গাজায় যুদ্ধবিরতি এবং জিম্মিদের মুক্তি দিতে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের মধ্যে একটি চুক্তির শর্তাবলি চূড়ান্ত করা হচ্ছে। এ সংক্রান্ত আলোচনা সম্পর্কে অবগত এক ফিলিস্তিনি কর্মকর্তা বিবিসিকে এ কথা বলেছেন।

চুক্তির শর্ত চূড়ান্ত হওয়ার বিষয়টি এমন সময় সামনে এল যখন হোয়াইট হাউসের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান বলেছেন, ‘চলতি সপ্তাহে’ একটি যুদ্ধবিরতি ও জিম্মিদের মুক্তি সংক্রান্ত চুক্তি হতে পারে।

ইসরায়েলি এক কর্মকর্তা বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেছেন, আলোচনা অনেক দূর এগিয়েছে। কয়েক ঘণ্টা, দিন বা এর বেশি সময়ের মধ্যে চুক্তি হওয়া সম্ভব। 

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন গত রোববার ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে কথা বলেছেন। এ ছাড়া গতকাল সোমবার তিনি কাতারের আমির তামিম বিন হামাদ আল-থানির সঙ্গেও আলাপ করেছেন, যিনি গাজায় যুদ্ধবিরতির জন্য মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করছেন।

জ্যাক সুলিভান বলেছেন, মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদুল ফাত্তাহ আল-সিসির সঙ্গেও আলাপ করার কথা রয়েছে জো বাইডেনের।

এদিকে ইসরায়েলের ক্ষমতাসীন জোটের ভেতর থেকে সম্ভাব্য যুদ্ধবিরতি চুক্তির তীব্র বিরোধিতা করা হচ্ছে। নেতানিয়াহুর দল লিকুদ পার্টির কয়েকজনসহ জোটের ১০ জন ডানপন্থী সদস্য যুদ্ধবিরতির বিরোধিতার করে তাঁত কাছে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন।

 ফিলিস্তিনের যে কর্মকর্তা যুদ্ধবিরতির চুক্তির শর্ত চূড়ান্ত হওয়ার বিষয়টি জানিয়েছেন, তিনি বিবিসিকে আরও বলেন, সোমবার ইসরায়েল ও হামাসের কর্মকর্তারা একই ভবনের ভেতরে পরোক্ষ আলাপ-আলোচনা করেছেন।

যুদ্ধবিরতি চুক্তির কিছু সম্ভাব্য বিবরণ প্রকাশ করে ফিলিস্তিনি ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘বিস্তারিত কৌশলগত আলোচনার জন্য যথেষ্ট সময় লেগেছে।’

উভয় পক্ষ রাজি হয়েছে যে, চুক্তির প্রথম দিন হামাস তিন জিম্মিকে মুক্তি দেবে। এর পর ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলো থেকে সেনা প্রত্যাহার শুরু করবে ইসরায়েল।

এর সাত দিন পর হামাস আরও চার জিম্মিকে মুক্তি দেবে। দক্ষিণ গাজা থেকে বাস্তুচ্যুত মানুষদের উত্তর গাজায় ফেরার অনুমতি দেবে ইসরায়েল। তবে তাঁরা শুধু উপকূলীয় রাস্তা দিয়ে হেঁটে ফিরতে পারবেন। সালাহ আল-দিন সড়ক সংলগ্ন একটি পথ দিয়ে কার, পশু–চালিত গাড়ি ও ট্রাক চলাচলের অনুমতি দেওয়া হবে। কাতার ও মিসরের পরিচালিত একটি এক্স-রে মেশিনের মাধ্যমে এ পথ দিয়ে গাড়ি চলাচল পর্যবেক্ষণ করা হবে।

চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, ইসরায়েলি সেনারা ফিলাডেলফি করিডরে নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখবে। চুক্তির প্রথম ধাপ ৪২ দিন পর্যন্ত স্থায়ী হবে। এ সময় পূর্ব ও উত্তর সীমান্তে ৮০০ মিটার নিরপেক্ষ অঞ্চল হিসেবে বজায় থাকবে।

ইসরায়েল এক হাজার ফিলিস্তিনি বন্দীকে মুক্তি দিতে রাজি হয়েছে। এর মধ্যে ১৯০ জন ১৫ বছর কিংবা তারও বেশি সময় ধরে সাজা ভোগ করছেন। বিনিময়ে হামাস ৩৪ জিম্মিকে মুক্তি দেবে।

