এডিপিতে কাটছাঁট হচ্ছে ৪৯ হাজার কোটি টাকা
Published: 13th, January 2025 GMT
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের নেওয়া উন্নয়ন প্রকল্পগুলো কতটা প্রয়োজনীয়, তা পর্যালোচনা করছে অন্তর্বর্তী সরকার। এতে অনেক প্রকল্প বাদ পড়েছে। আবার কিছু প্রকল্পের বরাদ্দ কমানো হয়েছে। এ প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে। অর্থাৎ আরও প্রকল্প বাদ পড়তে পারে। বরাদ্দ কমতে পারে। অন্যদিকে গণঅভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে সরকার পরিবর্তন এবং অস্থিতিশীল পরিস্থিতির ধাক্কা লেগেছে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডেও। চলতি অর্থবছরের নভেম্বর পর্যন্ত গত পাঁচ মাসে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বাস্তবায়নের হার গত ১৪ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম।
এমন বাস্তবতায় এডিপির আকার ছোট করে আনা হচ্ছে। মূল এডিপি থেকে ৪৯ হাজার কোটি টাকা ছেঁটে ফেলা হচ্ছে। এতে সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বা আরএডিপির আকার দাঁড়াচ্ছে ২ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছর মূল এডিপির আকার ২ লাখ ৭৮ হাজার ২৮৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে বিদেশি ঋণের পরিমাণ ধরা হয় ১ লাখ কোটি টাকা। জিওবি বা সরকারি তহবিল থেকে রয়েছে ১ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। বাকিটা বাস্তবায়নকারী বিভিন্ন সংস্থার নিজস্ব অর্থায়ন। শিগগির আরএডিপি-সংক্রান্ত খসড়া চূড়ান্ত করা হবে। এর পর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদে (এনইসি) তা অনুমোদনের জন্য তোলা হবে।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, এডিপিতে সরকারের নিজস্ব জোগান এবং বিদেশি ঋণ– দুই উৎসের অর্থই কমানো হচ্ছে। নিজস্ব জোগান থেকে পরিমাণে বেশি কমানো হচ্ছে। প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা কমনো হচ্ছে এ অংশের অর্থ বরাদ্দ। এতে আরএডিপিতে সরকারের নিজস্ব জোগানের পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে ১ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকা। অন্যদিকে আরএডিপিতে বিদেশি ঋণের উৎস থেকে ১৯ হাজার কোটি টাকা কমানো হচ্ছে। এতে বিদেশি ঋণের মোট পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে ৮১ হাজার কোটি টাকা।
পরিকল্পনা কমিশনের এক কর্মকর্তা সমকালকে জানান, মন্ত্রণালয়গুলোর কাছ থেকে পাওয়া সংশোধিত চাহিদার ভিত্তিতে আরএডিপির খসড়া তৈরি করেছেন তারা। প্রধান উপদেষ্টা ড.
গত অর্থবছর মূল এডিপি থেকে ১৮ হাজার কোটি টাকা কমিয়ে আরএডিপি চূড়ান্ত হয়। মূল এডিপিতে কাটছাঁট হয় ৬ দশমিক ৮৪ শতাংশ। এতে আরএডিপির আকার ২ লাখ ৭৫ কোটিতে নেমে আসে। ওই বছর মূল এডিপির আকার ছিল ২ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা।
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
হদিস মিলছে না ভর্তুকির ৮ কম্বাইন হারভেস্টারের
আকাশে মেঘের ঘনঘটা। অনেক শ্রমের ধান মাঠ থেকে গোলায় তুলতে দিশেহারা কৃষক। ধান কাটা শ্রমিক পাওয়া গেলেও মজুরি অনেক বেশি। কৃষক যেন কম খরচে ধান কাটতে পারেন, সে জন্য সরকার ৫০ শতাংশ ভর্তুকি দিয়ে সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পের আওতায় ত্রিশাল উপজেলায় আটটি কম্বাইন হারভেস্টার বিতরণ করে। এসব যন্ত্রের হদিস মিলছে না ত্রিশালে। কেউ কেউ বিক্রি করে দিয়েছেন অন্য জেলায়।
