বিটিআরসির পাওনা ১২৬ কোটি টাকা নিয়ে ওসমান পরিবারের জালিয়াতি
Published: 14th, January 2025 GMT
রাজধানীর ফকিরাপুলের ডিআইটি রোডের একটি ভবনে ছোট একটি কক্ষে সাখাওয়াত হোসেনের ট্রাভেল এজেন্সির কার্যালয়। আসবাব বলতে শুধু একটি টেবিল ও তিনটি চেয়ার। ভাড়া ছয় হাজার টাকা। সাখাওয়াত ফকিরাপুলেই একটি মেসে থাকেন।
যদিও বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) নথিপত্রে সাখাওয়াত কে টেলিকম নামের (পরে ইন্টারন্যাশনাল ভয়েস টেল লিমিটেড নামকরণ হয়) একটি ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ে বা আইজিডব্লিউ কোম্পানির অংশীদার ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি)।
শামীম ওসমানের পরিবারের প্রতিষ্ঠানের কাছে ১২৬ কোটি টাকা পাবে বিটিআরসি। ফাঁকি দিতে তিন ব্যক্তিকে মালিক সাজিয়ে শেয়ার স্থানান্তর।আইজিডব্লিউ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিদেশ থেকে টেলিফোন কল বাংলাদেশে আসে। কে টেলিকমের কাছে বিটিআরসির পাওনা ১২৬ কোটি টাকার বেশি। পাওনা আদায়ে বিটিআরসি কোম্পানিটির মালিকদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে।
প্রশ্ন হলো, সাখাওয়াত কীভাবে এত বড় প্রতিষ্ঠানের মালিক হলেন? গত ১৭ ডিসেম্বর ফকিরাপুলে সাখাওয়াতের কার্যালয়ে গিয়ে তাঁর কাছে এই প্রশ্নই করা হয়েছিল। তিনি বলেন, ‘আমি নিজেই তো জানতাম না, আমি মালিক। গত ১৮ অক্টোবর বিটিআরসির কর্মকর্তারা রাঙ্গুনিয়া (চট্টগ্রাম) থানার পুলিশ নিয়ে আমার গ্রামের বাড়িতে যান। তখনই আমি এই কোম্পানি ও নিজের মালিকানার কথা জানতে পারি।’
কে টেলিকমের মালিক ছিল নারায়ণগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের পরিবার। শামীম ওসমানের স্ত্রী সালমা ওসমান ও ছেলে ইমতিনান ওসমানের নামে ২০১২ সালে ১৫ বছরের জন্য কে টেলিকমের লাইসেন্স নেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠানটিতে শামীম ওসমানের শ্যালক তানভীর আহমেদ এবং তাঁর (শামীম ওসমান) ঘনিষ্ঠ জয়নাল আবেদীন মোল্লা ও জাহাঙ্গীর হোসেন মোল্লার মালিকানাও ছিল।
নথিপত্রে দেখা যায়, ২০১৩ সালের ৪ আগস্ট ওসমান পরিবার কে টেলিকমের মালিকানা সাখাওয়াত হোসেন, সিলেটের স্কুলশিক্ষক দেবব্রত চৌধুরী ও বগুড়ার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অফিস সহকারী রাকিবুল ইসলামের নামে হস্তান্তর করে। তাঁরা তিনজন প্রথম আলোকে বলেছেন, তাঁরা কেউই এ বিষয়ে জানতেন না। জালিয়াতি করে তাদের মালিক দেখানো হয়েছে।
এদিকে বিটিআরসি ও সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, সরকারের পাওনা টাকার দায় এড়াতে তড়িঘড়ি করে ওসমান পরিবার কে টেলিকমের মালিকানা ওই তিন ব্যক্তির কাছে হস্তান্তর করে। এ ক্ষেত্রে জালিয়াতি করা হয়েছে। ভুয়া ছবি ব্যবহার করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থা ওসমান পরিবারের এই কারসাজির সহযোগী ছিল।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর শামীম ওসমান পরিবারসহ আত্মগোপনে রয়েছেন। তাঁর (শামীম ওসমান) বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি।
