ভ্যাটাভ্যুত্থান, মহার্ঘ ভাতা: কার পক্ষে কে নিচ্ছে সিদ্ধান্ত
Published: 13th, January 2025 GMT
শীতে ঢাকায় গ্যাস-সংকট সীমা ছাড়িয়েছে। অনেক এলাকায় ভোর হতে না হতেই গ্যাস চলে যাচ্ছে, আসছে রাতে। ফলে মধ্যরাতে চুলা জ্বলছে, রান্নাবান্নার কাজ সারতে হচ্ছে। মাসের শুরুতে তিন দিন একবারের জন্যও গ্যাস আসেনি।
দুই বছর আগে প্রথম আলোয় লিখেছিলাম—‘গ্যাসের চুলা না জ্বালালেও কেন মাস শেষে বিল’। সেই চিত্রের বদল হয়নি। ফলে মাস শেষে গ্যাসের বিল যেমন দিতে হচ্ছে, আবার ইনডাকশন চুলা, রাইস কুকারে রান্নার কারণে বাড়তি বিদ্যুৎ বিল দিতে হচ্ছে কিংবা সিলিন্ডার কেনার কারণে বাড়তি খরচ করতে হচ্ছে।
এই যে বাড়তি খরচের বোঝা, এর কোনো দায় সাধারণ মানুষের নয়। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পতন হওয়া শেখ হাসিনা সরকারসহ পূর্ববর্তী সরকারগুলোর ভুল জ্বালানি নীতির ফলাফল এটা।
আওয়ামী লীগের শাসনামলে অলিগার্কদের শাসনে যে স্বজনতোষী অর্থনীতি গড়ে উঠেছিল, সেখানে লুটপাটের অন্যতম ক্ষেত্র ছিল জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত। ১৫ বছরে ২৩৪ বিলিয়ন ডলার দেশ থেকে পাচার হয়েছে, এর অন্যতম উৎস ছিল এ খাত। ফলে লোকসানের বিরাট বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল নাগরিকদের ঘাড়ে। দফায় দফায় বিদ্যুৎ আর জ্বালানির দাম বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস আর জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করার নামে যে দাম বাড়ানো হয়েছে, সেটাই হয়নি। এটা ছিল প্রতারণা করে, ছল করে নাগরিকের পকেট থেকে টাকা বের করে নেওয়ার ফন্দি।
ব্যবসায়ী-রাজনীতিবিদ-আমলাতন্ত্রের সমন্বয়ে যে অলিগার্কি কাঠামো ছিল, তারা রাজস্ব বাড়ানোর খুব সহজ সমাধান হিসেবে কর, ভ্যাট, শুল্ক ও বিদ্যুৎ-জ্বালানির দাম বাড়ানোর পথ বেছে নিয়েছিল। ফলে গোটা রাষ্ট্রযন্ত্রই গোষ্ঠীস্বার্থ রক্ষার এমন এক যন্ত্র হয়ে উঠেছিল, যাদের ভাবনায় জনগণ হলো হাতেম তাই কিংবা গৌরী সেন।
কোভিড মহামারি আর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ আওয়ামী লীগ সরকারের উন্নয়নের বয়ানটাকে নগ্ন করে দিয়েছিল। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত দেশের সিংহভাগ মানুষ কীভাবে কায়দা করে টিকে আছে, সেটা সত্যিই অর্থনীতিবিদদের একটা গবেষণার বিষয় হতে পারে। আজ ওষুধের খরচ, কাল ছেলেমেয়েদের পড়ার খরচ, পরশু পাত থেকে ডিমের খরচ, দুধের খরচ ছেঁটে ফেলে মানুষ প্রতিনিয়ত তার আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের ছুটন্ত ঘোড়াটার সঙ্গে মানিয়ে চলতে চেষ্টা করে চলেছে। কিন্তু সবারই সহ্যের একটা সীমা থাকে।
জীবনযাপনের এই সর্বব্যাপী সংকট থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা নিয়ে জুলাই-আগস্টে সর্বস্তরের মানুষ ছাত্রদের ডাকে রাস্তায় নেমে এসেছিলেন। রক্ত আর অসাধারণ আত্মত্যাগে তাঁরা রচনা করেন অনন্য এক ইতিহাস। কিন্তু জনগণের ঘাড়ে বোঝা চাপিয়ে দেওয়ার সমাধানবৃত্ত থেকে কতটা বের হওয়া গেল?
