, কুচকুচে কালো। ডজনখানেক বড় আকারের জিরিয়ার প্রায় অর্ধেকেই এ রকম। বাকিগুলো ধূসর, যাদের দেখেই বুঝতে পারলাম কালচে পাখিগুলো এখনো প্রজনন পালকে রয়েছে। সচরাচর আমরা সোনাদিয়ায় ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারির মধ্যে আসি। তখন পাখিগুলোর প্রজনন পালক ফিকে হয়ে যায়। এবার যেহেতু সেপ্টেম্বরে এসেছি, তাই সদ্য আসা পাখির অনেকগুলোকেই প্রজনন পালকে দেখতে পাচ্ছি। দিন যত এগোবে, ততই ওদের রং ফ্যাকাশে হতে থাকবে।
কালাদিয়া চরে প্রজনন পালকে দেখা পাখিগুলো এ দেশের সচরাচর দৃশ্যমান শীতের পরিযায়ী পাখি মেটে বা বড় জিরিয়া–বাটান। পশ্চিমবঙ্গে মোতি বাটান নামে পরিচিত। ইংরেজি নাম গ্রে–ব্ল্যাক-বেলিড প্লোভার। চ্যারাড্রিইডি গোত্রের পাখিটির বৈজ্ঞানিক নাম Pluvialis squatarola। যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা ও ভুটান বাদে এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ওদের বৈশ্বিক বিস্তৃতি রয়েছে।
প্রাপ্তবয়স্ক পাখির দৈর্ঘ্য ২৭ থেকে ৩১ সেন্টিমিটার। ওজন ১৬৫ থেকে ৩৯৫ গ্রাম। প্রজননকালে দেহের ওপরের পালক ধূসর বা ছাইবর্ণ হয়; তার ওপর থাকে ছোট ছোট মুক্তোর দানার মতো সাদা ফোঁটা। মুখমণ্ডল, গলা, বুক ও পেট হয় কালো। কপালের ওপর থেকে গলা বেয়ে একটি সাদা পট্টি ডানার গোড়ায় এসে শেষ হয়। লেজতল সাদা ও লেজের ডগায় থাকে ধূসর বন্ধনী। ওড়ার সময় ডানার নিচের বড় কালো ছোপ ও ‘ভি’ আকারের সাদা দাগ চোখে পড়ে। চোখের রং কালো। চঞ্চু, পা ও পায়ের পাতা কালচে। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম। প্রজননকাল বাদে বাকি সময় দেহতলের এই কালো রং থাকে না।
শীতকালে চট্টগ্রাম ও খুলনা বিভাগের উপকূল বরাবর এবং সিলেট ও রাজশাহী বিভাগের জলাভূমি ও নদীতে ওদের দেখা মেলে। দিবাচর ও জলচর পাখিগুলো ছোট থেকে বড় একক বা অন্য সৈকত পাখির সঙ্গে মিশ্র দলে বিচরণ করে। উপকূলের সৈকত বা নদী ও জলাশয়ের তীরে অথবা জোয়ার-ভাটার ডুবোচরে নরম কাদায় চঞ্চু ঢুকিয়ে খুদে শামুক, কাঁকড়া, পোকামাকড়, চিংড়ি ইত্যাদি খুঁজে খায়। কখনো কখনো বীজ ও গাছের কাণ্ডও খেতে পারে। সচরাচর ওড়ার সময় ‘পিইই-উ-ইই—-’ শব্দে ডাকে।
মে থেকে জুনের মাঝামাঝি প্রজননকাল। এ সময় উত্তর মেরুর মরুভূমি ও তুন্দ্রা অঞ্চলের উদ্ভিদ ঢাকা মাটিতে সামান্য গর্ত করে নুড়ি পাথর, শৈবাল ইত্যাদি দিয়ে স্ত্রী পাখি বাসা বানায় ও তাতে চারটি শক্ত খোসাযুক্ত ডিম পাড়ে। ডিমের রং কালো বা গাঢ় বেগুনি-ধূসর দাগ–ছোপসহ গোলাপি, সবুজ বা বাদামি। স্ত্রী-পুরুষ মিলেমিশে ডিমে তা দিলেও এ ক্ষেত্রে পুরুষের ভূমিকাই বেশি। ডিম ফোটে ২৬ থেকে ২৭ দিনে। আর্দ্র এলাকায় স্ত্রী-পুরুষ মিলেমিশে ২ থেকে ৩ সপ্তাহ ছানাদের লালন–পালন করে। ছানারা প্রায় ২৩ দিন বয়সে উড়তে শেখে। আয়ুষ্কাল প্রায় ছয় বছর।
আ ন ম আমিনুর রহমান, পাখি ও বন্য প্রাণী প্রজনন ও চিকিৎসাবিশেষজ্ঞ
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
