গণঅভ্যুত্থানের শক্তি বনাম নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত
Published: 13th, January 2025 GMT
পরাক্রমশালী ও কর্তৃত্ববাদী শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটানো গণঅভ্যুত্থানের শক্তিগুলোর পারস্পরিক দূরত্ব ক্রমশ বাড়ছে; পত্রিকার খবর– ‘অভ্যুত্থানের শক্তিগুলো ঐক্যের প্রতিশ্রুতি দিলেও, বিভেদে জড়িয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে বিএনপির মতবিরোধ প্রকাশ্যে। জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে বেড়েছে তিক্ততা। সব ইস্যুতেই ছাত্রনেতৃত্বের বিপরীত অবস্থান বিএনপির (সমকাল, ১২ জানুয়ারি ২০২৫)।’
দমবন্ধ দুঃশাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ অভ্যুত্থানের পাঁচ মাসের মধ্যে সক্রিয় রাজনৈতিক শক্তিগুলোর বিরোধ কয়েকটি প্রসঙ্গ সামনে নিয়ে আসছে। বিগত দেড় দশক আওয়ামী লীগ যেভাবে রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তম্ভকে দলীয়করণ করে স্বেচ্ছাচারের মাধ্যমে দেশকে লুটপাটের আখড়া হিসেবে গড়ে তুলেছিল; সেই স্বৈরাচারী কুহক থেকে বের হওয়ার জন্য নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের দাবি ৫ আগস্টের পর প্রবলভাবেই ওঠে। চব্বিশের অভ্যুত্থানের প্রধান শক্তি শিক্ষার্থীসহ সব রাজনৈতিক পক্ষ রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের দাবি তোলে। প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি তাদের ৩১ দফা সংস্কার কর্মসূচিতে এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত তুলে ধরে। অন্যদিকে আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীরা ৩ আগস্ট, ২০২৪ শেখ হাসিনার পতনের এক দফা দাবি তোলার দিনই ‘নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত’ দাবি উত্থাপন করেন।
অন্তর্বর্তী সরকার জনদাবিকে সামনে রেখে শুরুতে ৬টি সংস্কার কমিশন গঠন করে। শিগগিরই কমিশন তাদের প্রতিবেদন জমা দেবে। তারপর সরকার অংশীজনের সঙ্গে আলাপ করে সংস্কারে অগ্রসর হবে। এদিকে আন্দোলনকারী ছাত্ররা জুলাই ঘোষণাপত্রের দাবিতে দেশজুড়ে লিফলেট বিতরণ কর্মসূচি শুরু করে, শিক্ষার্থীদের দাবির প্রেক্ষিতে সরকার ৩০ ডিসেম্বর জানায়, সব পক্ষের সঙ্গে কথা বলে জুলাই ঘোষণাপত্র দেবে। ১০ জানুয়ারি এ ঘোষণা থেকে সরে এসে উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বলেন, সরকার ঘোষণাপত্র দেবে না, প্রক্রিয়াগত সহায়তা করছে মাত্র। ঘোষণাপত্র আসবে ঐকমত্যের ভিত্তিতে।
আমাদের মনে আছে নিশ্চয়ই, ৪ ডিসেম্বর সব রাজনৈতিক দলের উপস্থিতিতে প্রধান উপদেষ্টা ড.
অবশ্য ছাত্রনেতারা সরকারের কয়েকটি পদক্ষেপ সম্পর্কে এরই মধ্যে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। বিশেষত রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন সম্পর্কে সরকার ও ছাত্রদের অবস্থান বিপরীতমুখী ছিল। অপরদিকে বাহাত্তরের সংবিধান বাতিলের দাবি তোলে ছাত্রনেতৃত্ব। সংবিধান সংস্কার কমিশন গঠনের মাধ্যমে বোঝা যায়, ছাত্রদের দাবির সঙ্গে সরকার একমত নয়। যদিও সরকার শিক্ষার্থীদের দফায় দফায় তোলা বেশির ভাগ দাবির প্রতি সহানুভূতিশীল; পাঠ্যপুস্তকে পরিবর্তনসহ বিভিন্ন পদক্ষেপে ছাত্রনেতৃত্বের মতামত যথেষ্ট গুরুত্ব পাচ্ছে।
২.
