পর্যটকের চাপে বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনের ত্রাহি অবস্থা বলিলে অত্যুক্তি হইবে না। আমরা জানি, অতিরিক্ত নৌযান ও পর্যটকের চাপজনিত ক্ষতি হইতে বনের প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সুরক্ষায় ২০১৪ সালে সুন্দরবন ভ্রমণ নীতিমালা প্রণীত হইয়াছিল, যথায় বনের অভয়ারণ্যের উপর চাপ হ্রাসকরত প্রান্তসীমায় নূতন পর্যটনকেন্দ্র গঠন, তৎসহিত প্রকৃতিবান্ধব পর্যটনের উপর গুরুত্ব প্রদান করা হয়। কিন্তু সোমবার সমকালে প্রকাশিত শীর্ষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, নীতিমালাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাইয়া ইদানীং প্রত্যহ গড়ে ৩০টি নৌযান অভয়ারণ্যে পূর্ণ দিবস অবস্থান করিতেছে। শুধু তাহাই নহে; নৌযানেই বসিতেছে ব্যাপক হই-হুল্লোড় সহযোগে ‘বনভোজন’। বলিয়া রাখা প্রয়োজন, বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত বনটির সম্পূর্ণ অংশ সংরক্ষিত এবং ৫৩ শতাংশ এলাকা ঘোষিত বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য হইলেও সুন্দরবনের অভ্যন্তরে বন বিভাগ ১১টি পর্যটনকেন্দ্র নির্মাণ করিয়াছে, যাহার মধ্যে চারটি পড়িয়াছে অভয়ারণ্য এলাকায়।
সুন্দরবনে পর্যটনের প্রভাব লইয়া খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের এক অধ্যাপকের গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হইয়াছে, যেই ট্রলার বা জাহাজে সুন্দরবনে মানুষ ভ্রমণ করে, সেইগুলির শব্দে বন্যপ্রাণী প্রজননে অনাগ্রহী হইতে পারে। ফলস্বরূপ সুন্দরবনে বন্যপ্রাণী হ্রাস পাইবে। তদুপরি ঐ শব্দের কারণে বাদুড়, শুশুক ইত্যাদি শব্দতরঙ্গ ব্যবহারের মাধ্যমে চলাচলকারী প্রাণীর চলাচলে ব্যাঘাত ঘটায় ইহাদের পরিযায়ী হইবার আশঙ্কা বৃদ্ধি পায়। সুন্দরবনের প্রকৃতি ও পরিবেশ বিষয়ে দীর্ঘদিন গবেষণারত খুবির পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অপর অধ্যাপক বলিয়াছেন, মানুষ যেই পারফিউম-কসমেটিকস ব্যবহার করে, উহার ঘ্রাণ গ্রহণেও প্রাণিকুলের প্রজনন বাধাগ্রস্ত হইতে পারে।
এমনকি ভরপুর পর্যটন বাণিজ্যের অন্তরালে পর্যটকের নিরাপত্তার বিষয়ও গৌণ হইয়া পড়িয়াছে। সুন্দরবন উপকূলে ট্রলার ও জালি বোটের ন্যায় চলাচল-নিষিদ্ধ নৌযানে পর্যটকগণ বনের গহিনে চলিয়া যাইতেছেন। বনের অভ্যন্তরে কোনো পর্যটক হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ হইলে সেই ব্যক্তিকে উদ্ধারের কোনো পন্থা নাই। সরেজমিন পরিদর্শনে সমকাল প্রতিবেদক বন বিভাগের অনুমোদনপ্রাপ্ত ৬৮টি নৌযানের বেশ কয়েকটিতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক বয়া, লাইফ জ্যাকেট ও অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র পান নাই। অন্যদিকে সুন্দরবনে চলাচলকারী