স্বাদুপানির মাছ কমে যাচ্ছে: প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্র কি টিকে থাকবে
‘নদীমাতৃক বাংলাদেশ’ শব্দবন্ধটি একসময় শুধু পাঠ্যবইয়ের বুলি ছিল না, ছিল আমাদের যাপিত জীবনের প্রতিচ্ছবি। বর্ষায় থই থই করা বিলে মাছের দাপাদাপি, জলের রুপালি ফসলে জেলের মুখে হাসি, আর পাতে ভাপে সেদ্ধ বা ঝোল করা দেশি মাছের স্বাদ—বাঙালির সংস্কৃতির এই অবিচ্ছেদ্য অংশটি আজ হুমকির মুখে।
আমাদের স্বাদুপানির মাছ বা দেশি মাছের ভান্ডার আজ আশঙ্কাজনক হারে ফুরিয়ে যাচ্ছে; কিন্তু প্রশ্ন হলো, এটি কি কেবলই আমাদের রসনার তৃপ্তি বা আমিষের অভাব? নাকি এর পেছনে লুকিয়ে আছে এক ভয়াবহ পরিবেশগত বিপর্যয়?
হারিয়ে যাওয়া শৈশব ও বর্তমান বাস্তবতাবেশি দিন আগের কথা নয়, গ্রামবাংলার খাল-বিল, হাওর-বাঁওড় ছিল দেশি মাছের প্রজননক্ষেত্র। পাবদা, ট্যাংরা, পুঁটি, খলিসা, মলা, ঢেলা, শোল, গজার নামগুলো বলে শেষ করা যাবে না।
আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘের (আইইউসিএন) তথ্যমতে, বাংলাদেশে প্রায় ২৬০ প্রজাতির স্বাদুপানির মাছ ছিল; কিন্তু বর্তমানে এর একটি বিশাল অংশ বিপন্ন, অতি বিপন্ন অথবা বিলুপ্তির পথে।
আমরা এখন বাজারে যে মাছ দেখি, তার বড় অংশই চাষের—পাঙাশ, তেলাপিয়া কিংবা হাইব্রিড কই। এই মাছগুলো আমাদের আমিষের চাহিদা মেটাচ্ছে সত্য; কিন্তু প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো মাছের যে অভাব তৈরি হয়েছে, তা কোনোভাবেই পূরণীয় নয়।
কেন এই বিষণ্নতামাছ কমে যাওয়ার পেছনে একক কোনো কারণ নেই; বরং এটি মানুষের অপরিণামদর্শী কর্মকাণ্ডের সমষ্টিগত ফল। উন্নয়নের নামে নদী, খাল ও বিল ভরাট করে তৈরি হচ্ছে আবাসন বা শিল্পকারখানা। মাছের প্রাকৃতিক প্রজননক্ষেত্র বা ‘নার্সারি গ্রাউন্ড’ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। আবার কলকারখানার অপরিশোধিত বর্জ্য ও কৃষিজমিতে ব্যবহৃত মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে জলাশয়ে মিশছে। এতে পানি বিষাক্ত হয়ে মাছের বেঁচে থাকা অসম্ভব করে তুলছে।
কারেন্ট জালের ব্যবহার এবং প্রজনন মৌসুমে মা মাছ ও পোনা মাছ নিধন মাছের বংশবিস্তারে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তা ছাড়া বাংলাদেশের অস্থিতিশীল আবহাওয়া মাছের প্রজননে প্রভাব ফেলছে। অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, খরা ও তাপমাত্রার পরিবর্তন মাছের প্রজনন চক্রকে ব্যাহত করছে।
প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্র কি টিকে থাকবেএখন মূল প্রশ্ন এখানেই—মাছ কমে গেলে পরিবেশের কী এমন ক্ষতি হবে? উত্তর হলো চরম বিপর্যয় ঘটবে।
খাদ্যশৃঙ্খলে ধস: স্বাদুপানির মাছ কেবল মানুষের খাদ্য নয়, এটি জলজ বাস্তুতন্ত্রের খাদ্যশৃঙ্খলের একটি অপরিহার্য অংশ। মাছ কমে গেলে মাছরাঙা, বক, চিল, পানকৌড়ি এবং ভোঁদড়ের মতো প্রাণী খাদ্যসংকটে পড়ে। ইতিমধ্যে গ্রামবাংলা থেকে অনেক মাছশিকারি পাখি বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