জুলাই-আগস্টে ৩৬ দিনের আন্দোলনেই শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়ে গেছে– এই ন্যারেটিভ যুক্তিসংগত কারণেই মানতে রাজি নয় বিএনপি। ইতোমধ্যে জুলাই ঘোষণাপত্রে তাদের ১৬ বছরের দীর্ঘ সংগ্রামের স্বীকৃতি দাবি করেছে। নির্বাচনের সুস্পষ্ট রোডম্যাপের দাবি জানিয়ে বিএনপি বারবারই বলছে, সংস্কার দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। যে ক’টি কার্যক্রম অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রয়োজন, সেগুলো দ্রুত সম্পন্ন করে নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে তারা।
ছাত্রনেতৃত্ব ইতোমধ্যে রাজনৈতিক দল গঠনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ফেব্রুয়ারির মধ্যে নতুন দলের ঘোষণা আসতে পারে বলে পত্রিকান্তরে জানিয়েছেন জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সংগঠিত হওয়ার অভিযোগ তুলে আসন্ন রাজনৈতিক দলটিকে ‘কিংস পার্টি’ অভিহিত করছেন অনেকে। জেলায়-উপজেলায় জাতীয় নাগরিক কমিটি বা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নতুন কমিটি এত বিদ্যুৎ গতিতে গঠিত হচ্ছে যে, নেপথ্যের অর্থনৈতিক ও সাংগঠনিক জোগানের উৎস নিয়ে প্রশ্ন ওঠা যৌক্তিক। একদিকে দল গোছানো, অন্যদিকে বিএনপি-বিরোধিতা– ছাত্রনেতৃত্বের সাম্প্রতিক কাজকর্ম মোটাদাগে এভাবেই চিহ্নিত করা যায়। নির্বাচন প্রশ্নে পরস্পরের অবস্থান মেরুপ্রতিম দূরত্বে।
৩.
গণঅভ্যুত্থানে শিক্ষার্থীদের অমিত সাহস ও লড়াকু মনোভাব কোনো বাধাই মানেনি। রাজনৈতিক দলগুলোর অগণতান্ত্রিক কাঠামো, পরিবারতন্ত্র, স্বজনতোষণ গণঅভ্যুত্থানের পরে যৌক্তিক প্রশ্নের মুখে পড়েছে। রাজনৈতিক দলে নতুন বন্দোবস্তের দাবি তাই ‘জনদাবি’ হিসেবেই গণ্য করতে হয়। তবে বাস্তব কিছু প্রশ্নের উত্তরও ছাত্রনেতৃত্বকে খুঁজতে হবে। যে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজের কথা বলে তারা জামায়াতে ইসলামীর মতো দলগুলোকে প্রাধান্য দিচ্ছে; সেটি যতটা অন্তর্ভুক্তিমূলক, তার চেয়ে বেশি ‘বিএনপি ঠেকাও’ কৌশল কিনা– সে প্রশ্ন উঠেছে। আওয়ামী লীগের গণহত্যা নিয়ে সোচ্চার চব্বিশের ছাত্রনেতৃত্ব একাত্তরের গণহত্যা নিয়ে নিশ্চুপ কেন? মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী দলকে নিয়ে ছাত্রদের অনাপত্তির পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধকে নানাভাবে আড়ালের উদ্যোগও খুবই চোখে লাগে। পাঠ্যপুস্তকে মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যার নতুন বিন্যাস, চব্বিশকে একাত্তরের সঙ্গে তুলনা– এগুলো উচিত নয়। একটি দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সঙ্গে কর্তৃত্ববাদী শাসকবিরোধী লড়াইকে এক করে দেখা উদ্দেশ্যমূলক। শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধকে নিজস্ব সম্পত্তি করে তুলেছেন বলে মুক্তিযুদ্ধের সত্য ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব ম্লান হয়নি; হতে পারে না।
চব্বিশের আন্দোলনেও আমরা মুক্তিযুদ্ধের আলো দেখেছি তরুণ-তরুণীদের চোখে-মুখে; মুক্তিযুদ্ধের অবিনাশী গানগুলোতে কণ্ঠ মিলিয়েই রাজপথে প্রতিরোধের ব্যূহ তৈরি করেছে কোটি মানুষ। বরং জুলাই-আগস্টে জামায়াত বা শিবিরের কোনো চিহ্ন ছিল না কোথাও। ৫ আগস্টের পরই কেবল দেখা যাচ্ছে, ছাত্রলীগ হিসেবে বছরের পর বছর দাপট ও আরাম-আয়েশের জীবন কাটিয়ে শিবির নেতারা আত্মপ্রকাশ করছে।
হায়, অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ! আমরা কোদালকে কোদাল, সাদাকে সাদা, কালোকে কালো, শিবিরকে শিবির, জামায়াতকে জামায়াত, গণহত্যাকে গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধকে যুদ্ধাপরাধ, গণঅভ্যুত্থানকে গণঅভ্যুত্থান বলব না?