নৌযানের বনে প্রবেশের জন্য বন বিভাগের অনুমতিপ্রাপ্তির শর্তস্বরূপ নৌপরিবহন অধিদপ্তর হইতে জরিপ সনদ গ্রহণের নিয়ম থাকিলেও বন বিভাগ এই বিষয়ে তত্ত্ব-তালাশ করে না। নৌপরিবহন অধিদপ্তরও নিয়মটি কার্যকরে উন্নাসিক। ফলত অভয়ারণ্যের কটকা, কচিখালী, নীলকমলে পূর্বাপেক্ষা পর্যটকের চাপ বৃদ্ধি পাইয়াছে। এই কারণে পর্যটন প্রদর্শকগণকে উদ্ধৃত করিয়া প্রতিবেদনে বলা হইয়াছে, কটকা, কচিখালী ও নীলকমলে পূর্বের ন্যায় ব্যাঘ্র তো দূরস্থান, হরিণও দৃশ্যমান নহে।
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনীতি ও জীবনযাত্রা সচল রাখিবার ক্ষেত্রে সুন্দরবনের ভূমিকা সর্বজনবিদিত। ইহার সহিত এই বন জাতীয় অর্থনীতির জন্যও কতটা গুরুত্বপূর্ণ, উহাও আমরা জ্ঞাত। শিকারি পক্ষীর নখরের থাবা হইতে রক্ষাকল্পে মুরগি যদ্রূপ উহার শাবকদিগকে ডানা দিয়া ব্যূহ রচনা করে, তদ্রূপ সিডর, আম্ফান, আইলার ন্যায় বহু ঘূর্ণিঝড়ে সুন্দরবন কীভাবে প্রসারিত বক্ষ চিতাইয়া মানববসতি রক্ষা করিয়াছে, তাহাও অজ্ঞাত নহে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, বিশেষত সাম্প্রতিক বৎসরগুলিতে মনুষ্যসৃষ্ট বিভিন্ন কর্মকাণ্ড সুন্দরবনকে ক্রমেই বিপদে ফেলিতেছে। পরিবেশদূষক বহু সরকারি-বেসরকারি প্রকল্পও সুন্দরবনের জন্য বিবিধ হুমকি উৎপাদন করিতেছে। ক্রমবর্ধমান পর্যটকের আনাগোনা নিশ্চয় বনের খোদ অস্তিত্বই বিপন্ন করিয়া দিবে।
অত্র সম্পাদকীয় স্তম্ভে ইতোপূর্বে বলিয়াছি, সুন্দরবনকে স্বাভাবিক অস্তিত্বে থাকিতে দিলে উহা স্বয়ং বাঁচার পন্থা অবলম্বন করিতে পারে। এ ক্ষেত্রে মানুষের সহায়তা জরুরি। ইহারই অংশরূপে যথেচ্ছা অভয়ারণ্যে গমনের সুযোগ বন্ধ করা দরকার। সংরক্ষিত বনাঞ্চলেও নিয়মনীতির বাহিরে পর্যটন বন্ধ করা জরুরি। আমরা ভ্রমণের বিরোধী নহি। কিন্তু খোদ পর্যটনস্থলই ধ্বংস করিয়া ভ্রমণের ভ্রম কদাচ কাম্য নহে।
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
সুন্দরবনে মাছ ধরার অনুমতি নিয়ে মা কাঁকড়া শিকার
কাঁকড়ার প্রজনন মৌসুম হিসেবে জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি দুই মাস সুন্দরবনে কাঁকড়া শিকার নিষিদ্ধ। তবে অসাধু জেলেরা মাছ ধরার অনুমতি নিয়ে সুন্দরবনে প্রবেশ করে অবাধে ডিমওয়ালা মা কাঁকড়া শিকার করছেন। এতে কাঁকড়ার প্রজনন ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
সুন্দরবনসংলগ্ন খুলনার কয়রা উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মাছের চেয়ে বড় কারবার এখন কাঁকড়ার ব্যবসায়। উপজেলার জোড়শিং, ঘড়িলাল, বানিয়াখালী, দেউলিয়া বাজারসহ কাঁকড়া বিক্রির আড়তগুলোতে প্রতিদিন কয়েক শ মণ কাঁকড়া বেচাকেনা হচ্ছে। প্রজনন মৌসুমে শিকার নিষিদ্ধ হলেও তা উপেক্ষা করেই জেলেরা সুন্দরবন ও বনসংলগ্ন বিভিন্ন নদ-নদী থেকে কাঁকড়া ধরে আনছেন।
