ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারি আবাস ছিল গণভবন। রাজধানী ঢাকার এই বাড়িতে কড়া পাহারায় বসবাস করতেন তিনি। ছাত্র-জনতার বিক্ষোভের সময় গত ৫ আগস্ট হাজারো মানুষ গণভবনে ঢুকে পড়েন। ক্ষমতা ছেড়ে ভারতে চলে যান শেখ হাসিনা। গণভবনে চলে ব্যাপক লুটপাট।

সেই থেকে গণভবন কার্যত পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। যদিও এখন আর সেখানে সাধারণ মানুষের প্রবেশের সুযোগ নেই। ভবনটি এখন সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে আছে। পাহারা দিচ্ছেন আনসার সদস্যরা। গত শনিবার অন্তর্বর্তী সরকারের অনুমতি নিয়ে গণভবনে প্রবেশ করে ঘুরে দেখার সুযোগ পান দ্য সানডে টাইমসের প্রতিবেদক।

যুক্তরাজ্যের ক্ষমতাসীন দল লেবার পার্টির মন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিকের প্রচারপত্র, লেবার পার্টির পোস্টার, নামী ব্র্যান্ডের শপিং ব্যাগ, দামি কলমের মোড়ক, বিদেশি বিশিষ্টজনদের উপহার দেওয়া পোশাক-গয়না, তৈজসপত্রসহ আরও নানা জিনিস পড়ে আছে এখানে-সেখানে।

সংবাদমাধ্যমটি তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, ঢাকায় জাতীয় সংসদ ভবনের পাশে শেখ হাসিনার সরকারি এই আবাসে কয়েক ডজন কক্ষ আছে এবং রয়েছে বিশাল বাগান ও হ্রদ। এই হ্রদে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী মাছ ধরতেন। তাঁর বিরুদ্ধে সীমাহীন দুর্নীতি আর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় কয়েক শ মানুষকে হত্যার ঘটনায় ‘মানবতাবিরোধী অপরাধের’ আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আনা হয়েছে।

গণভবনে গত বছরের ৫ আগস্ট ব্যাপক লুটপাট হয়। নগদ অর্থ, আসবাব, ফ্রিজ থেকে শুরু করে শাড়ি, গয়না, দামি খাবার—সবকিছু লুটপাট করা হয়। যদিও পরবর্তী সময়ে অনেকে লুটের জিনিস ফেরত দিয়ে গেছেন। তবে এখনো অনেক কিছু ধ্বংসস্তূপ আর ধুলার মধ্যে পড়ে আছে।

ধুলায় ঢেকে থাকা একটি রাজনৈতিক প্রচারপত্র পড়ে থাকতে দেখা গেল। এটা যুক্তরাজ্যের অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনীতিবিষয়ক মিনিস্টার (ইকোনমিক সেক্রেটারি) টিউলিপের। দেশটির আর্থিক খাতে দুর্নীতি বন্ধের দায়িত্বে আছেন তিনি। টিউলিপ ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানার মেয়ে। টিউলিপের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার আমলের দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগ উঠেছে।

পাশেই একটি মোড়ক পড়ে ছিল। সেটা সোনার প্রলেপ দেওয়া মন্টব্ল্যাঁ কলমের। একেকটির দাম দেড় হাজার ডলার। সঙ্গে পড়ে ছিল হীরার মান যাচাইয়ের সনদ। যুক্তরাজ্যের এক বিশিষ্ট আইনজীবীর একটি আইনি পরামর্শের কপি সেখানে দেখা গেছে। আন্তর্জাতিক একটি গণমাধ্যমে হাসিনার আমল নিয়ে করা অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের প্রকাশ আটকে দিতে আইনি পরামর্শ ছিল তাতে। বিদেশি ব্যাংকে হিসাব খোলার আবেদনপত্র পড়ে ছিল পাশেই।

শেখ হাসিনার বাবা ও বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবার হত্যার ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত একাধিক কূটনৈতিক তারবার্তার কপিও ধুলায় পড়ে থাকতে দেখা গেছে।

টিউলিপের সঙ্গে সম্পৃক্ত আরও কিছু জিনিস এখনো পরিত্যক্ত গণভবনে পড়ে আছে। এর মধ্যে একটি ‘ধন্যবাদ নোট’ দেখা গেছে। যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টের সদস্য (এমপি) নির্বাচিত হওয়ার পর নিজ এলাকা হ্যাম্পস্টেড ও কিলবার্নের লেবার পার্টির স্থানীয় সদস্যদের উদ্দেশে সেটা লেখা।

