বাংলাদেশের একজন ধনাঢ্য ব্যক্তি যখন চিন্তা করেন উদ্বৃত্ত টাকা দিয়ে কি জমি কিনবেন, উচ্চ হারে ফিক্সড ডিপোজিট করবেন, নাকি শিল্পকারখানায় বিনিয়োগ করবেন, তখন তাঁর মনে কী কী বিবেচনা কাজ করে? তেমনটি দুবাই, সিঙ্গাপুর, মুম্বাই, কুয়ালালামপুর, লন্ডন, প্যারিস বা নিউইয়র্কে যখন কোনো কোম্পানি বা ধনকুবের তাঁর বা তাঁদের পুঁজির নতুন বিনিয়োগ–গন্তব্য বেছে নিতে চান, তখন কী কী বিষয় বিবেচনায় নেন?

৩৫ বছরের বেশি সময় দেশে–বিদেশে বিনিয়োগের সুযোগ কাজে লাগানো বা ব্যবস্থাপনার অভিজ্ঞতায় আমার মনে হয়েছে, ব্যবসায়ীরা পত্রপত্রিকা পড়ে নয়, বরং ইতিমধ্যে ব্যবসা করছেন—এমন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের অভিজ্ঞতাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেন। তারপর আসে পুঁজি এনে বা বিনিয়োগে লাভের সম্ভাবনা, আর্থিক খাতের গভীরতা আর ব্যাংকঋণ পাওয়ার সহজলভ্যতা, দক্ষ শ্রমিক বা ব্যবস্থাপক পাওয়ার সুবিধা, যাতায়াত বা পরিবহন অবকাঠামো, মুনাফা বাইরে নিয়ে যাওয়ার সুবিধা, প্রচলিত আইনি কাঠামো আর দুষ্ট প্রভাবমুক্ত বিচার পাওয়ার সম্ভাবনা এবং দুর্নীতির প্রকোপ থেকে দূরে থাকতে পারার সুযোগ। সেই সঙ্গে ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতা ও ভোক্তা ব্যয়ের রকমফেরও বিবেচ্য হয়ে থাকে। 

সেই স্নাতক পর্যায় থেকে শুনে আসছি, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বৈচিত্র্য আনতে এবং কর্মসংস্থান প্রসারে নতুন নতুন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান সৃষ্টি প্রয়োজন। সে ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবকের ভূমিকা পালন করে বিনিয়োগ তথা বিদেশি বিনিয়োগ। কোনো দেশে বৈদেশিক বিনিয়োগ আসার অর্থ হচ্ছে তাদের উদ্যোক্তাবান্ধব পরিবেশ আছে এবং সেখানে ব্যবসা লাভজনক। কিন্তু বৈদেশিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য সফলতা নেই বললেই চলে।

বাংলাদেশ বিদেশি বিনিয়োগের আকর্ষণীয় গন্তব্য বলা হলেও বিনিয়োগের পরিবেশের বিষয়টি শুধু আলোচনায়ই সীমাবদ্ধ। বিদেশিদের আকর্ষণে নানামুখী নীতি প্রণয়ন হলেও এর ধারাবাহিকতা নেই। বিনিয়োগের উপযোগী হিসেবে আস্থা অর্জন থেকেও বারবার ছিটকে পড়তে হয়েছে দেশকে। আবার বিনিয়োগ ধরে রাখতে সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে যে দীর্ঘসূত্রতা ও সমন্বয়হীনতা, তা দূর হয়নি গত তিন দশকে। সব মিলিয়ে হাতে গোনা দু-একটি কোম্পানি ছাড়া বিদেশি বিনিয়োগের বড় সফলতা পায়নি এ দেশ। 

মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, ভোগব্যয় বৃদ্ধি আর অধিক হারে মধ্যবিত্তের বিকাশের পরিপ্রেক্ষিতে বিদেশি বিনিয়োগের জন্য আকর্ষণীয় বা সম্ভাবনাময় এক বাজার হতে পারে বাংলাদেশ। তারপরও দেশে বড় আকারে বিনিয়োগ আকৃষ্ট না হওয়ার কারণ অভ্যন্তরীণ। আর্থিক খাতে শৃঙ্খলার অভাব, রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিনিয়োগনীতির ধারাবাহিকতার অভাব, অর্থাৎ বছর বছর বিনিয়োগনীতির পরিবর্তন, বিনিয়োগে নিয়োজিত সংস্থাগুলোর সক্ষমতার অভাব ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এই বিনিয়োগ–স্বল্পতার পেছনে কাজ করেছে।

