গণতন্ত্র অর্থবহ করতে স্থানীয় সরকার শক্তিশালী করার কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার ৫৩ বছর পরও স্থানীয় সরকার পর্যায়ে উপযুক্ত নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়নি। জনগণের প্রতি দায়-দরদহীন এমনকি গুরুতর ফৌজদারি মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত লোকও স্থানীয় সরকারের নেতৃত্বে চলে আসে। এ ক্ষেত্রে যারা ব্যতিক্রম তারাও সরকারের ভুল সিদ্ধান্ত ও স্থানীয় সংসদ সদস্যের অযাচিত হস্তক্ষেপের কারণে ভালো কাজ করতে পারেন না। ফলে জনগণের সঙ্গে শতাব্দীপ্রাচীন ব্যবস্থারই এক প্রকার বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়, যা তৃণমূলে গণতন্ত্রকে ব্যাহত করতে বাধ্য। 

এ ভূখণ্ডে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা চালু হয় ব্রিটিশ শাসকদের হাতে ১৮৭০ সালে। তখন গ্রাম চৌকিদারি আইন পাস হয়, যার অধীনে প্রতিটি এলাকায় একটি ‘ইউনিয়ন’ ও ‘চৌকিদারি পঞ্চায়েত’ (সংগঠন) গঠিত হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, কর সংগ্রহ ও প্রশাসনকে সহায়তা ছিল প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজ। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে তাদের কাজে লাগানোর সুবিধার্থে ১৮৮৫ সালে সরকার ‘বেঙ্গল লোকাল সেল্ফ গভর্নমেন্ট অ্যাক্ট’ নামে আইন তৈরি করে। এই আইনের অধীনে ইউনিয়ন কমিটি, স্থানীয় সরকার বোর্ড ও জেলা বোর্ড গঠিত হয়েছিল। ১৯১৯ সালের ‘দ্য বেঙ্গল ভিলেজ সেল্ফ গভর্নমেন্ট অ্যাক্ট’ আইনটি চৌকিদার পঞ্চায়েত ও ইউনিয়ন কমিটি বিলুপ্ত করে ইউনিয়ন ও জেলা বোর্ড গঠন করে। ইউনিয়ন বোর্ডের প্রধান কার্যক্রম ছিল আইনশৃঙ্খলা, সড়ক-সেতু রক্ষণাবেক্ষণ, স্বাস্থ্যসেবা, দাতব্য চিকিৎসালয়, প্রাথমিক বিদ্যালয়, জেলা বোর্ডের পানি সরবরাহ এবং জেলা বোর্ডকে সহায়তা প্রদান। ইউনিয়ন বোর্ড ছোট ফৌজদারি মামলা নিষ্পত্তি করতে পারত। ইউনিয়নকে কর আরোপের অধিকার দেওয়া ছিল। ১৯৫৯ সালের মৌলিক গণতন্ত্রী অধ্যাদেশের অধীনে ইউনিয়ন পরিষদকে বিদ্যমান চৌকিদারি তহবিলের পাশাপাশি নিজের তহবিল গড়ে তোলার জন্য সম্পত্তি ও অন্যান্য উৎসের ওপর কর আরোপের অনুমতি দেওয়া হয়। গ্রামীণ কর্মসূচি এবং ইউনিয়ন পরিষদ অফিসে নির্মাণের জন্য সরকারি অনুদান ছিল।

১৯৭২ সালের সংবিধানে এলাকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ছাড়াও ইউনিয়ন কাউন্সিলের জন্য ৩৭টি কাজ দেওয়া হয়। এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল কৃষি উন্নয়ন, পানি সরবরাহ, শিক্ষা, যোগাযোগ, সামাজিক কল্যাণ। ১৯৬১ সালের ‘মুসলিম ফ্যামিলি অ্যান্ড ম্যারেজ অর্ডিন্যান্স’ অনুসারে ইউনিয়ন কাউন্সিলকে সমঝোতা আদালত প্রতিষ্ঠা করা এবং সদস্যদের বিচার বিভাগীয় ক্ষমতা দেওয়া হয়। বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৫৯ ও ৬০-এ একটি স্থানীয় সরকারের রূপরেখা রয়েছে। এতে স্পষ্ট– তৃণমূলে উন্নয়নসহ সব কাজে গণতান্ত্রিক চর্চা নিশ্চিত করার বিষয়টি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতাদের ভাবনায় ছিল, যদিও বাস্তবে তার প্রতিফলন ঘটেনি। 