যাচাই করার দায়িত্ব ছিল বিটিআরসির। এ ঘটনায় মনে হচ্ছে, জেনেশুনেই এমন ব্যক্তিদের নামে মালিকানা হস্তান্তরের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, যাঁরা ব্যবসাটা সম্পর্কে জানেন না, বরং ভুক্তভোগী।সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও কোম্পানি আইনবিশেষজ্ঞ আহসানুল করিমবিটিআরসির বিপুল পাওনা
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর টেলিযোগাযোগ খাতে বেশ কিছু লাইসেন্স দেওয়া হয়। তখন বিদেশ থেকে কল আনা ছিল লাভজনক ব্যবসা। জাহাঙ্গীর কবির নানক, শামসুল হক টুকু, শামীম ওসমানসহ কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা তখন আইজিডব্লিউ লাইসেন্স নেন। লাইসেন্স নিতে ফি দিতে হয় এবং বিদেশ থেকে আনা কল থেকে আয়ের একটি অংশ বিটিআরসিকে দিতে হয়। ‘রাজনৈতিক বিবেচনায় লাইসেন্স পাওয়া ব্যক্তিরা বিটিআরসির পাওনা না দিয়ে একপর্যায়ে প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেন। ছয়টি প্রতিষ্ঠানের কাছে বিটিআরসি এখনো ৯২১ কোটি টাকার বেশি পাবে।
বিটিআরসি নথিপত্র অনুযায়ী, কে টেলিকমের কাছ থেকে পাওনা আদায়ে বিটিআরসি ২০১৪ সালের ২২ জুন মামলা করে। ২০২৩ ও ২০২৪ সালে বিটিআরসি ও পুলিশ যায় নতুন ‘মালিকদের’ বাড়িতে।
শেয়ার হস্তান্তরের মাধ্যমে নতুন ‘মালিক’ হওয়া বগুড়া আদমদীঘির বাসিন্দা রাকিবুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, তিনি কীভাবে এই কোম্পানির মালিক হয়েছেন, তা তিনি জানেন না। তিনি ২০০৬ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ঢাকার সাভারে একটি পোশাক কারখানায় কাজ করেছেন। এখন বগুড়ায় একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানে সামান্য বেতনে অফিস সহকারী হিসেবে কাজ করেন।
এখানে বহুমাত্রিক দুর্নীতি হয়েছে। ওসমান পরিবার ক্ষমতার অপব্যবহার করে রাষ্ট্রকে বঞ্চিত করেছে। নিজেদের বাঁচাতে অন্যদের ওপর দায় চাপিয়েছে। অন্যের জাতীয় পরিচয়পত্র চুরি করে ভুয়া নথি তৈরি করা হয়েছে এবং জড়ানো হয়েছে নিরপরাধ ব্যক্তিদের। সংশ্লিষ্ট সবাইকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান২০২৪ সালের মে মাসে বিটিআরসি কর্মকর্তারা বগুড়ায় তাঁর বাড়িতে গিয়েছিলেন উল্লেখ করে রাকিবুল বলেন, ‘বিটিআরসির স্যাররা দেখে গেছে আমি কী অবস্থায় থাকি।’ তিনি বলেন, তাঁর ধারণা তাঁর জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) ব্যবহার করে এই জালিয়াতি হয়েছে। শুধু এ ঘটনা নয়, তাঁর এনআইডি ব্যবহার করে মুঠোফোনে আর্থিক সেবার (এমএফএস) হিসাবও খোলা হয়েছিল।