যুদ্ধবিরতির ১৬তম দিনে চুক্তির দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপ নিয়ে আলোচনা শুরু হবে।

এদিকে গাজার বেসামরিক প্রতিরক্ষা সংস্থা জানিয়েছে, সোমবার গাজা সিটিতে ইসরায়েলি বিমান হামলায় ৫০ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন।

বেসামরিক প্রতিরক্ষার মুখপাত্র মাহমুদ বাসাল এএফপিকে বলেন, ‘তারা (ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী) স্কুল, বাড়িঘর এমনকি জনসমাগমের মধ্যেও বোমা নিক্ষেপ করেছে।’

আরও পড়ুনস্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবের চেয়ে গাজায় নিহতের প্রকৃত সংখ্যা ৪১ শতাংশ বেশি: ল্যানসেটের গবেষণা১০ জানুয়ারি ২০২৫

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাস দক্ষিণ ইসরায়েলে এক ভয়াবহ হামলা চালায়। এতে ১ হাজার ২৫০ জন নিহত হয়। ২৫১ জনকে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যায় হামাস যোদ্ধারা। আর এ হামলাকে কেন্দ্র করে গাজা যুদ্ধের সূত্রপাত।

ওই হামলার প্রতিক্রিয়ায় হামাসকে নিশ্চিহ্ন করতে গাজায় সামরিক অভিযান শুরু করে ইসরায়েল।

গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, যুদ্ধে এ পর্যন্ত ৪৬ হাজার ৫০০ জনের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।

ইসরায়েল বলেছে, জিম্মিদের মধ্যে ৯৪ জন এখনো গাজায়। ৩৪ জন মারা গেছেন। এ ছাড়া যুদ্ধের আগে অপহরণ হওয়া চার ইসরায়েলির মধ্যে দুজন মারা গেছেন।

আরও পড়ুন:

আরও পড়ুনযুদ্ধাপরাধের বিচারের ভয় পেয়ে বসেছে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীকে০৯ জানুয়ারি ২০২৫আরও পড়ুনগাজায় দায়িত্ব পালন করা ইসরায়েলি সেনারা বিদেশে গ্রেপ্তার হতে পারেন০৬ জানুয়ারি ২০২৫.

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

ঢেকে রাখা সেই মুক্তিযুদ্ধের ম্যুরালে শেখ মুজিবের স্মৃতিচিহ্ন ভেঙে ফেলা হলো   

লালমনিরহাট শহরের শিশুপার্ক সংলগ্ন মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিমঞ্চে স্থাপিত ম্যুরালের কিছু অংশ ভেঙে ফেলেছে জেলা প্রশাসন। ২৬ মার্চ জেলা প্রশাসন ওই ম্যুরালটি কাপড় দিয়ে ঢেকে অনুষ্ঠান পরিচালনা করে। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লেখালেখি ও গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। কাপড় দিয়ে ম্যুরাল ঢেকে দেওয়ার ঘটনায় মুখোমুখি অবস্থান নেয় জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম পার না হতেই রোববার জেলা প্রশাসন মুক্তিযুদ্বের স্মৃতিচিহ্ন  ম্যুরাল ভাঙার কাজে হাত দেয়। 

এর আগে শনিবার দুপুুরে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি মঞ্চে দু’টি পক্ষ একই সময়ে সংবাদ সম্মেলনের ডাক দিলে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দুপুর সাড়ে ১১টায় ওই এলাকায় সংবাদ সম্মেলন করলেও জাতীয় নাগরিক পার্টি করতে পারেননি। 

