বিদেশি তারকারা অন্য লিগে, রং হারাচ্ছে বিপিএল
Published: 14th, January 2025 GMT
শাহিন শাহ আফ্রিদির সঙ্গে ফরচুন বরিশালের চুক্তির খবর আলোড়ন তুলেছিল দেশে। পাকিস্তানি এ ফাস্ট বোলারকে একনজর দেখতে ভিড় পড়ে গিয়েছিল ঢাকা ও সিলেটে। সাংবাদিকদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতেও ছিলেন তিনি। কারণ, একাদশ বিপিএলের সবচেয়ে বড় বিদেশি তারকা ছিলেন তিনি। আরও নির্দিষ্ট করা হলে শাহিন শাহ-ই ছিলেন একমাত্র তারকা। কাইল মায়ার্স, অ্যালেক্স হেলস বা জেসন রয়রা হলেন জাতীয় দল থেকে বাদ পড়া তারকা।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে শেষের বাঁশি শোনার অপেক্ষায় থাকা এই ক্রিকেটাররাও বিপিএলে এসেছিলেন খ্যাপ খেলতে। শাহিন, হেলস, জেসনরা চলে যাওয়ায় বিদেশি তারকা শূন্য বলা যায় বিপিএলকে। শূন্যতার মাঝেও কিছুটা দ্যুতি ছড়াচ্ছেন ডেভিড মালান, মোহাম্মদ নবি, ইফতেখার আহমেদ, খুশদিল শাহ ও মোহাম্মদ ওয়াসিম।
বিপিএলের কেন এই হাল– প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। ঢাকার মেন্টর সাঈদ আজমল সমকালকে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, বাংলাদেশের ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগটি এভাবে মান হারালে টিকে থাকার সংকটে পড়বে। তাঁর মতে, ‘আমরা যখন খেলেছি, তখন একঝাঁক বিশ্ব তারকা খেলে গেছে। অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ থেকে খেলতে এসেছে। পাকিস্তানের জাতীয় দলের বেশির ভাগ ক্রিকেটার খেলেছে। সেখানে এখন সেই মানের কাউকেই দেখি না।
বিপিএলকে টিকিয়ে রাখতে হলে মান বাড়াতে হবে। বিদেশি তারকা ক্রিকেটার আনতে হবে।’ ২০১২ সালে বিপিএলের প্রথম আসরে ছিল বৈশ্বিক তারকাদের ছড়াছড়ি। ভারত ছাড়া ক্রিকেট খেলুড়ে সব বড় দেশের তারকারা খেলে গেছেন। ব্র্যাড হজ, লেন্ডল সিমন্স, ডোয়াইন ব্রাভো, জেসন রয়, নাসির জামশেদ, শহীদ আফ্রিদি, কাইরন পোলার্ড, ড্যারেন স্টিভেনস, সাঈদ আজমল, স্টুয়ার্ট ম্যাকগিল, নাভিদুল হাসান, ইমরান তাহির, জশ বাটলার, হার্শেল গিবস, সনাৎ জয়াসুরিয়া, ডোয়াইন স্মিথ, কামরান আকমল, পিটার ট্রেগো, ড্যারেন স্যামি, সোহাইল তানভীররা খেলেছেন। মাহেলা জয়াবর্ধনে, কুমার সাঙ্গাকারা, লাসিথ মালিঙ্গা, স্টিভেন স্মিথ, ডেভিড ওয়ার্নারও খেলে গেছেন বিপিএলে। বৈশ্বিক মানে আইপিএল ও বিগ ব্যাশের পরেই স্থান পেয়েছিল বাংলাদেশের লিগটি।
জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে বিপিএল ছিল আইপিএলের পরে। এক যুগের ব্যবধানে বিপিএল এখন মানহীন বিদেশি ক্রিকেটারের লিগ। যুক্তরাষ্ট্র, নেদারল্যান্ডস, জিম্বাবুয়ে দলের ক্রিকেটাররাই তারকা। পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ওয়েস্ট ইন্ডিজের দ্বিতীয় সারির ক্রিকেটার খেলছেন বাংলাদেশে। কারণ, বৈশ্বিক ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারছে না বিপিএল।