সিলেটের গোলাপগঞ্জের সরকারি এমসি একাডেমির ইংরেজি বিষয়ের সহকারী শিক্ষক দেবব্রত চৌধুরীর খোঁজ পেয়ে বিটিআরসি ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তাঁকে পুলিশ দিয়ে গ্রেপ্তার করায়। দেবব্রত প্রথম আলোকে বলেন, তাঁকে গ্রেপ্তারের খবরে শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করে এবং পরদিন তাঁকে মুচলেকা দিয়ে ছেড়ে দেয় পুলিশ। তিনি ২০০৩ সাল থেকে এমসি একাডেমিতে কর্মরত। সিলেট নগরে দুই কক্ষের একটি ভাড়া বাসায় স্ত্রীকে নিয়ে বসবাস করেন।
মালিকানা হস্তান্তর কীভাবে
কোনো প্রতিষ্ঠানের মালিকানা হস্তান্তর হয় আরজেএসসি থেকে। আর টেলিযোগাযোগ খাতের লাইসেন্সপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের মালিকানা স্থানান্তরে বিটিআরসির কাছে আবেদন করে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে অনুমোদন নিতে হয়।
কে টেলিকমের মালিকানা হস্তান্তরের আবেদন যাচাই করা হয়েছিল কি না, জানতে চাইলে বিটিআরসি কর্তৃপক্ষ লিখিত বক্তব্যে প্রথম আলোকে বলেছে, যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে এবং সরকারের সম্মতি নিয়ে মালিকানা হস্তান্তরের অনুমোদন নেওয়া হয়েছে।
যদিও বিটিআরসির একটি সূত্র বলছে, কে টেলিকম আবেদনের সঙ্গে যেসব নথিপত্র দিয়েছিল, তা যাচাই ছাড়াই তড়িঘড়ি অনুমোদন দেওয়া হয়। যাচাই করলে ভুয়া ছবি দেওয়ার বিষয়টি ধরা পড়ত। আইন অনুযায়ী, মালিকানার ক্ষেত্রে আর্থিক সংগতি আছে কি না, তা যাচাই করা বিটিআরসির দায়িত্ব।
অন্যদিকে আরজেএসসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, তখন নিয়ম ছিল মালিকানা হস্তান্তরকারীর পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় নথিপত্রের সঙ্গে সবার স্বাক্ষরসহ সরকারের অনুমোদনপত্র জমা দিতে হবে। এই ক্ষেত্রেও সেটা হয়েছে।
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও কোম্পানি আইনবিশেষজ্ঞ আহসানুল করিম প্রথম আলোকে বলেন, যাচাই করার দায়িত্ব ছিল বিটিআরসির। এ ঘটনায় মনে হচ্ছে, জেনেশুনেই এমন ব্যক্তিদের নামে মালিকানা হস্তান্তরের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, যাঁরা ব্যবসাটা সম্পর্কে জানেন না, বরং ভুক্তভোগী। তিনি বলেন, এটি রাজনৈতিক পরাক্রমশালী ব্যক্তিদের হীন স্বার্থের বলি হওয়ার একটি উদাহরণ।
বিটিআরসি ২০১৪ সালে যে মামলা করে, তার এজাহারে মালিকানা পরিবর্তনের কথা উল্লেখ করা হয়নি। বরং মূল মালিকদের বাদ দিয়ে নতুন ‘মালিকদের’ পেছনেই ছুটেছে তারা। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সবাই জানে কে টেলিকমের মালিক শামীম ওসমান ও তাঁর পরিবার। তারপরও নিরীহ তিন ব্যক্তির বাড়িতে পুলিশ পাঠিয়ে হয়রানি করা হয়েছে।