মুক্তিযুদ্ব স্মৃতি মঞ্চে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের লালমনিরহাট শাখার প্রধান সমন্বয়ক হামিদুর রহমান ম্যুরাল অপসারণ ও শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি সরাতে ৪৮ ঘণ্টার সময় বেঁধে দেন। এ সময় তিনি দাবি করে বলেন, ‘এই ম্যুরালটি স্বাধীন বাংলাদেশের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস বহন করে না। বাকশাল প্রতিষ্ঠাকারী স্বৈরাচার শেখ মুজিবুর রহমানকে অতিরঞ্জিত উপস্থাপন ও ইতিহাস বিকৃতি করায় এর আগেও ১৬ ডিসেম্বর জেলা প্রশাসন ম্যুরালটি ঢেকে অনুষ্ঠান পরিচালনা করেছিল। প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৫২, ৭১ এর সকল সত্য ইতিহাস অক্ষুণ্ণ রেখে অতিরঞ্জিত অংশ ও স্বৈরাচারের চিহ্ন ঢেকে দেওয়ার নির্দেশনা ছিল। কিন্তু ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট তা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে পুরো দেয়াল ঢেকে দেয়, যা অনাকাঙ্খিত। কিছু স্বৈরাচারের দোসর তাদের ব্যক্তিগত  আক্রোশ, স্বার্থ উদ্ধার ও বর্তমান সরকারের কার্যক্রমকে বিতর্কিত করতে জেলা প্রশাসনের কার্যক্রমকে ভুলভাবে প্রচার করতে থাকে এবং বিদ্বেষবশত মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। ম্যুরাল ঢেকে দেওয়ার বিষয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন অবগত ছিল না, তাঁরা এমন কোনো দাবিও করে নাই। স্বৈরাচারের সকল চিহ্ন ও ম্যুরাল অপসারণ ছাত্রজনতার দাবি ও গণআকাঙ্খা।’ 

সংবাদ সম্মেলন শেষে জেলা মুক্তিযোদ্ধা দলের মুক্তিযোদ্ধারা স্মৃতিসৌধ এলাকায় যান। সেখানে জেলা মুক্তিযোদ্ধা দলের সভাপতি হাফিজুর রহমান হাফিজ জানান, ম্যুরালের মধ্যেই বৈষম্য রয়েছে। স্বাধীনতা যুদ্ধে শেখ মুজিবুর রহমানে যেমন অবদান রয়েছে তেমনি স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমানেরও অবদান রয়েছে। অথচ ম্যুরালে জিয়াউর রহমানের কোনো স্মৃতিচিহ্ন নেই। এটা বৈষম্য। এই ম্যুরাল রাখা ঠিক নয়।   

শনিবার জাতীয় নাগরিক পার্টির কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক কমিটির সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) রাসেল আহমেদ জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সামনে গেলে তোপের মুখে পড়েন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা তাঁকে ঘিরে ধরেন। এ সময় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, এই ম্যুরালে ৫২ ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকার গঠন, চরমপত্র পাঠ, ৭১ এর গণহত্যা, বিজয় উল্লাসে মুক্তিযোদ্ধা, সাতজন বীরশ্রেষ্ঠ ও পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের স্মৃতিচিহ্ন ঢেকে দিয়ে চরম ধৃষ্ঠতা দেখিয়েছেন জেলা প্রশাসন। পরে তাঁরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ওপর দায় চাপিয়েছেন। ৭১ ও ২৪কে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে জাতিকে বিভাজিত করে আওয়ামী এজেন্ডা বাস্তবায়নের ষড়যন্ত্র চলছে। মহান মুক্তিযুদ্ধ ও ৭১ এর অস্তিত্ব ধরে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি বাদ দিয়ে অন্যগুলোর সঙ্গে আমাদের কোনো মতানৈক্য নেই। 
 
২৬ মার্চ বুধবার সকালে সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) পক্ষ থেকে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধে শ্রদ্বাঞ্জলি দিতে গেলে কাপড় দিয়ে মুরাল ঢেকে রাখার বিষয়টি চোখে পড়ে। সনাক সদস্যরা এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে ফিরে যান। পরে লালমনিরহাট রেলওয়ে শহীদ স্মৃতিসৌধে শ্রদ্বাঞ্জলি দেন তাঁরা। গত ১৬ ডিসেম্বরও একই রকম ঘটনা ঘটায় জেলা  প্রশাসন। ১৪০ ফুট দীর্ঘ ওই ম্যুরালে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ, মুজিবনগর সরকার গঠন, চরমপত্র পাঠ, উদিত সূর্য, ৭১ এর গণহত্যা, মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক এম এ জি ওসমানি, সাতজন বীরশ্রেষ্ঠ ও পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের স্মৃতিচিহ্ন রয়েছে।  

এ ব্যাপারে লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক এইচ এম রকিব হায়দারের বক্তব্য জানতে তাঁর ফোনে মেসেজ এবং ফোন দিলে কোনো সাড়া মেলেনি।  

সম্পর্কিত নিবন্ধ