পাঠ্যবই থেকে ‘আদিবাসী’ শব্দযুক্ত গ্রাফিতি বাদ দেওয়ার সমালোচনা
Published: 13th, January 2025 GMT
নবম ও দশম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ের পেছনের প্রচ্ছদ থেকে ‘আদিবাসী’ শব্দযুক্ত গ্রাফিতি বাদ দেওয়ার সমালোচনা করেছেন একটি আলোচনা সভার বক্তারা। তাঁরা বলেছেন, নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা নিয়ে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর অজানা ভয়-আতঙ্ক অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে আরও বেড়েছে।
বাংলাদেশ জাতীয় আদিবাসী পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেনের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত স্মরণসভায় বক্তারা এ কথাগুলো বলেন। সোমবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এই সভার আয়োজন করে রবীন্দ্রনাথ সরেনের সহযোদ্ধা ও সুহৃদ সবাই। স্মরণসভার শুরুতে রবীন্দ্রনাথ সরেনের প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে ও তাঁর স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
এ বছর প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের নতুন পাঠ্যবইয়ে গল্প-কবিতা, সংকলন এবং ছবি ও গ্রাফিতির মাধ্যমে নানাভাবে উঠে এসেছে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের কথা। এর মধ্যে নবম ও দশম শ্রেণির বাংলা ভাষার ব্যাকরণ ও নির্মিতি বইয়ের পেছনের প্রচ্ছদে ‘আদিবাসী’ শব্দ থাকা একটি গ্রাফিতি যুক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু ‘স্টুডেন্ট ফর সভারেন্টি’ নামে একটি সংগঠনের আপত্তির মুখে সেই গ্রাফিতি বাদ দিয়ে নতুন একটি গ্রাফিতি যুক্ত করা হয়েছে।
এর সমালোচনা করে স্মরণসভায় অধিকারকর্মী খুশী কবির বলেন, যাঁরা জুলাই আন্দোলনে ছিলেন, তাঁরা বই থেকে ‘আদিবাসী’ শব্দ বাদ দেওয়ার পক্ষে নন। কারণ, তাঁরা যদি বাদ দেওয়ার পক্ষে থাকতেন, তাহলে গ্রাফিতিতে ‘আদিবাসী’ শব্দ থাকত না।
বাংলাদেশ যে বৈচিত্র্য, বহুত্ববাদ, বহুধর্ম, বহুভাষা, বহুমতের দেশ—এই বার্তা ওই প্রচ্ছদে ছিল বলে উল্লেখ করেন অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (এএলআরডি) নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা। তিনি বলেন, গ্রাফিতি কারও ব্যক্তিসম্পত্তি নয়। এটি গণ–অভ্যুত্থানের একটি অংশ। এর অসম্মান মেনে নেওয়া হবে না। যদি কোনো গোষ্ঠী এর বিরুদ্ধে কথা বলে, তাদের মুখোশ উন্মোচন করা দরকার।
‘আদিবাসী’ শব্দযুক্ত গ্রাফিতি বাদ দেওয়ার প্রতিবাদ জানান বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক। বৈষম্য নিরসন ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ বিনির্মাণে শ্রমিক, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীসহ সবাইকে নিয়ে আলোচনা শুরু করার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
এ বিষয়ে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন (প্রিন্স) বলেন, কেউ এসে কিছু একটা বলে গেল, আর সঙ্গে সঙ্গে পাঠ্যবই পরিবর্তন হয়ে গেল। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর অস্তিত্ব রক্ষা নিয়ে একধরনের অজানা ভয়-আতঙ্ক যে আছে, সেটা আরও বেড়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে।
অন্তর্বর্তী সরকারের অন্তরে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জায়গা আছে কি না, সেই প্রশ্ন রেখে বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) সহসাধারণ সম্পাদক রাজেকুজ্জামান রতন বলেন, এই দেশ সবার হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দেশটা শুধু কেন বাঙালিদের করে রাখা হলো?