পুরো বিষয়টি নিয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, এখানে বহুমাত্রিক দুর্নীতি হয়েছে। ওসমান পরিবার ক্ষমতার অপব্যবহার করে রাষ্ট্রকে বঞ্চিত করেছে। নিজেদের বাঁচাতে অন্যদের ওপর দায় চাপিয়েছে। অন্যের জাতীয় পরিচয়পত্র চুরি করে ভুয়া নথি তৈরি করা হয়েছে এবং জড়ানো হয়েছে নিরপরাধ ব্যক্তিদের। সংশ্লিষ্ট সবাইকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
বিজয় যখন কড়া নাড়ছে
পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের ঠিক আগমুহূর্তে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সাড়া জাগায়। দেশবাসীসহ বিশ্ব জানতে পারে, জাতিগত গণহত্যার মধ্যেই চলেছিল পরিকল্পিত বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড। এখানে সে সময়ের একটি আলোচিত প্রতিবেদন তুলে ধরা হলো।
আত্মসমর্পণের আগে
ঢাকায় বৃহস্পতিবার আত্মসমর্পণের আগে পাকিস্তান সেনাবাহিনী শহরের বুদ্ধিজীবী, বিজ্ঞানী, ব্যবসায়ীদের গ্রেপ্তার করেছে এবং তাঁদের মধ্যে পঞ্চাশের বেশি লোককে গুলি করে হত্যা করেছে। আকস্মিক সামরিক অভিযানের অংশ হিসেবে নিবিড় পরিকল্পনার আওতায় বাঙালি এলিট নিধনের অংশ হিসেবে এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে। এটা অবশ্যই কমান্ডিং অফিসার জেনারেল নিয়াজিসহ পাকিস্তান হাই কমান্ডের পূর্ণ জ্ঞাতসারে ঘটেছে।
এসব মৃতদেহের আবিষ্কার ঢাকা শহরে উত্তেজনা বাড়াতে পারে, পাল্টা হত্যাকাণ্ড ও দাঙ্গার জন্ম দিতে পারে, এমনকি মুক্তিবাহিনীর গেরিলা ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর মধ্যেও সংঘর্ষ সৃষ্টি করতে পারে।
ঢাকার মূল শহরের পাশের রায়েরবাজারে কতগুলো বিচ্ছিন্ন গর্তে নিহত বুদ্ধিজীবীদের মৃতদেহ আবিষ্কৃত হয়। আমি নিজে ৩৫টি গলিত দেহ দেখেছি। আপাতদৃষ্টে মনে হয়, তাঁরা চার-পাঁচ দিন আগে নিহত হয়েছেন। মৃতের সংখ্যা সম্ভবত আরও বেশি হবে। ঢাকায় অপহরণ করা এ ধরনের লোকের সংখ্যা অন্তত ১৫০ হতে পারে।
ইউপিআইয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজের প্রধান হৃদ্রোগ চিকিৎসক ফজলে রাব্বী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান মুনীর চৌধুরী রয়েছেন। ঢাকার মধ্যবিত্ত এলাকা ধানমন্ডির বাইরে একটি ইটখোলাকে বধ্যভূমিতে পরিণত করা হয়েছে। যদিও কচুরিপানার নীল-সাদা ফুল কর্দমাক্ত জলাশয়ে শোভা পাচ্ছে। স্থানটি লোকালয় থেকে বিচ্ছিন্ন। আজ ঢাকার শত শত মানুষ মাটির বাঁধ দিয়ে হেঁটে হেঁটে এখানে এসেছে, তাদের অনেকেই খুঁজে বেড়াচ্ছে নিরুদ্দিষ্ট স্বজনদের।
বিশিষ্টজনদের অপহরণ করে তুলে নেওয়ার ঘটনাটি ঘটেছে মঙ্গলবার সকালেই। পাঞ্জাবি সেনাদের কয়েকটি স্কোয়াড নির্দিষ্ট ঠিকানায় হাজির হয়ে নির্ধারিত পুরুষ ও নারীকে সশস্ত্র পাহারায় উঠিয়ে নিয়ে এসেছে। তাঁদের সম্ভবত রায়েরবাজার ইটখোলায় এনে মাটির বাঁধের পাশে লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে গুলি করেছে, যাতে তাঁরা হুমড়ি খেয়ে নিচের জলাশয়ে পড়ে যান।