সংখ্যালঘু ও প্রান্তিক যে মানুষগুলো আক্রান্ত হয়েছে, হচ্ছে– রাষ্ট্রকে তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। জুলাই গণঅভ্যুত্থান কখনই ধর্মভিত্তিক রাজনীতির পক্ষে ছিল না; এই অভ্যুত্থানের প্রকৃত আকাঙ্ক্ষা জাতি-বর্ণ-ধর্ম-লিঙ্গ ও রাজনৈতিক পরিচয়ে প্রত্যেক নাগরিক সমান মর্যাদায় বিবেচিত হবেন। নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তে তাই সবার আগে প্রত্যেকের মৌলিক অধিকার সমুন্নত রাখতে হবে।
৫ আগস্টের পর অস্থির পরিস্থিতির সুযোগে কোনো কোনো গোষ্ঠী মাজারে হামলা করছে। হামলা হয়েছে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর, আক্রান্ত হয়েছে পাহাড়ি জনগোষ্ঠী, নারীদের হেনস্তা করা হয়েছে। এসব ঘটনা দেশকে পেছনের দিকে টেনে নিয়ে যাওয়ার মতো।
ছাত্রনেতৃত্বকে বুঝতে হবে– ছাত্রদের গড়ে উঠবার সময় নিতে হবে, দিতে হবে। অবশ্যই রাজনীতিতে তাদের অংশ থাকবে, তবে তা দখল করবার কিছু নেই। গণঅভ্যুত্থানের অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতায় স্নাত এই প্রজন্মের তরুণদের কোনো প্রলোভনে মাথা নোয়ানো চলবে না। জাতীয় নির্বাচনে বিজয়ীরা দেশ পরিচালনা করবেন; এবং কেউই প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নয়– এই সত্য মাথায় রেখে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তে নিজেদের প্রস্তুত করতে হবে। জনগণের কাঠগড়ায় যাওয়ার কোনো সংক্ষিপ্ত বা চোরা রাস্তা নেই।
মাহবুব আজীজ: উপসম্পাদক, সমকাল; সাহিত্যিক
mahbubaziz01@gmail.com
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
রাজনৈতিক দল, কর্তৃত্বপরায়ণতা ও নতুন বন্দোবস্ত
চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের পর নতুন সমীকরণে রাজনৈতিক দলগুলোর কার্যক্রম জোরেশোরে চলছে। যে বিএনপি-জামায়াতকে নানা ইস্যুতে জোটবদ্ধ দেখা যেত, তা ইতোমধ্যে স্পষ্ট বিভাজিত। টানা দেড় দশক ক্ষমতাসীন কর্তৃত্ববাদী আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক পতন ও পলায়নের পর তাদের শূন্যতার সুবিধা করায়ত্ত করতে সকল পক্ষ সক্রিয়।
বর্তমান পরিস্থিতিতে বিএনপি তর্কাতীতভাবেই সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল। তাই বিএনপিতে এখন কর্মীদের ভিড়ও বেশি। গত ১৫ বছর নির্যাতিত, নিপীড়িত, ত্যাগী বিএনপি নেতাকর্মী যেমন আছেন, তেমনি আছেন সুসময়ে ভিড় করা নব্য ‘বন্ধু’। সাত বছর পর দলটির বর্ধিত সভা নিয়ে সমকাল জানাচ্ছে, ‘বিএনপির তৃণমূল পর্যায়ের নেতারা বলছেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ফ্যাসিবাদী সরকার পালিয়ে গেলেও এখনও রয়ে গেছে দোসররা। দোসরদের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামী আঁতাত করে বিএনপিকে নিয়ে নানা চক্রান্ত করছে (২৮.০২.২৫)।’ চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্মে বিএনপি নেতাকর্মী জড়িত বলে অভিযোগ তুলছে জামায়াত; অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে বিএনপি। নির্বাচন ও সংবিধানের নানা প্রশ্নেও দুই দলের মতভিন্নতা দেখা যাচ্ছে।
এ পরিস্থিতিতে গত শুক্রবার গণঅভ্যুত্থানজয়ী তরুণ ছাত্রদের রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করল। দিন কয়েক আগে থেকে দলটির নেতৃত্ব নিয়ে টানাপোড়েন, মতপার্থক্যের খবর পাওয়া যাচ্ছিল। তার আগে বুধবার গণঅভ্যুত্থানের সমন্বয়কদের নতুন সংগঠন ‘বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ’ আত্মপ্রকাশ করে ব্যাপক মারামারির মধ্যে। ছাত্র সংগঠনটির নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একচেটিয়া প্রাধান্যে বিক্ষোভ করেন অভ্যুত্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
এনসিপিতে বিভিন্ন মত ও পথের শিক্ষার্থীদের সমন্বয় ঘটেছে। ১৭১ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটিতে জুলাই আন্দোলনের ১০ জন এ দলের শীর্ষ পদে আছেন। এই দলে মধ্য, ডান, বাম, শিবির, কওমিপন্থি, আদিবাসী এবং ১৫ নারী স্থান পেয়েছেন। গণঅভ্যুত্থান-উত্তর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক দলটির কাছে প্রত্যাশা যেমন আছে, তেমনি বাস্তবতাকে মোকাবিলার জন্য অনেক প্রশ্নের উত্তর তাদের প্রস্তুত রাখতে হবে।
২.