আরব আমিরাতের আইএল টি২০, দক্ষিণ আফ্রিকার এসএ২০তে বিদেশি ক্রিকেটার খেলেন বেশি। অস্ট্রেলিয়ার বিগ ব্যাশ মাতান দেশিরা। দেশটিতে প্রতিভাবান ক্রিকেটার এত বেশি যে, বিদেশি ক্রিকেটার খুব বেশি প্রয়োজন হয় না। সে কারণে কোয়ালিটি ক্রিকেট খেলা হলেও বিগ ব্যাশ সেভাবে বৈশ্বিক বাজার পায়নি। নিউজিল্যান্ডের টি২০ লিগে খেলছেন মাত্র পাঁচজন বিদেশি ক্রিকেটার। একসঙ্গে এত টি২০ লিগ চলায় পুরোনো লিগ হওয়া সত্ত্বেও নেতিবাচক প্রভাব বেশি পড়েছে বিপিএলে। আইসিসি তো আইএলকে আন্তর্জাতিক টি২০ ফ্র্যাঞ্চাইজির লিগের মর্যাদা দিয়েছে। আমিরাদের খেলোয়াড় কম থাকায় একাদশে ৯ জন বিদেশি নিয়ে খেলে তারা। এই লিগে ভারতীয় বিনিয়োগ থাকায় সম্মানী বেশি। হেলস, মায়ার্সরা তাই বিপিএল ছেড়ে খেলছেন আইএল টি২০তে। এ ছাড়া প্রতিটি দলে ৯ জন করে বিদেশি খেলার নিয়ম থাকায় বিরাট সংখ্যক আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার অন্তর্ভুক্ত থাকছে এক লিগে।
এসএ২০ লিগের মালিকও ভারতীয়রা। এ মুহূর্তে বৈশ্বিক তারকা ক্রিকেটার বেশি দক্ষিণ আফ্রিকার লিগটিতে। বিপিএলের মতো এসএ২০তেও চারজন করে বিদেশি খেলানোর নিয়ম। দেশের কোচরা মনে করেন, এই প্রতিযোগিতার মার্কেও মাঝারি বিনিয়োগে ভালো মানের ক্রিকেটার আনা সম্ভব দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা থাকলে। তবে বিপিএলের তুলনায় আইপিএল, পিএসএল ও সিপিএলের উইন্ডো অন্য সময় হওয়ায় দিন দিন ভালো করছে।
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
পারভেজ হত্যা: রাজনীতির বাইরের দিক
পারভেজের মা আহাজারি করেছেন– ‘পুতের মুহেত্তে একটাবার মা ডাক হুনবার চাই’। কিন্তু খুন হওয়া ছেলে তো আর মা ডাকার জন্য ফিরে আসবে না। গীতিকার মিল্টন খন্দকার লিখেছেন, ‘মা তুমি আমার আগে যেও না গো মরে’।
সেখানে ছেলের আহাজারি– ‘এই পৃথিবীর আলো আমায় যে দেখালো, তাকে মাটি দিবো কী করে’। আর এখানে মায়ের আকুতি একবারের জন্য ছেলের মুখ থেকে মা ডাক শোনার। মৃত্যু এমনই এক নির্মম বাস্তবতা, কোনো মায়ার বাঁধনেই তাকে বাঁধা যায় না। এটি এমনই এমন নিয়তি, কার আগে কে যাবে, তার ঠিক নেই। পারভেজ যেমন মায়ের আগেই চলে গেলেন।
জাহিদুল ইসলাম পারভেজ রাজধানীর প্রাইমএশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন। সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন বলছে, হাসাহাসির মতো তুচ্ছ বিষয় নিয়ে তাঁকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। পারভেজ ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ছাত্রদল তাঁর হত্যার মদদদাতা হিসেবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে অভিযুক্ত করেছে। অন্যদিকে এ অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বিবৃতি দিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
তুচ্ছ বিষয় কীভাবে খুনের কারণ হয়, তা নিয়েই বরং আলোচনা। তরতাজা এক তরুণ বন্ধুদের সঙ্গে হাসাহাসি করছিলেন– তার কারণ জানতে গিয়ে বাগ্বিতণ্ডা, এর পর ধাওয়া করে ছুরিকাঘাতে মেরে ফেলা! কতটা ভয়ংকর! পারভেজের বন্ধু তরিকুলকেও ছুরিকাঘাত করা হয়। এ ঘটনায় পারভেজের ভাই বনানী থানায় ৮ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেছেন।