আরেকটি ছিল টিউলিপের ২০২২ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন। জীবনমানের ব্যয় বেড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে চরম সংকটে পড়া মানুষের কল্যাণে টিউলিপ যা যা করেছিলেন, সেসব সম্পর্কে পাঠকদের পড়ার আহ্বান রয়েছে তাতে।

যদিও টিউলিপ বরাবরই দাবি করে এসেছেন, খালার (শেখ হাসিনা) সঙ্গে তাঁর কখনোই রাজনৈতিক বিষয়ে কথাবার্তা হতো না। ২০১৭ সালে তিনি বলেছিলেন, খালার সঙ্গে ‘কখনোই’ রাজনীতি নিয়ে কথা বলেননি তিনি।

একই বছর এক সাংবাদিকের পক্ষ থেকে টিউলিপের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, যুক্তরাজ্যে পড়াশোনা করা এক আইনজীবীর ‘গুমের’ ঘটনায় শেখ হাসিনার সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছে কি না। তখন টিউলিপ সন্তানসম্ভবা ওই সাংবাদিককে হুমকি দিয়েছিলেন। ওই সাংবাদিক পুলিশে অভিযোগ জানিয়েছিলেন।

এর পর থেকে টিউলিপের বিরুদ্ধে অভিযোগ সামনে আসে, তিনি ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা যুক্তরাজ্যে এমন তিনটি সম্পত্তিতে বসবাস করেছেন, যেগুলো শেখ হাসিনার শাসনামলের কর্মকর্তা ও সহযোগীদের সঙ্গে সম্পৃক্ত। সংবাদমাধ্যম সানডে টাইমসের অনুসন্ধানে জানানো হয়েছে, এর একটি কেনা হয়েছিল অফশোর কোম্পানির মাধ্যমে। কর ফাঁকির আশ্রয়স্থল হিসেবে পরিচিত ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডসে নিবন্ধিত ওই কোম্পানির সঙ্গে বাংলাদেশের দুই ব্যবসায়ীর সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। আলোচিত পানামা পেপারসে ওই কোম্পানির নাম এসেছে।

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, টিউলিপের ব্যবহার করা সম্পত্তি নিয়ে তদন্ত হওয়া উচিত। মন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিককে বরখাস্ত করতে প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ার স্টারমারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন দেশটির বিরোধী দল কনজারভেটিভ পার্টির নেতা কেমি বেইডনক।

যদিও টিউলিপ বরাবর এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। এ পরিস্থিতিতে টিউলিপের ওপর ক্ষমতাসীন লেবার পার্টির সরকারের পূর্ণ আস্থা আছে, এটা বলতে গতকাল রোববার যুক্তরাজ্যের বিজ্ঞানমন্ত্রী পিটার কাইলি অস্বীকৃতি জানান।

যাহোক, শেখ হাসিনার দেশ ছাড়ার পর গণভবনকে জাদুঘরে রূপান্তরের কাজ চলছে বলে জানান অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কৃতি উপদেষ্টা ও স্বনামধন্য চলচ্চিত্র নির্মাতা ও চিত্রনাট্যকার মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। তিনি জানান, ফ্যাসিবাদের বিপদ সম্পর্কে দেশ-বিদেশের মানুষকে সতর্ক করতে এটাকে জাদুঘর করা হচ্ছে।

দেয়ালজুড়ে গ্রাফিতি

গণভবনের মূল প্রবেশপথ দিয়ে ঢুকতে চোখে পড়েছে একটি গ্রাফিতি। সাদা দেয়ালে লাল কালিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে শেখ হাসিনাকে ইঙ্গিত করে একটি বার্তা লেখা রয়েছে। শেখ হাসিনার সরকারের ভারতপ্রীতি বিতর্কিত একটি বিষয়।

বিশাল সিঁড়ি পেরিয়ে প্রথম তলায় শেখ হাসিনার শয়নকক্ষ। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে সেখানটায়। কিছু জিনিস এখনো অক্ষত আছে। তার মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের ৫০ বছর পূর্তির স্মারক ডাকটিকিট। সেটায় তাঁর প্রতিকৃতি অঙ্কিত আছে। এ ছাড়া শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার দিনের বিস্তারিত সময়সীমা ও ফোনকলের ট্রান্সক্রিপ্ট দেখা গেল।

প্রবেশপথের পাশেই পড়ে রয়েছে একটি ডেন্টাল চেয়ার, একটি ম্যাসাজ চেয়ার আরেকটি ট্রেডমিল।

হীরার মান যাচাইয়ের নথি

এক কোনায় ধুলা–ময়লার মধ্যে কিছু কাগজ পড়ে ছিল। এর মধ্যে একটি জেমোলজিক্যাল ইনস্টিটিউট অব আমেরিকার বিবৃতি। হীরার মান যাচাইয়ের জন্য বিশ্বে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য কর্তৃপক্ষ এটা।