ড. আমিনুদ্দিন বেঙ্গল রিসার্চ ল্যাবরেটরির প্রধান, অক্সফোর্ডের পিএইচডি। পাকিস্তানি সেনারা যখন তাঁকে তুলে নেয়, সেই মঙ্গলবার সকাল সাতটায় তাঁকে শেষবারের মতো দেখা যায়। নাজিউর রহমান বললেন, ‘আমি দুঃখিত, আমাকেও যেতে হচ্ছে, খুঁজে দেখি।’ ততক্ষণে তিনিও উলের মাফলার দিয়ে নাক-মুখ পেঁচিয়ে নিয়েছেন।
গতকাল আমি কেবল তিন ঘণ্টা ঢাকায় ছিলাম, ততক্ষণে ইটভাটার এই খবর তেমন ছড়ায়নি। জনতা উত্তেজিত, তবে আচরণে অদ্ভুত কোমলতা। ভারতীয় সেনাদের হাত নেড়ে অভিবাদন জানাচ্ছে, গাড়িতে এই প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত যাচ্ছে, আবার ফিরে আসছে।
সেদিনও অনেক গোলাগুলি হয়েছে, বিশেষ করে রাতের বেলায়। ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে অবস্থানরত সাংবাদিকেরা জানিয়েছেন, পরিস্থিতি তখনো বিস্ফোরণোন্মুখ। বাঙালিরা অভিযোগ করছে, বিহারি এই বিদেশিরা বহু বছর আগে মুসলমান হিসেবে ঘাঁটি গেড়ে বসেছে, তারা বাঙালি হত্যাকাণ্ডে পাকিস্তানি সেনাসদস্যদের সাহায্য করেছে। আট মাস আগে আমি যখন যশোরে ছিলাম, এ কারণেই সেখানে বেসামরিক বিহারিদের হত্যা করা হয়। ঢাকায় বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকাণ্ড যশোরের হত্যাকাণ্ডের চেয়ে শতগুণ বেশি ভয়াবহ একটি ব্যাপার। কাজেই একধরনের প্রতিশোধ গ্রহণের ব্যাপার অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠবে।
ইতিমধ্যে ভারতীয় সেনাবাহিনীর পাহারায় সেনানিবাসে বন্দী পাকিস্তানি সেনারা এখনো সশস্ত্র, যদি প্রয়োজন পড়ে! ঢাকা যখন জেনে যাবে পাকিস্তানি সেনারা কত পরিকল্পিতভাবে এই হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে, তখন দেখা দেবে সত্যিকারের সংকট। যা-ই ঘটুক, পরাজিত পাকিস্তানি সেনাদের জন্য সহানুভূতিপ্রবণ হওয়া বাঙালিদের জন্য ক্রমেই কঠিন হয়ে পড়ছে। এ রকম একটি সুশৃঙ্খল সেনাবাহিনী এভাবে খেলাচ্ছলে অপ্রয়োজনে, উন্মত্তের মতো খুন করতে পারে, তা অবিশ্বাস্য।
যদি পাইকারি হত্যাকাণ্ডকে সংবাদপত্র গণহত্যা আখ্যায়িত করে, তা অবশ্যই ভয়ংকর; কিন্তু পরিকল্পিতভাবে বাছাই করে জাতির সবচেয়ে যোগ্য, বুদ্ধিমান ও গুরুত্বপূর্ণ পুরুষ ও নারী হত্যার মাধ্যমে যদি জাতির ভবিষ্যৎ ধ্বংস করে দেওয়া হয়, সেই ‘এলিটোসাইড’ এলিট হত্যা যে আরও বেশি ভয়ংকর।
গত মঙ্গলবারের অনেক আগেই পাকিস্তান শেষ হয়ে গেছে। যেসব কর্মকর্তা এই পরিকল্পনা করেছেন, তাঁরাও তা অবশ্যই জানেন। কাজেই হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশকেও ধসিয়ে দেওয়া। বহুদিন ধরেই অনুমান করা হচ্ছিল, পাঞ্জাব মরুভূমির রুক্ষ সেনারা বাঙালিদের প্রতি হিংস্র বর্ণবাদী ঘৃণা লালন করে আসছে। এখন দেখা যাচ্ছে, তারা বুদ্ধিভিত্তিক ঈর্ষাও লালন করছে, যার প্রকাশ ঘটেছে এই ব্যাপক হত্যাকাণ্ডে।
ঈষৎ সংক্ষেপিত অনুবাদ: এম এ মোমেন
দ্য সানডে টাইমস, ১৯ ডিসেম্বর ১৯৭১
প্রথম আলো, ২৬ মার্চ ২০১১, পুনর্মুদ্রিত