বিদ্যমান স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় দলবাজি একটি প্রধান সমস্যা। ব্যবস্থাটি হওয়ার কথা ছিল সংসদীয় সরকার কাঠামোর; হয়েছে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার কাঠামোর। চেয়ারম্যান বা মেয়র এখানে সর্বেসর্বা। উপরন্তু, তারা যদি বিএনপির হন, তবে আওয়ামী লীগ সমর্থকরা গুরুত্ব পায় না। একই চিত্র আওয়ামী চেয়ারম্যান, মেয়রদের ক্ষেত্রেও দেখা যায়। এ জন্য দলীয় প্রতীকে ও মনোনয়নে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হওয়া যেমন উচিত নয়, তেমনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ আইনত নিষিদ্ধ করতে হবে। এই নির্বাচনে ইউনিয়নে শুধু মেম্বার এবং পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনে কাউন্সিলর নির্বাচন করা হোক। নির্বাচিত মেম্বার ও কাউন্সিলরদের মধ্য থেকে একজন সংখ্যাগরিষ্ঠ মেম্বর-কাউন্সিলরদের ভোটে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ও মেয়র নির্বাচিত হবেন। যাঁকে যে কোনো সময় সংশ্লিষ্ট মেম্বার ও কাউন্সিলররাই অপসারণ করতে পারবেন। জবাবদিহিমূলক স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান চাইলে এগুলোর গণতান্ত্রিকীকরণ জরুরি।

স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের ওপর এমপিদের কর্তৃত্ব খর্ব করাও স্থানীয় সরকারের এক গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার। এমপি তথা আইনসভার সদস্যরা আইন তৈরি করবেন। স্থানীয় উন্নয়ন বা অন্য বিষয়ে তারা হস্তক্ষেপ করতে পারবেন না। 

দেশের অতীত শাসকরা বুঝতেই পারেননি– তদবির কিংবা গায়ের জোরে নগরায়ণ হয় না। দলীয় সংকীর্ণ স্বার্থে এমপিদের পছন্দের এলাকাকে তারা পৌরসভা ঘোষণা করেছেন। এতে বাস্তব কারণে নগরায়ণ না হওয়ায় সংশ্লিষ্ট গ্রামাঞ্চলে কর্তৃপক্ষের পক্ষে নাগরিক সেবাদান অসম্ভব হয়েছে। অন্যদিকে শহুরে হারে কর দিতে হয় বলে জনগণের জন্য তা এক প্রকার বোঝা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ‘বাংলাদেশ মিউনিসিপ্যাল ডেভেলপমেন্ট ফান্ড’ নামে প্রতিষ্ঠানটি এ জাতীয় অনেক সংকট ইতোমধ্যে মোকাবিলা করছে। এসব পৌরসভা অবিলম্বে বাতিল ও বিলুপ্ত করতে হবে। এ ছাড়া এখনকার আধুনিক সময়ে স্থানীয় সরকারের সব ট্যাক্স ও ফি সংক্রান্ত লেনদেন ব্যাংকিং চ্যানেলে হওয়ার মাধ্যমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার কোনো বিকল্প নেই। পরিচ্ছন্নতাকর্মীসহ সবাইকে জবাবদিহির আওতায় আনারও বিকল্প নেই। মাস্টার রোলে চাকরি চলবে না। সব কর্মচারীর চাকরি স্থায়ী করে তাদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। আজকের ডিজিটাল যুগে মশক নিধন কর্মী, পরিচ্ছন্নতাকর্মী; কারও জবাবদিহির ঊর্ধ্বে থাকার সুযোগ নেই। নির্বাচন অবাধ ও গণতান্ত্রিক করার প্রথম শর্তই হলো, তাতে প্রার্থী হওয়ার সুযোগ সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবীদের জন্য অবারিত রাখা। যিনি ভোট দিতে পারবেন তিনি নির্বাচনে দাঁড়াতেও পারবেন; যদি তিনি ঋণখেলাপি, বিলখেলাপি বা দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি না হন। পাস করলে সেই চাকরি থেকে পদত্যাগ করলেই চলবে। এ ব্যবস্থায় স্থানীয় পর্যায়ে শিক্ষিত নেতৃত্বও সৃষ্টি হবে। জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট যে কোনো প্রতিষ্ঠানকে ভবিষ্যৎমুখী করতে হলে শিক্ষিত নেতৃত্বের কোনো বিকল্প নেই।

জহিরুল ইসলাম: সভাপতি, বাংলাদেশ শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশন

.

উৎস: Samakal

এছাড়াও পড়ুন:

ঢাকায় ইইউভুক্ত দেশের ভিসা সেন্টার খোলার অনুরোধ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্ট

ঢাকা থেকে যেসব ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) সদস্য দেশের ভিসা ইস্যু করা হয় না, সেসব দেশের জন্য ঢাকায় একটি একক ভিসা সেন্টার খোলার অনুরোধ জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী।

সোমবার (২১ এপ্রিল) সচিবালয়ে নিজ দপ্তরে বাংলাদেশে নিযুক্ত ইইউ রাষ্ট্রদূত মিচেল মিলারের সঙ্গে বৈঠককালে তিনি এ অনুরোধ জানান।

বৈঠকে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, রোহিঙ্গা সংকট, অভিবাসন, মানবপাচার, চোরাচালান রোধ এবং বাংলাদেশের চলমান প্রশাসনিক সংস্কার নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়।