এ ছাড়া বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে যে উদ্যোগগুলো গ্রহণ করা হয়েছে, সেগুলো এখনো কোনো কার্যকারিতা দেখাতে পারেনি। উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনৈতিক রূপান্তরে সরাসরি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই)। আশির দশক–পরবর্তী সময়ে ভিয়েতনাম, চীন, মেক্সিকো ও ভারতের মতো দেশগুলোর অর্থনৈতিক সম্প্রসারণে অবদান রেখেছে এফডিআই। বিশেষ করে ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি, প্রযুক্তি স্থানান্তর ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল রাখার ক্ষেত্রে প্রভাবক হিসেবে কাজ করে থাকে এফডিআই। 

আমরা যদি অপরাপর প্রতিযোগী দেশের বিপরীতে বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে চাই, তাহলে অতি দ্রুত বিদেশে ব্যয়বহুল বিনিয়োগ সম্মেলন আর বাণিজ্য মেলা থেকে সরে এসে আমাদের প্রচলিত নীতিমালাগুলোকে আধুনিকায়ন করতে হবে, শিক্ষার মান বাড়াতে হবে, নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ‘লাইসেন্স–রাজ’ মনোভাব থেকে সরিয়ে ব্যবসাবান্ধব করতে হবে এবং প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে।

আমাদের স্বাধীনতার এত বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি করা যায়নি। তাই এখানে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে চাইলে যেসব সমস্যা রয়েছে, তা সমাধান করতে হবে। তা ছাড়া এফডিআই আকর্ষণ করতে সবার আগে প্রয়োজন বিনিয়োগ মহলে দেশের যথাযথ ব্র্যান্ডিং। বিনিয়োগবান্ধব সংস্কৃতি গড়ে তোলার পাশাপাশি ব্যবসার জন্য আগে থেকে অনুধাবনযোগ্য একটি স্থিতিশীল ও দুর্নীতিমুক্ত পরিবেশ গড়ে তোলা প্রয়োজন। বিনিয়োগের নিরাপত্তা ও ব্যবসায়ীদের লাইসেন্সিংয়ের অধিকার প্রয়োগেরও সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। সর্বোপরি বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণে সরকারকেও সততার সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে প্রয়াস চালিয়ে যেতে হবে। 

স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে দেশের আর্থসামাজিক, অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়নে দেশীয় বিনিয়োগের পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে বৈদেশিক বিনিয়োগ। অর্থনীতির সূত্র হলো দেশি বিনিয়োগ বাড়লে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ে। কারণ, দেশি বিনিয়োগকারীদের হাত ধরে বিদেশি বিনিয়োগ আসে। সে কারণে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে হলে দেশি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। আর্থিক খাতের অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সব সমন্বয়হীনতা ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর করতে হবে। 

বাংলাদেশের বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ বৃদ্ধির উপায় হলো দক্ষ জনশক্তি তৈরি ও রাজনৈতিক অস্থিরতা হ্রাস। বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের প্রধান উপাদান হলো সস্তা শ্রম। কিন্তু এখন শুধু সস্তা শ্রম দিয়ে খুব বেশি বিনিয়োগ আনা যাবে না, এমনকি যাচ্ছেও না। সে জন্য তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নের সঙ্গে প্রশিক্ষিত জনবল তৈরিতে সর্বাত্মক প্রয়াস চালাতে হবে। একই সঙ্গে শিল্পকারখানা স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় জমি, উন্নত অবকাঠামো ও যোগাযোগব্যবস্থা উন্নত করতে হবে। সেসব শিল্পপ্রতিষ্ঠানের দিকে দৃষ্টি দিতে হবে, যেসব শিল্প বৃহৎ পুঁজি আকর্ষণ করে। বৃহৎ পুঁজি ও বৃহৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠানেই অধিক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে। আমাদের মতো জনবহুল দেশে যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। 

মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূলে ছিল ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিকস শিল্পে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়াসহ অন্যান্য দেশের বিনিয়োগ। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও তাইওয়ানের বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো মালয়েশিয়ায় প্রচুর বিনিয়োগ করেছে। ১৯৯১-৯৯ সাল পর্যন্ত বেশির ভাগ সময় মালয়েশিয়ার ইলেকট্রনিকস শিল্পের মোট বিনিয়োগের ৮০ শতাংশের বেশি ছিল বৈদেশিক বিনিয়োগ।

১৯৮০ সালে জাপানের বিনিয়োগের ফলে মালয়েশিয়ার শিল্প খাত বিকাশ লাভ করে এবং দেশটির লক্ষ্য ছিল ২০২০ সালের মধ্যে আত্মনির্ভরশীল শিল্পোন্নত দেশ হওয়া। দেশীয় ও বৈদেশিক প্রতিষ্ঠানগুলোর যৌথ উদ্যোগে অনেক শিল্পকারখানা গড়ে উঠেছে। এটি সম্ভব হয়েছে মূলত বৈদেশিক বিনিয়োগের কারণে। দক্ষ জনবল, প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য, তুলনামূলক স্বল্প মজুরি ব্যয়, উন্নত জীবনযাত্রার মান, ডিজিটাল সংযোগব্যবস্থা, সরকারের বৈদেশিক বিনিয়োগনীতি ইত্যাদি মালয়েশিয়ায় বৈদেশিক বিনিয়োগ, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন ও উন্নয়নে সহায়তা করেছে। 

থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে। মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের মতো যদি বাংলাদেশে বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধি পায়, তবে নিঃসন্দেহে দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার আরও উন্নতি ঘটবে। বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে আকৃষ্ট করার জন্য দেশের ভাবমূর্তি একটি বড় বিষয়। সুন্দর ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশ, প্রশস্ত রাস্তা, বিদেশি নাগরিকদের সঙ্গে ব্যবহার ও আচরণ, রাজনৈতিক পরিবেশ, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, যোগাযোগ ও সংযোগ (কানেকটিভিটি) ঘটানো ও রক্ষার ক্ষমতা, প্রাকৃতিক পরিবেশ, সম্পদের প্রাচুর্য, দক্ষ ও প্রশিক্ষিত অথবা প্রশিক্ষণযোগ্য জনবল, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা হ্রাস ইত্যাদি বৈদেশিক বিনিয়োগকে আকৃষ্ট করে এবং বৈদেশিক বিনিয়োগকারীদের কোনো দেশ সম্পর্কে ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি করে, যা বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। 

আধুনিক বিশ্বে যেকোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বৈদেশিক বিনিয়োগের গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগের সুযোগ থাকলেও বিনিয়োগের পরিবেশ নিয়ে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে কিছু শঙ্কাও কাজ করছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে দুর্নীতি ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা।

বিশ্বব্যাংক, বিশেষ করে আইএফসির বিভিন্ন প্রতিবেদনে বাংলাদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যে প্রতিবন্ধকতাগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে, তার অন্যতম ছিল দুর্নীতি ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। পাশাপাশি ট্যাক্স, শুল্কছাড় ও মুনাফার প্রত্যাবাসন অন্যতম। দুঃখজনক হলেও সত্য, এ ক্ষেত্রে অগ্রগতি খুব সামান্যই। এ ছাড়া দক্ষ জনশক্তির অভাব, অবকাঠামোগত দুর্বলতা ও জমির দুষ্প্রাপ্যতাকেও প্রতিবন্ধকতা মনে করা হয়। 

আমরা যদি অপরাপর প্রতিযোগী দেশের বিপরীতে বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে চাই, তাহলে অতি দ্রুত বিদেশে ব্যয়বহুল বিনিয়োগ সম্মেলন আর বাণিজ্য মেলা থেকে সরে এসে আমাদের প্রচলিত নীতিমালাগুলোকে আধুনিকায়ন করতে হবে, শিক্ষার মান বাড়াতে হবে, নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ‘লাইসেন্স–রাজ’ মনোভাব থেকে সরিয়ে ব্যবসাবান্ধব করতে হবে এবং প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে।

প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে পুঁজি বিনিয়োগ করে ভালো মুনাফা করতে পারে, মুনাফা সহজেই বাইরে নিতে পারে কিংবা আইনি লড়াইয়ে সুবিচার পায়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মোটেই ভেদাভেদ কাম্য নয়। 

মামুন রশীদ অর্থনীতি বিশ্লেষক

.