দেশের প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলোর কাছেও চব্বিশ-উত্তর পটভূমিতে জাতির প্রত্যাশা অনেক বেশি। রাষ্ট্র সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে বর্তমানে সকল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড আবর্তিত হলেও দলের অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র নিয়ে কোনো রাজনৈতিক দলেই কথা হয় না। অন্তর্বর্তী সরকারও রাজনৈতিক দলে গণতন্ত্র স্থাপন বা সংস্কারে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। রাষ্ট্রীয় কাঠামোর সংস্কার নিয়ে সরব সব রাজনৈতিক দল তাদের অভ্যন্তরে সংস্কার নিয়ে নিশ্চুপ। আওয়ামী লীগ, বিএনপি বা জাতীয় পার্টি– সব রাজনৈতিক দলেই পার্টিপ্রধানের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। সম্মেলনে আমরা দেখি, সারাদেশ থেকে কাউন্সিলররা এসে দিনব্যাপী ‘আলোচনা’ করে সব সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার দলের প্রধানের হাতে ন্যস্ত করেন। বিএনপির ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে; সেখানেও দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের চর্চা সম্পর্কে কোনো প্রস্তাবনা নেই।
প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলোর প্রচল মানসিকতার অনুরণন আমরা শুনতে পেলাম নবগঠিত এনসিপিতেও। হ্যাঁ, নাহিদ ইসলাম অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পদ ছেড়ে দিয়ে দলের আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করছেন; এটি অবশ্যই ইতিবাচক। অন্য দুই ছাত্র উপদেষ্টার সরকারে অংশগ্রহণ ও ভবিষ্যতে এই দলে অংশগ্রহণের সম্ভাবনা নিয়ে প্রশ্ন এখনই উঠছে। এনসিপি সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা পেতে থাকলে অবশ্যই তা গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন আয়োজনকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দেবে।
ছাত্র-তরুণের রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ যেভাবে কোন্দল আর বিতর্কের মধ্য দিয়ে মনোনীত হলেন, তার বদলে গণতান্ত্রিক পদ্ধতি অনুসরণ করা যেত না? প্রাথমিকভাবে নিবন্ধিত কর্মীরা নিজেরা ভোট দিয়ে নেতা নির্বাচিত করতে পারতেন। ‘দাতব্য গৃহ হইতেই সূচিত হয়’– আপ্তবাক্যের মতো গণতন্ত্র গৃহ হতেই শুরু করা দরকার ছিল। তবে এক বছরের জন্য গঠিত বর্তমান আহ্বায়ক কমিটি ভবিষ্যতে নেতাকর্মীর সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হওয়ার মানসিকতায় পৌঁছুবে বলে প্রত্যাশা। রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ যখন দলের কর্মীদের কাছে জবাবদিহি করেন, তখনই প্রকৃত গণতন্ত্রের চর্চা শুরু হয়; এর ধারাবাহিকতায় জনতার কাছে জবাবদিহির ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়।
৩.