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, “ইইউভুক্ত দেশগুলোতে বাংলাদেশ একটি অন্যতম প্রধান জনশক্তি রপ্তানিকারক দেশ। শিক্ষা, চিকিৎসা, ব্যবসা ও পর্যটনসহ বিভিন্ন প্রয়োজনে বাংলাদেশিরা নিয়মিত এসব দেশে যাতায়াত করেন। কিন্তু ভিসা পেতে নয়াদিল্লি যেতে হওয়ায় তা সময়সাপেক্ষ, ব্যয়বহুল ও ভোগান্তিকর। ঢাকায় একটি ইইউভুক্ত দেশের ভিসা সেন্টার স্থাপন সময়ের দাবি।”

উত্তরে রাষ্ট্রদূত মিচেল মিলার জানান, তিনি এ প্রস্তাব ইইউভুক্ত দেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করবেন।

বৈঠকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা আরো বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী ও অন্যতম অংশীদার। ইইউর সহায়তায় অবকাঠামো ও অর্থনৈতিক খাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়েছে।

রাষ্ট্রদূত জানান, ইইউ বাংলাদেশের চলমান সংস্কার প্রক্রিয়াকে সমর্থন করে এবং এ ক্ষেত্রে দক্ষতা, প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতা দিয়ে সহযোগিতার আগ্রহ রাখে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বাংলাদেশি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণে ইইউভুক্ত দেশে কর্মশালা আয়োজনের অনুরোধ জানান।

আইনশৃঙ্খলা বিষয়ে রাষ্ট্রদূতের এক প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা বলেন, “বর্তমানে দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সন্তোষজনক। ধীরে ধীরে এটি আরো উন্নত হচ্ছে।”

এ সময় রাষ্ট্রদূত বলেন, “বাংলাদেশে সংঘবদ্ধ অপরাধ ও অপরাধ পরিসংখ্যান নিয়ে অনেক ভুল তথ্য ছড়ানো হচ্ছে। সঠিক তথ্য সরবরাহই গুজব প্রতিরোধের প্রধান উপায়।”

রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে উপদেষ্টা বলেন, “সরকারিভাবে বাংলাদেশে ১২ লাখ রোহিঙ্গা নিবন্ধিত হলেও বাস্তবে এর চেয়ে বেশি শরণার্থী কক্সবাজারে অবস্থান করছে, যা ওই অঞ্চলের আইনশৃঙ্খলার জন্য হুমকি। রোহিঙ্গাদের জীবনমান উন্নয়নে দেশি-বিদেশি সংস্থাগুলো কাজ করছে।”

মানবপাচার ইস্যুতে রাষ্ট্রদূত বলেন, “প্রতি বছর বাংলাদেশ ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে বিপুলসংখ্যক মানুষ ইউরোপে পৌঁছানোর চেষ্টা করে, যাদের অনেকে দালালচক্রের খপ্পরে পড়ে প্রাণ হারায় বা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।” তিনি বাংলাদেশ, লিবিয়া ও ইইউর মধ্যে ত্রিপক্ষীয় সংলাপ এবং ভবিষ্যতে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের প্রস্তাব দেন। উপদেষ্টা এতে সম্মতি প্রকাশ করে ইইউকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের অনুরোধ জানান।

বৈঠকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (রাজনৈতিক ও আইসিটি) খন্দকার মো. মাহাবুবুর রহমান, যুগ্মসচিব মো. জসীম উদ্দিন খান এবং ইইউ ডেলিগেশনের কাউন্সেলর জুরেট স্মলসকেট মারভেল, ফার্স্ট সেক্রেটারি (পলিটিক্যাল) সেবাস্টিয়ান রাইগার-ব্রাউনসহ উভয় পক্ষের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

ঢাকা/নঈমুদ্দীন/এনএইচ

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • আরাকান আর্মির উপস্থিতি ভিডিওতে যেভাবে এসেছে তা সঠিক নয়: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
  • নির্বাচন নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার টালবাহানা করছে: রুহুল কবির রিজভী
  • পতিত সরকারের প্রধানের নির্দেশে ভাস্কর মানবেন্দ্রের বাড়িতে আগুন: রিজভী
  • বিশ্বব্যাপী ক্যান্সারের মতো ছড়াচ্ছে সাইবার অপরাধ
  • জামিনে মুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নজরে রাখার নির্দেশ দিলেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
  • বিশ্বশক্তির দাবা খেলায় কি ভারত কিস্তিমাত হয়ে যাচ্ছে
  • চা-মুড়ি ঐক্য পরিষদ
  • বরিশালে র‌্যাবের মাদকবিরোধী অভিযানে হামলা, গুলিতে তরুণ নিহত
  • দুই বাংলাদেশিকে ভারতে নির্যাতনের অভিযোগ, ভিডিও ভাইরাল
  • ঢাকায় ইইউভুক্ত দেশের ভিসা সেন্টার খোলার অনুরোধ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্ট