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

অজ্ঞাত স্থানে বসে পরিষদ চালান ৩ চেয়ারম্যান

গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় কয়েকমাস ধরে অজ্ঞাত স্থানে বসে পরিষদ চালাচ্ছেন নৌকা প্রতিকের তিন ইউপি চেয়ারম্যান। এতে ব্যাপক ভোগান্তিতে পড়েছে ঐ তিন ইউনিয়নের জনগণ। 

চেয়ারম্যানরা কোথায় আছেন তার হদিস কেউ জানে না। তারা আত্মগোপনে থাকায় নাগরিক সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। যথাসময়ে পাচ্ছেন না জন্মনিবন্ধন, মৃত্যু সনদ, নাগরিকত্ব সনদ, ট্রেড লাইসেন্সসহ অন্যান্য সনদ ও প্রত্যয়নপত্র।

অজ্ঞাত স্থানে বসে পরিষদ চালানো চেয়ারম্যানরা হলেন- ডুমুরিয়া ইউপি চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আলী আহম্মেদ শেখ, গোপালপুর ইউপি চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক লাল বাহাদুর বিশ্বাস এবং বর্নি ইউপি চেয়ারম্যান ও উপজেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি মিলিয়া আমিনুল।

ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া উপজেলার পাঁচ ইউপি চেয়ারম্যান আত্মগোপনে চলে যান। তারা পাঁচ জনই আওয়ামী লীগের পদধারী নেতা। 

সেসময় টুঙ্গিপাড়ার মতো দেশের অধিকাংশ চেয়ারম্যান অনুপস্থিত থাকায় ২০২৪ সালের ৯ আগস্ট স্থানীয় সরকার বিভাগের ইউপি-১ শাখা থেকে ইউনিয়ন পরিষদ পরিচালনার জন্য আর্থিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা অর্পণ সংক্রান্ত পরিপত্র জারি করে সরকার। 

তারপর থেকে উপজেলার ডুমুরিয়া, গোপালপুর, কুশলী ও বর্নির ইউপি চেয়ারম্যানরা অফিস করলেও পাটগাতী ইউপি চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি শেখ শুকুর আহম্মেদ আত্মগোপনে থেকে যান। তখন তার স্থলে প্যানেল চেয়ারম্যান সুভাষ চন্দ্র বিশ্বাস দায়িত্ব পান।

এছাড়া গত ২৫ সেপ্টেম্বর বিএনপির নেতাকর্মীদের উপর হামলা মামলায় গ্রেপ্তার হন কুশলী ইউপি চেয়ারম্যান বেলায়েত হোসেন সর্দার। তিনি কারাগারে যাওয়ার পর তার স্থলে দায়িত্ব পান প্যানেল চেয়ারম্যান ইশতিয়াক আহমেদ। তারপর থেকে বাকি তিন ইউপি চেয়ারম্যান পরিষদ পরিচালনা করতে থাকেন।

২০২৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারি টুঙ্গিপাড়ায় পুলিশের উপর হামলা ও গাড়ি ভাঙচুরের মামলায় এজাহারভুক্ত আসামি হওয়ার পর থেকে গ্রেপ্তার আতঙ্কে অজ্ঞাত স্থানে বসে পরিষদ চালাচ্ছেন ঐ তিন ইউপি চেয়ারম্যান। আত্মগোপনে থাকা চেয়ারম্যানরা নিজ এলাকার জনগণের ফোনও রিসিভ করছে না। কখনো কখনো রিসিভ করলেও বিভিন্ন আবেদন সচিবদের কাছে রেখে যেতে বলছেন।

বর্নি ইউনিয়নের বাসিন্দা ফরহাদ হোসেন মুন্সী, হাফেজ মোহাম্মদ মোস্তাইনসহ অনেকে বলেন, “সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চলে যাওয়ার পর থেকে চেয়ারম্যান মিলিয়া আমিনুল ঠিকমতো পরিষদে থাকেন না। নিজেদের কাজ ফেলে রেখে কয়েকমাস ধরে জন্মনিবন্ধনের জন্য ঘুরছি, কিন্তু চেয়ারম্যানের দেখা পাচ্ছি না। আর অন্যান্য সেবা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে জনগণ।”