গত রোববার কয়রা উপজেলার কয়েকটি কাঁকড়ার আড়তে ঘুরে এর সত্যতা পাওয়া গেল। আড়তগুলোতে বস্তায় বস্তায় কাঁকড়া এসেছে সুন্দরবন থেকে। সেগুলো পরিমাপ আর দড়ি দিয়ে বাঁধায় ব্যস্ত লোকজন। কয়রার দেউলিয়া বাজার কাঁকড়া আড়তে কাঁকড়া বিক্রি করতে আসা দুই ব্যক্তি বললেন, ‘এখন কাঁকড়া শিকার নিষিদ্ধ হওয়ায় বন বিভাগ কাঁকড়ার পাস (অনুমতিপত্র) দেয় না। আমরা মাছ ধরার পাস নিয়ে বনে ঢুকে কাঁকড়া ধরে এনেছি। বোঝেনই তো বন্ধের সময় সবকিছু একটু ম্যানেজ করেই করা লাগে।’
গত বুধবার সুন্দরবনের অভয়ারণ্যে থেকে কাঁকড়া আহরণের অভিযোগে আটক হন দুই জেলে। কয়রা আদালতে নেওয়ার সময় আবদুল্লাহ সরদার ও আফজাল হোসেন নামের আটক দুই জেলের সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা জানান, সুন্দরবনের ভোমরখালী টহল ফাঁড়ির কুকুমারী খাল এলাকায় কাঁকড়া শিকারের সময় বন বিভাগের স্মার্ট টহল টিমের সামনে পড়ে গিয়েছিলেন বলে আটক হতে হয়েছে। ওই এলাকায় আরও অনেকের কাঁকড়ার নৌকা আছে। তাঁরা লুকিয়ে থাকায় ধরা পড়েননি।
রোববার কয়রার মহেশ্বরীপুর গ্রামসংলগ্ন সুন্দরবনের কয়রা নদীতে দেখা যায়, এক জেলে নৌকায় বসে নদীতে পেতে রাখা ‘চারো’ বা ‘আটোন’ নামের একধরনের কাঁকড়া শিকারের ফাঁদ তুলছেন। ফাঁদের ভেতর থেকে কাঁকড়া নিয়ে সিনথেটিক সুতা দিয়ে বেঁধে নৌকার মধ্যে রাখছেন তিনি। তার একটু সামনে আগাতেই সুন্দরবনঘেঁষা তেঁতুলতলার চর গ্রাম। সেখানকার বসতির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া কয়রা নদী ধরে কাঁকড়া শিকারের ফাঁদ নিয়ে সুন্দরবনে প্রবেশ করেছিলেন ফরিদ হোসেন নামের এক জেলে।
ফরিদ হোসেন বলেন, এখন বনের মধ্যে যে কয়টি নৌকা আছে, সবগুলোই কাঁকড়াশিকারিদের নৌকা। বন্ধ মৌসুমে কাঁকড়া ধরে ডাঙায় আনা বড্ড ঝামেলার কাজ। জীবিত অবস্থায় কাঁকড়া নিয়ে আড়তে ফিরতে না পারলে সেই চালানের কোনো দামই পাওয়া যায় না। তবে কাঁকড়ার কারবার এখন বেশ লাভজনক। কাঁকড়া শিকার নিষিদ্ধ হলেও বন বিভাগের চোখ এড়িয়ে সুন্দরবনজুড়ে চলছে এই অবৈধ কাজ।
গতকাল সোমবার কয়রার সুন্দরবনসংলগ্ন দক্ষিণ বেদকাশী এলাকার গিয়ে দেখা যায়, সুন্দরবন থেকে কাঁকড়া শিকার করে সবেমাত্র লোকালয়ে ফিরেছেন পরিমল মণ্ডল নামের এক জেলে। শাকবাড়িয়া নদীর তীরে নৌকা বেঁধে রাখছিলেন তিনি। নৌকার ওপর তিনটি প্লাস্টিকের ঝুড়িতে ভরা কাঁকড়া। তিনি বলেন, ‘ডাকাতদের ভয়ে সুন্দরবনের বেশি ভেতরে যাইনি।’ ‘বন্ধের সময় কাঁকড়া ধরলেন কীভাবে?’ জানতে চাইলে পরিমল বলেন, এলাকায় মহাজনদের কাছে একেকটা কাঁকড়া শিকারের নৌকার জন্য ৫০০ টাকা দিতে হয়। টাকা দিলে বন বিভাগের লোকেরাও আর বাধা দেন না।
সুন্দরবনের কয়রা নদীতে নৌকায় করে কাঁকড়া ধরার জন্য ফাঁদ ফেলেছেন এক জেলে। রোববার কয়রা নদীর পাড়ে।