জানা গেছে, ২০২০-২১ অর্থবছর থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত কৃষি বিভাগ ত্রিশাল উপজেলায় ৫০ শতাংশ ভর্তুকি দিয়ে কৃষকের মাঝে ৩১ লাখ টাকা মূল্যের আটটি কম্বাইন হারভেস্টার বিতরণ করেছে। যার আনুমানিক মূল্য ২ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। ৫০ শতাংশ ভর্তুকির হিসাবে কৃষি
বিভাগকে আনুমানিক দিতে হয়েছে ১ কোটি ২৪ লাখ টাকা। তবে প্রয়োজনে মেলে না সেবা প্রদানকারীদের খোঁজ। অডিটের সময় যন্ত্রের গ্রাহকদের পাওয়া যায় বলে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা দাবি করলেও আটজনের মধ্যে ছয়জনের ফোন নম্বর বন্ধ
পেয়েছে সমকাল।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, কৃষক তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করলেও কম্বাইন হারভেস্টার পাওয়া আটজনের মধ্যে কেউ প্রকৃতপক্ষে কৃষক নন। কাঁঠাল ইউনিয়নের বিলবোকা গ্রামের মোসলেম উদ্দিনের কোনো কৃষিজমি নেই, বর্গাচাষিও ছিলেন না কোনোদিন। পেশায় তিনি ভ্যানচালক হলেও ২০২০-২১ অর্থবছরে তাঁর নামে বরাদ্দ হয় কম্বাইন হারভেস্টার। তাঁর ছেলে আলম মিয়া শ্বশুরবাড়ি ও স্থানীয় কয়েকটি এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে ১০ লাখ টাকা পরিশোধ করলেও এক বছরের মাথায় যন্ত্রটি নিয়ে যায় কোম্পানি। যন্ত্র সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানে ভর্তুকির ১৪ লাখ ও গ্রাহকের ১০ লাখ টাকাসহ জমা পড়ে ২৪ লাখ টাকা। ৫ বছর ধরে এ টাকা
কোম্পানির কাছে পড়ে থাকলেও কী কারণে কৃষি বিভাগ কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না, তার রহস্য জানা নেই ভুক্তভোগী আলমের।
একই গ্রামের হাসেম উদ্দিনের নামে ২০২১-২২ অর্থবছরে বরাদ্দ হয় একটি কম্বাইন হারভেস্টার। তাঁর নেই এক টুকরো ফসলি জমি। বাঁশ দিয়ে নানা উপকরণ তৈরি করে বিক্রি করে সংসার চলে তাঁর। কীভাবে পেলেন ওই যন্ত্র? জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি কিছু জানি না। আমার ভোটার আইডি কার্ড নিয়ে ভাগনিজামাই মনোয়ার কাদের মাধ্যমে কীভাবে করেছে আমি জানি না।’ কৃষক তালিকায় নাম থাকলে মেলে সার, বীজসহ নানা প্রণোদনা, সেটা পান কিনা– এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘কই কিছুই তো পাইলাম না কোনোদিন।’
একই ইউনিয়নের ডুগুলিয়া গ্রামের মাইন উদ্দিনের ছেলে ওয়ার্কশপ মিস্ত্রি আল আমিনের নামেও ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বরাদ্দ হয়েছে একটি কম্বাইন হারভেস্টার। গুচ্ছগ্রামের বাসিন্দা আল আমিনেরও নেই ফসলি জমি। হারভেস্টার পেতে কোনো দিন আবেদনও করেননি বলে দাবি তাঁর। তিনি বলেন, ‘আমার ওস্তাদ মনোয়ার আমাকে একটি সরকারি ধান কাটার মেশিনের পার্টনার বানাবেন বলে ভোটার আইডি কার্ডসহ কৃষি অফিসে নিয়ে গেলেন। কিছু কাগজপত্রে সই দিতে বললে আমি দিলাম। কাগজেপত্রে আমার নাম থাকলেও মূল মালিক মনোয়ার ভাই।’ তাঁর ভাষ্য, অবশ্য এর আগে তাঁর কাছে গিয়েছিলেন হারভেস্টার সরবরাহকারী এসিআই কোম্পানির এসআর। তিনি বলেছিলেন, মনোয়ারের কাছে এ এলাকার ভোটার আইডি কার্ড নেই, আপনার আইডি কার্ড দিয়ে তুলতে হবে মেশিনটি।
কে এই মনোয়ার? খোঁজ নিয়ে জানা যায় তাঁর বাড়ি শেরপুর জেলায়। পেশায় তিনি ড্রাম ট্রাকের চালক। বিয়ে করেছেন বিলবোকা গ্রামের মোসলেম উদ্দিনের মেয়েকে। উপজেলা কৃষি অফিসের দুর্নীতিবাজ চক্রের সঙ্গে সম্পর্ক তাঁর। ওই চক্রের মাধ্যমে কৃষক কিংবা স্থানীয় না হয়েও দুটি কম্বাইন হারভেস্টার যন্ত্রের মালিক বনে গেছেন।
যন্ত্রটি ত্রিশালের কৃষকদের চাহিদা পূরণের জন্য বরাদ্দ হলেও পুরো মৌসুমে তিনি চুক্তিতে ধান কাটতে চলে যান দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। এ বিষয়ে মনোয়ারের ভাষ্য, ত্রিশালের কৃষক এই মেশিনে ধান কাটতে চান না। যারা কাটেন, তারাও খরচ পরিশোধে ঝামেলা করেন।