পানির গুণ রক্ষা: অনেক প্রজাতির মাছ (যেমন আবর্জনাভুক মাছ) পানি পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে। এরা পচনশীল দ্রব্য খেয়ে জলাশয়ের স্বাস্থ্য রক্ষা করে। মাছ না থাকলে জলাশয়গুলো দ্রুত দূষিত হবে এবং মশা-মাছির উপদ্রব বাড়বে।
বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য: জলজ উদ্ভিদের বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ এবং প্লাঙ্কটনের ভারসাম্য রক্ষায় মাছের ভূমিকা অপরিসীম। মাছের অভাব পুরো জলজ পরিবেশকে মৃতপ্রায় বা ডেড জোনে পরিণত করতে পারে।
সুতরাং মাছ কমে যাওয়া মানে কেবল খাবারের প্লেটে সংকট নয়; বরং পুরো প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্র বা ইকোসিস্টেম ভেঙে পড়ার সতর্কবার্তা।
অর্থনৈতিক ও পুষ্টির সংকটগ্রামের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পুষ্টির, বিশেষ করে ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন এ–এর প্রধান উৎস ছিল ছোট মাছ। এই মাছগুলো হারিয়ে যাওয়ায় গ্রামীণ জনস্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এ ছাড়া যারা বংশপরম্পরায় জেলে পেশায় জড়িত, নদীতে মাছ না পেয়ে তাঁরা আজ বেকার। বাধ্য হয়ে তাঁরা পেশা পরিবর্তন করছেন, যা গ্রামীণ অর্থনীতিতে চাপ সৃষ্টি করছে।
হতাশার মধ্যে ও আশার আলো হলো প্রকৃতিকে সুযোগ দিলে সে নিজেকে সারিয়ে তুলতে পারে। তবে এর জন্য প্রয়োজন আশু পদক্ষেপ—
মৎস্য অভয়াশ্রম বৃদ্ধি: হাওর ও নদীগুলোর নির্দিষ্ট কিছু অংশকে সারা বছরের জন্য বা প্রজনন মৌসুমে মৎস্য অভয়াশ্রম ঘোষণা করে কঠোরভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে।
দূষণ রোধ: শিল্পবর্জ্য নদীতে ফেলার আগে শোধন (ইটিপি ব্যবহার) বাধ্যতামূলক করতে হবে। কৃষিতে জৈব সারের ব্যবহার বাড়াতে হবে।
জনসচেতনতা ও আইন প্রয়োগ: কারেন্ট জাল বা বিষ দিয়ে মাছ ধরা বন্ধে আইনের কঠোর প্রয়োগ এবং জেলেদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে হবে।
জলাশয় পুনরুদ্ধার: ভরাট হয়ে যাওয়া খাল-বিল খনন করে পানির প্রবাহ ফিরিয়ে আনতে হবে।
স্বাদু পানির মাছ রক্ষা করা কেবল মৎস্য অধিদপ্তরের কাজ নয়, এটি আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। নদী বাঁচলে মাছ বাঁচবে; আর মাছ বাঁচলে টিঁকে থাকবে আমাদের প্রাণবৈচিত্র্য ও বাস্তুতন্ত্র। আমরা যদি এখনই সচেতন না হই, তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হয়তো জাদুঘরে গিয়ে জানবে—একদা এ দেশে ‘মাছে-ভাতে বাঙালি’ নামে একটি জাতি ছিল।
প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্র টিঁকে থাকবে কি না, তার উত্তর নির্ভর করছে আজ আমরা প্রকৃতির প্রতি কতটা সদয় আচরণ করছি, তার ওপর। সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে, সিদ্ধান্ত নিতে হবে এখনই।
হেনা শিকদার দর্শন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়