ছাত্র-তরুণরা নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের কথা বারবারই বলে আসছেন। এনসিপির ঘোষণাপত্রেও তা উঠে এসেছে। সংক্ষেপে এই জাতির ইতিহাস তুলে ঘোষণাপত্রে নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘জনগণ ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা বিলোপের মাধ্যমে একটি নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের আকাঙ্ক্ষা থেকে এই অভ্যুত্থানে সাড়া দিয়েছিল যেন জনগণের অধিকারভিত্তিক একটি রাষ্ট্র পুনর্গঠিত হয়। সেই লক্ষ্য নিয়েই জাতীয় নাগরিক পার্টির ঘোষণা...। এটি হবে একটি গণতান্ত্রিক, সমতাভিত্তিক ও জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দল।’
এনসিপির আত্মপ্রকাশ অবশ্যই প্রত্যাশাজাগানিয়া। যে অনড় এককেন্দ্রিক কর্তৃত্ববাদী বলয়ে ঘুরপাক খাচ্ছিল এ দেশের প্রচল রাজনৈতিক দল ও সংস্কৃতি, তার দিকে চোখে চোখ রেখে কথা বলবার স্পর্ধা নিঃসন্দেহে গণঅভ্যুত্থানজয়ী তারুণ্যের রয়েছে। এর প্রয়োজনীয়তাও অনস্বীকার্য। তবে কোন প্রক্রিয়ায় গড্ডলিকা প্রবাহের বিপরীতে হাঁটবে এই রাজনৈতিক দল– তা তাদেরকেই সন্ধান করে বের করতে হবে। এনসিপির গঠনতন্ত্র দেখবার সুযোগ এখনও হয়নি। তবে ঘোষণাপত্রে গতানুগতিক প্রতিশ্রুতিই দেখা গেছে। কোন প্রক্রিয়ায় দেশের পেশাজীবী, অভিজ্ঞ মানুষ এই রাজনৈতিক দলে অংশী হবেন, তা বোঝা যায়নি; নাকি এই দলে শুধু বিশ্ববিদ্যালয় বা মাদ্রাসার তরুণরাই কাজ করবার সুযোগ পাবেন? কেবল ২৫ থেকে ৩০ বছরের তরুণদের তারুণ্য সমাজ-রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য উপযুক্ত হতে পারে না; এ জন্য প্রয়োজন বিভিন্ন ক্ষেত্রে অভিজ্ঞদের সরাসরি অংশগ্রহণ ও মিথস্ক্রিয়া। বিষয়টির অনুপস্থিতি তারা কোন প্রক্রিয়ায় পূরণ করবেন, এটা দেখবার বিষয় বটে।
বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের ডাক দিয়ে গড়ে ওঠা ছাত্র আন্দোলনের ফলাফল এনসিপি। প্রত্যেক মানুষের জন্য প্রাপ্য মৌলিক অধিকার নিশ্চিতসহ দেশের অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করবার উপায় উদ্ভাবন তাদের কাছে ন্যূনতম প্রত্যাশা। এসব প্রসঙ্গে সমাধানের পথ বাতলে দেবার মতো উপযুক্ত মানুষদের সঙ্গে তরুণদের যূথবদ্ধতার বিকল্প নেই।
এনসিপির জাঁকজমকপূর্ণ আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠান নিয়ে বলা হচ্ছে, তরুণরা এত টাকা পেল কোথায়? সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় যানবাহনসহ নানা কথাও আলোচনায় আছে। বড় দলগুলো যখন সভা করে তখন তাদের আর্থিক সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন যারা করেন না, তারাই এখন তরুণদের রাজনৈতিক দলের সভার আর্থিক উৎস নিয়ে সরব! বিএনপি গত সপ্তাহেই বড় বর্ধিত সভা করল ঢাকাতে! যে প্রক্রিয়ায় অন্য দলগুলো সভা করে, সেই প্রক্রিয়াতেই তরুণদের দলের সভাও হয়েছে। তবে গণচাঁদা বা অন্যান্য চাঁদার বিষয়টি তরুণরা স্বচ্ছভাবে প্রকাশ করে দিলে, তারাই এক ধাপ এগিয়ে থাকবে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা নিলেও তা জানিয়ে দেওয়া প্রয়োজন। রাখঢাক না করে সততার সঙ্গে সাদাকে সাদা ও কালোকে কালো বলবার চিরকালীন তারুণ্যের স্পর্ধা আমরা নতুন রাজনৈতিক দলে দেখতে চাই।
এসবের সঙ্গে জরুরি দলের স্পষ্ট দার্শনিক অবস্থান। ডান-বাম, মধ্য, মাদ্রাসাপন্থি, উদার মানবতাবাদী ইত্যাদির সংমিশ্রণে ‘আমরা ভারত বা পাকিস্তানপন্থি নই, আমরা বাংলাদেশপন্থি’ বলাই যথেষ্ট নয়। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ইতিহাস ও সমাজ– প্রতিটি পর্যায়ে নিজেদের মনোভঙ্গির সুস্পষ্ট অবস্থান দলটির রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ধারণে সহায়ক হবে। মানুষের আস্থা অর্জনে দার্শনিক অভিপ্রায়ের স্পষ্টতা জরুরি।
মাহবুব আজীজ: উপসম্পাদক, সমকাল; সাহিত্যিক
mahbubaziz01@gmail.com