শেখ হাসিনার শয়নকক্ষে এক জোড়া মার্কস অ্যান্ড স্পেনসার ব্র্যান্ডের দামি মোজার প্যাকেট পড়ে থাকতেও দেখা যায়।

পাশেই শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত রান্নাঘর। সেখানে বারবিকিউ স্বাদের হুলা হুপসের (আলু ও ভুট্টা দিয়ে বানানো খাবার। এটি যুক্তরাজ্যের বেশ জনপ্রিয়) প্যাকেট পড়ে থাকতে দেখা গেল। বাংলাদেশে এটা দুষ্প্রাপ্য।

ভবনটির বাইরের দিকে বেশ কিছু চেয়ার ও টেবিল সাজানো অবস্থায় রয়েছে।

গণভবন পরিদর্শনে প্রধান উপদেষ্টা ড.

মুহাম্মদ ইউনূস

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

জিনদের আবাস

হাদিসে আছে, মহানবী (সা.) ‘কার’-বিশিষ্ট ভূমিতে প্রবেশ করতে নিষেধ করছেন। কারণ সেটা জিনদের আবাসস্থল। তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হলো, ‘কার’ কি? তিনি বলেন, ঘন ঝাড়-জঙ্গল, গাছপালা ঘেরা নিম্নাঞ্চল। এ ছাড়া জনবসতির শৌচাগার, গোসলখানা, নোংরা ও অপবিত্র স্থান, আবর্জনার স্তূপ এবং কবরস্থানে দুষ্ট জিন-শয়তান বিচরণ করে। তিনি বলেছেন, ‘নিশ্চয় শৌচাগারে দুষ্ট জিন-শয়তান উপস্থিত থাকে। তাই তোমরা যখন সেখানে প্রবেশ করবে তখন বলবে, ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিলান খুবুসি ওয়াল খবাইস।’ অর্থাৎ, আমি আল্লাহর কাছে যাবতীয় দুষ্ট পুরুষ ও নারী জিন ও শয়তান থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি।’ (আবু দাউদ, হাদিস: ৬)

হাদিস অনুযায়ী শৌচাগার হলো, যেখানে নাপাক থাকে বা শরীর বস্ত্রহীন করতে হয়, সেসব জায়গায় শয়তানের আনাগোনা থাকে। মানুষকে বিবস্ত্র করা শয়তানের অন্যতম একটি কাজ। কারণ আল্লাহর এবং বান্দার মধ্য আবরণ হলো লজ্জা। আদম ও হাওয়া (আ.) যখন আল্লাহর আদেশ অমান্য করেছিলেন, প্রথমেই তাদের শরীর থেকে জান্নাতের পোশাক খুলে গিয়েছিল।

আরও পড়ুনইবলিস কি জিন নাকি ফেরেশতা১৬ মার্চ ২০২৫

নবীজি (সা.) মাটির গর্তে প্রস্রাব করতে নিষেধ করেছেন। এতে জিনদের বসবাসের স্থান।’ (আবুদাউদ, হাদিস: ২৯)

কবরস্থানে জিনেরা সাধারণত মানুষের মতোই যাতায়াত করে। আবার কখনো অবস্থান করে দীর্ঘদিন। ভালো-মন্দ সব ধরনের—এমনকি সেখানে দুষ্ট প্রকৃতির জিন-শয়তানরাও অবস্থান করে।

একটা ভুল ধারণা লোকসমাজে প্রসিদ্ধ আছে, ‘বদকারদের কবরের আজাবের ভয়ে জিনেরা কবরস্থানে থাকে না।’ অথচ নবীজি বলেছেন, ‘অতঃপর তার জন্য লোহার বিশাল হাতুড়িধারী একজন অন্ধ ও বধির ফেরেশতা নিযুক্ত করা হয়। সেই ফেরেশতা ওই হাতুড়ি দিয়ে অবিশ্বাসীকে এমন জোরে আঘাত করে; যার আওয়াজ মানুষ ও জিন ছাড়া পূর্ব-পশ্চিমের সব সৃষ্টি শুনতে পায়।’ (আবু দাউদ, ৪,৭৫৩)

এ ছাড়া বাজার ও দোকানপাটে দুষ্ট জিন-শয়তানের আনাগোনা বেশি থাকে। আল্লাহর রাসুল (সা.) জানিয়েছেন, ‘বাজারে শয়তান তার যুদ্ধের পতাকা উত্তোলন করে।’ (মুসলিম, হাদিস: ২,৪৫১)

আরও পড়ুনএকদল জিন পবিত্র কোরআন শুনে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন২০ নভেম্বর ২০২৩

সম্পর্কিত নিবন্ধ