মামলার এজাহার থেকে জানা যাচ্ছে, পারভেজ তাঁর বন্ধু টেক্সটাইল বিভাগের তরিকুল, সুকর্ণ, ইমতিয়াজসহ কয়েকজন বনানীর প্রাইমএশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপরীতে একটি দোকানে কথাবার্তা ও হাসাহাসি করছিলেন। তাদের পার্শ্ববর্তী প্রতিষ্ঠান ইউনিভার্সিটি অব স্কলারসের দুই ছাত্রী দাঁড়িয়ে ছিলেন। এ সময় আসামি মেহেরাজ, পিয়াস ও মাহাথি হাসাহাসির কারণ জানতে চান। এ নিয়ে তর্কাতর্কি হলে তিন শিক্ষক বিষয়টি মীমাংসা করে দেন। এর পর পারভেজকে পেয়ে আসামিরা ছুরিকাঘাত করেন। একইভাবে তরিকুলও আক্রান্ত হন। পরে রক্তাক্ত অবস্থায় দু’জনকে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক পারভেজকে মৃত ঘোষণা করেন।
এ হত্যাকাণ্ডে নারীসংশ্লিষ্টতার বিষয়ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচিত হয়েছে। কিন্তু এটা স্পষ্ট, সাধারণ বিষয় থেকেই ঘটনার সূত্রপাত। আরও বিস্ময়কর, শিক্ষকরা প্রারম্ভিকভাবে শিক্ষার্থীদের মীমাংসার চেষ্টাও করেছিলেন। তার পরও আক্রমণকারীরা ক্ষান্ত হয়নি! তারা এতটা বেপরোয়া হলো কীভাবে? পুলিশ এ হত্যা মামলার প্রধান আসামি মেহেরাজ ইসলামসহ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করেছে। তাদের বিচার নিশ্চয় দেখার অপেক্ষা।
ইতোপূর্বে আমরা কিশোর গ্যাংয়ের হাতে খুন হওয়ার ঘটনা দেখেছি। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে যারা পড়াশোনা করেন, অন্তত তাদের মধ্যে এক ধরনের ‘ম্যাচিউরিটি’ আসে। এমন সমবয়সী তরুণদের মধ্যে হাস্যরসের স্বাভাবিক ঘটনার মধ্যে এমন খুন অস্বাভাবিক। অবশ্য রাজনৈতিক বিবাদ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে খুনোখুনির ঘটনা ঘটেছে ইতোপূর্বে। দুই দলের মধ্যে কিংবা দলীয় কোন্দলে আধিপত্য বিস্তারের ঘটনা থেকে সংঘর্ষে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর প্রাণহানি ঘটেছে। এখন সেই রাজনৈতিক পরিস্থিতি নেই বললেই চলে। এখানকার হত্যাকাণ্ডের কারণ হতে পারে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা; নিজেদের বীরত্ব জাহির করা কিংবা অস্বাভাবিক ক্রোধ। পারভেজের ক্ষেত্রে কোনটা হয়েছে, বলা মুশকিল। তবে কোনোটিই প্রত্যাশিত নয়।
একই সঙ্গে ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। দিনদুপুরে এভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনেই হত্যাকাণ্ড ঘটল! বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তো নিজেদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকা উচিত। এখানকার শিক্ষার্থীদের মধ্যে সহনশীলতাও যে কমে যাচ্ছে– তা স্পষ্ট। টেকসই সমাজের জন্য সেই সহনশীলতা জরুরি। উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে পড়াশোনা করেও যদি শিক্ষার্থীদের মধ্যে সহনশীলতা তৈরি না হয়, তবে তা হতাশাজনক।
পারভেজ ছিলেন মা-বাবার একমাত্র ছেলে। সন্তানের শূন্যতা মাতা-পিতার চেয়ে আর কে বেশি অনুভব করেন? পারভেজ ফিরবেন না সত্য, কিন্তু এভাবে আর কোনো মায়ের বুক যেন খালি না হয়।
মাহফুজুর রহমান মানিক: জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক, সমকাল
mahfuz.manik@gmail.com