স্থানীয় কৃষক তালেব আলী জানান, ধান কাটার মৌসুম শুরু হওয়ার আগেই তিনি ওই মেশিন নিয়ে চলে যান অন্য জেলায়। শ্রমিকের চেয়ে যেহেতু মেশিনে খরচ অনেক কম, তাই সব কৃষক ওই
মেশিনে ধান কাটতে আগ্রহী। কৃষি বিভাগ প্রতিটি মেশিনে ১৫-১৬ লাখ টাকা ভর্তুকি দিলেও তা প্রকৃত কৃষকের হাতে না পড়ায় সুবিধাবঞ্চিত হচ্ছেন এই উপজেলার কৃষক।
২০২০-২১ অর্থবছরে হরিরামপুর ইউনিয়নের সাউথকান্দা গ্রামের আনিছুজ্জামান একটি কম্বাইন হারভেস্টার যন্ত্রের মালিক হন। যদিও উপজেলা কৃষি অফিসের তালিকায় সেটি ফজলুল হকের নামে বরাদ্দ। এলাকা ঘুরে হদিস মেলেনি ফজলুল হকের।
উপজেলার সদর ইউনিয়নের শেফালি বেগমের নামে ২০২১-২২ অর্থবছরে বরাদ্দ হয় একটি কম্বাইন হারভেস্টার। যন্ত্রটি আনার আগেই উপজেলা কৃষি অফিস থেকে ভর্তুকি বাবদ ১৪ লাখ এবং কৃষকের ৪ লাখসহ ১৮ লাখ টাকা এসিআই কোম্পানির কাছে জমা দেন। বছর দেড়েকের মাথায় যন্ত্রটির নিচে পিষ্ট হয়ে মারা যান এক নারী। এ ঘটনা সমাধান করতে গিয়ে আটকে যায় এসিআই কোম্পানির কিস্তি। মাঠ থেকে যন্ত্রটি নিয়ে যায় কোম্পানি।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে একটি হারভেস্টার বরাদ্দ পান মোক্ষপুর ইউনিয়নের সানকিভাঙ্গা গ্রামের আমিমুর এহসান নামে এক যুবলীগ নেতা। তাঁর বাড়িতে গিয়ে যন্ত্রটির হদিস পাওয়া যায়নি। স্থানীয়রাও বলতে পারেননি কোথায় আছে সেটি। কেউ কোনোদিন এলাকাতে দেখেননি যন্ত্রটি। সাখুয়া ইউনিয়নের বাবুপুর গ্রামের রমজান আলীর হারভেস্টারও নেই বাড়িতে। রমজানের খোঁজ পাওয়া না গেলেও স্থানীয় কয়েকজন কৃষক জানান, তাঁর মেশিনে ধান কাটা হচ্ছে অন্য জেলায়।
চুক্তিনামার শর্ত মতে, উন্নয়ন সহায়তার আওতায় কেনা কৃষিযন্ত্র ৩ বছরের মধ্যে হস্তান্তরযোগ্য নয়। এ রকম কিছু হলে উন্নয়ন সহায়তার অর্থ সরকারি কোষাগারে ফেরত দিতে বাধ্য থাকবে। গ্রাহক ভর্তুকির হারভেস্টার প্রদর্শনে ব্যর্থ হলে কিংবা যন্ত্রটি কৃষিকাজে ব্যবহৃত না হলে তাঁর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে পারবে কৃষি বিভাগ।
ত্রিশালে চলতি বছরে ১৯ হাজার ৯৪৫ হেক্টর জমিতে বোরো চাষ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে ত্রিশালে বোরো ধান কাটা শুরু হয়েছে। তবে ৮ হারভেস্টারের মধ্যে কানিহারী ইউনিয়নের ডাকবাঘাদাড়িয়া গ্রামের দেলুয়ার হোসেনের একটি ছাড়া বাকি সাতটি যন্ত্রের সুবিধা ভোগ করতে পারছেন না স্থানীয় কৃষক।
এ প্রকল্পে অনিয়মের মাধ্যমে মোটা অঙ্কের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ তুলেছেন কাঁঠাল ইউনিয়নের আকরাম হোসেন। তাঁর ভাষ্য, তিনজন উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা রয়েছেন এই ইউনিয়নে। কৃষিযন্ত্র বিতরণে প্রকৃত কৃষক যাচাই বা নির্বাচনে কোনো ভুল হওয়ার কথা নয়। অথচ এই ইউনিয়নে তিনবারে তিনটি হারভেস্টার যন্ত্র বরাদ্দ পাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে কেউই প্রকৃত কৃষক নন।
কয়টি হারভেস্টার দেওয়া হয়েছে তা জানা নেই খোদ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা তানিয়া রহমানের। প্রকৃত কৃষক যাচাই ও নিশ্চিত হয়েই যন্ত্র বিতরণ করা হয়েছে বলে দাবি তাঁর। তিনি বলেন, ‘কাগজপত্রসহ সব কার্যক্রম ঠিকঠাক হলে তা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। সেখান থেকে যন্ত্র সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানে চেক পাঠিয়ে দেওয়া হয়, টাকা-পয়সায় আমার কোনো হাত নেই।’ তাঁর ভাষ্য, যেখানে যেখানে অসংগতি রয়েছে, সেগুলোর ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে জানাবেন তিনি। এ যন্ত্র বাংলাদেশের যে কোনো জেলায় গিয়ে ব্যবহার করা যাবে।