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় সদস্য দীপায়ন খীসা বলেন, রবীন্দ্রনাথ সরেন জ্বর গায়ে সারা দিন মিছিল করেছেন। লড়াই–সংগ্রামে দমে না যাওয়ার প্রবণতায় সরেন অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবেন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মাহমুদুল সুমন বলেন, সমতলের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জন্য পৃথক ভূমি কমিশন করার স্বপ্ন দেখতেন রবীন্দ্রনাথ সরেন। সেই স্বপ্ন এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
স্মরণসভায় রবীন্দ্রনাথ সরেনের ওপর উপস্থাপনা করেন লেখক ও গবেষক পাভেল পার্থ।
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সহসাধারণ সম্পাদক গজেন্দ্রনাথ মাহাতোর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন নাগরিক উদ্যোগের প্রধান নির্বাহী জাকির হোসেন, জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি বিচিত্রা তির্কি।
অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন বাংলাদেশ আদিবাসী যুব ফোরামের সহসভাপতি টনি ম্যাথিউ চিরান।
আরও পড়ুনপাঠ্যবইয়ের পেছনের প্রচ্ছদ থেকে ‘আদিবাসী’ শব্দযুক্ত গ্রাফিতি বাদ, যুক্ত হলো নতুন গ্রাফিতি১২ জানুয়ারি ২০২৫.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
বাংলা ভাষায় চিকিৎসাবিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করেছিলেন শুভাগত চৌধুরী
বাংলা ভাষায় চিকিৎসাবিজ্ঞানকে যাঁরা জনপ্রিয় করেছেন, তাঁদের অন্যতম ছিলেন অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরী। তিনি চিকিৎসাবিজ্ঞান নিয়ে বাংলায় নিয়মিত লিখতেন। বাংলা ভাষায় চিকিৎসাবিজ্ঞানের পরিভাষা জানার জন্য চিকিৎসকদের অনেকে তাঁর কাছে ছুটে যেতেন।
অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরীর এক স্মরণসভায় চিকিৎসক এবং তাঁর পরিবারের সদস্যরা এ কথাগুলো বলেন। গতকাল শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মিল্টন হলে এই স্মরণসভার আয়োজন করা হয়।
শুভাগত চৌধুরীর ভাই ও চিকিৎসক অরূপ রতন চৌধুরী বলেন, স্বাস্থ্যের জটিল বিষয়গুলোকে মানুষের মধ্যে নিয়ে আসা একটা বিরাট শিল্প। সেই কাজ জোর দিয়ে করেছিলেন শুভাগত চৌধুরী। স্বাস্থ্য নিয়ে বাংলায় তাঁর লেখাগুলো একটা ভিন্নতা এনে দিয়েছিল।
এরপর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম’ গানটি গেয়ে ভাইয়ের স্মৃতিচারণা শেষ করেন অরূপ রতন চৌধুরী। গানের সময় শুভাগত চৌধুরীর স্বজন ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েন।
স্মরণসভায় সরকারের নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের সদস্য হালিদা হানুম আখতার বলেন, শুভাগত চৌধুরীর সর্বদা হাসিমুখ থাকত। তিনি সবার সঙ্গে একটা ভালোবাসার জায়গা থেকে কথা বলতেন।
হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালের চেয়ারম্যান লেলিন চৌধুরী বলেন, চিকিৎসাবিজ্ঞান বিষয়ে বাংলা ভাষায় যাঁরা লেখালেখি শুরু করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন শুভাগত চৌধুরী। আমরা বাংলা ভাষায় চিকিৎসাবিজ্ঞানের পরিভাষা জানার জন্য, নতুন শব্দ উদ্ভাবনের জন্য শুভাগতের কাছে যেতাম।
স্মরণসভায় অনলাইনে যুক্ত হয়ে হারমনি ট্রাস্টের প্রতিষ্ঠাতা অমিতাভ ভট্টাচার্য বলেন, বাংলা ভাষায় স্বাস্থ্য বিষয়ে দুই বাংলায় প্রথম দিকে যাঁরা নিয়মিত লেখালেখি করতেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন শুভাগত। উনি একজন দার্শনিকের প্রজ্ঞা নিয়ে চিকিৎসা বিজ্ঞানকে দেখতেন।
শুভাগত চৌধুরী জটিল বিষয়কে সহজ, সরল ও প্রাণবন্ত ভাষায় উপস্থাপন করতে পারতেন বলে উল্লেখ করেন ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক মনীন্দ্র নাথ রায়।
শুভাগত চৌধুরীর স্ত্রী কামনা চৌধুরী বলেন, উনি চোখের অন্তরালে চলে গেছেন; কিন্তু আমার এবং অসংখ্য মানুষের হৃদয়ে আছেন ও থাকবেন।
মেয়ে সুস্মিতা চৌধুরী বলেন, আমার বাবা সত্যিকারভাবেই জীবনকে উদ্যাপন করতে শিখিয়েছেন। ভালোবাসাপূর্ণ হৃদয় নিয়ে বাবা কর্মজীবন ও সাংসারিক জীবনের জটিল বিষয় সহজে সমাধান করতেন।
অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন জনস্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞ আবু জামিল ফয়সাল। তিনি বলেন, ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার পরও শুভাগত চৌধুরী সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন। তারপর আকস্মিকভাবে তিনি পরপারে পাড়ি জমালেন। তিনি মানুষের জন্য কাজ করেছেন। পদ-পদবির চিন্তা করতেন না। শুভাগত বলতেন, তিনি যে কাজ করছেন, পদ-পদবি নিলে তা করতে পারবেন না।
স্মরণসভায় আরও বক্তব্য দেন অধ্যাপক মাহফুজা খানম, শুভাগত চৌধুরীর সহকর্মী চিকিৎসক মারুফি খানম, অধ্যাপক সৈয়দ আব্দুল হামিদ, সেন্টার ফর ক্যানসার কেয়ার ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক জাহান ই গুলশান প্রমুখ।