তারা আরো বলেন, “চেয়ারম্যানের মোবাইল নম্বরও বন্ধ। চেয়ারম্যানের একটা স্বাক্ষরের জন্য জনগণের ব্যাপক ভোগান্তি হচ্ছে। বর্নি ইউনিয়নের মানুষের দুর্ভোগ কমাতে সরকার ও প্রশাসনের দৃষ্টি কামনা করেন তারা।

বর্নি ইউনিয়ন পরিষদের সচিব তপন কুমার বিশ্বাস বলেন, “চেয়ারম্যান মিলিয়া আমিনুল মাস খানেক হলো পরিষদে আসেন না। প্রতিদিন জনগণের আবেদন বা কাগজপত্র একটা ফাইলে রেখে দেই। আর চেয়ারম্যানের স্বামী আমিনুল ইসলাম দুই একদিন পর পর ফাইলটি নিয়ে যান। আর চেয়ারম্যান কাগজপত্র সই করে পরে আবার পাঠিয়ে দেন। এভাবেই চলছে বর্নি ইউনিয়ন পরিষদ।”

ডুমুরিয়া ইউনিয়নের বাঁশবাড়িয়া গ্রামের বাসিন্দা শহিদুল ইসলাম, সাহেদ তালুকদারসহ গোপালপুর ইউনিয়নের অনেকে বলেন, “চেয়ারম্যানরা আত্মগোপানে থাকায় ওয়ারিশান, নাগরিক, চারিত্রিক ও মৃত্যু সনদ নিতে দিনের পর দিন পরিষদে ঘুরেও জনগণ কাঙ্খিত সেবা পাচ্ছে না। এতে একদিকে যেমন জনগণের ভোগান্তি, অপরদিকে ব্যাপক সময় আপচয় হচ্ছে। শুনেছি চেয়ারম্যানরা বিভিন্ন মামলার আসামি হওয়ায় আত্মগোপনে রয়েছেন তারা। তাই জনজীবনের দুর্ভোগ কমাতে সরকারের পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।”

এ বিষয়ে জানতে গোপালপুর ও ডুমুরিয়া ইউনিয়ন পরিষদে গিয়েও দুই চেয়ারম্যান লাল বাহাদুর বিশ্বাস এবং আলী আহম্মেদ শেখকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। পরে তাদের মোবাইলে একাধিকবার কল ও ক্ষুদেবার্তা পাঠিয়েও সাড়া মেলেনি।

তবে বর্নি ইউপি চেয়ারম্যান মিলিয়া আমিনুলের হোয়াটসঅ্যাপে কল করলে তিনি রিসিভ করেন। তখন বেশ কিছুদিন পরিষদ কার্যালয়ে আসেন না জানিয়ে মিলিয়া আমিনুল বলেন, “পুলিশের গাড়ি ভাঙচুরের মিথ্যা মামলায় আমাকে ১০৩ নম্বর আসামি করা হয়েছে। তাই গ্রেপ্তার আতঙ্কে পরিষদে যেতে পারছি না।” 

এতে জনপ্রতিনিধিদের অফিস চলাকালীন কার্যালয়ে থাকার সরকারি নির্দেশ অমান্য হচ্ছে কি না- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “যেখানে বজ্রপাত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, সেখানে দাঁড়ানো যায় না। তাই আমি ঘর পরিবর্তন করেছি, তবে এলাকাতেই আছি।”

তিনি দাবি করেন, তার এলাকার জনগণের ভোগান্তি হচ্ছে না। কারণ, তার স্বামী ও সচিবের মাধ্যমে অজ্ঞাত স্থানে বসে কাগজপত্রে স্বাক্ষর করেন তিনি। কোনো কাজহই বাকি থাকে না।

এ বিষয়ে টুঙ্গিপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মঈনুল হক বলেন, “কোন জনপ্রতিনিধি অনুমোদনহীনভাবে কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকেন, তাহলে সাধারণ মানুষের ভোগান্তির সৃস্টি হয়। নিরবচ্ছিন্ন সেবা নিশ্চিত করতে ও জনদুর্ভোগ লাগবে স্থানীয় সরকার আইন অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”

ঢাকা/এস

সম্পর্কিত নিবন্ধ