এটা অস্বীকারের জো নেই, শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরে প্রতিষ্ঠানগুলো যেভাবে ভেঙে পড়েছিল, অর্থনীতি যেভাবে খাদের কিনারে চলে গিয়েছিল, সেখান থেকে দেশকে ঠিক রাস্তায় তোলাটা বিশাল এক কঠিন কাজ। পাঁচ মাসে সেটা প্রত্যাশা করাও বোকামি। কিন্তু এটাও বাস্তবতা যে মানুষ আর পুরোনো ব্যবস্থায় ফিরতে চান না। তাঁরা চান না, সরকার ব্যয়ের ভারটা তাদের ন্যুব্জ হয়ে যাওয়া কাঁধে চাপিয়ে দিক। পুরোনো ব্যবস্থার সঙ্গে তাঁরা সুস্পষ্ট একটা ছেদবিন্দু দেখতে চান।
প্রশ্ন জাগছে, সরকার কেন একদিকে শতাধিক পণ্য ও সেবায় শুল্ক-কর বাড়িয়ে ১২ হাজার কোটি মানুষের পকেট থেকে বের করতে চাইছে, অন্যদিকে মহার্ঘ ভাতায় সাত হাজার কোটি ব্যয় করার কথা চিন্তা করছে। অর্থনীতিবিদ ড.জাহিদ হোসেন প্রশ্ন করেছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার পক্ষে অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা কি আছে?
কিন্তু বাস্তবতা ঠিক উল্টোটাই তাঁদের সামনে নিয়ে আসছে। সরকার শিল্প খাতে গ্যাসের দাম একধাপে ঘনফুটপ্রতি ৩০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭৫ টাকা করার প্রস্তাব দিয়েছে। এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হলে ধুঁকতে থাকা শিল্প খাতে বড় একটা ধাক্কা লাগবে। এমনিতেই সরকার পতনের পর সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় পড়েছে শিল্প খাত ও এর শ্রমিকেরা। অনেক কারখানা বন্ধ হয়েছে। বেকার হয়েছেন হাজার হাজার শ্রমিক। দেশে হঠাৎ অপরাধ বেড়ে যাওয়ার পেছনে এই কাজ হারানোর বাস্তবতাকে অস্বীকার করা যাবে কি? গ্যাসের দাম বাড়লে পাটিগণিতের ঐকিক নিয়মের সূত্রেই জিনিসপত্রের দাম বাড়বে। জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়বে।
নতুন বছর মানেই বাংলাদেশের মানুষের সামনে নতুন নতুন ব্যয়ের বোঝা যুক্ত হওয়া। রংপুর থেকে আমার এক বন্ধু তাঁর সন্তানের স্কুলে ভর্তির ফি জোগাড়ের জন্য ফোন দিয়েছেন। প্রথম শ্রেণিতে ভর্তির জন্য ২০ হাজার টাকা ফি দিতে হবে। মানে যাঁদের ছেলেমেয়ে বেসরকারি স্কুল-কলেজে পড়ে, তাঁদের অনেকের জন্য বছরের শুরুটা হয় এ রকম রূঢ় বাস্তবতা দিয়ে। প্রাইভেট স্কুলগুলো নিয়ম বানিয়ে ফেলেছে, প্রতিবছর ভর্তি ফি দিতে হবে। এই যে এক দেশে সাত-আটটা শিক্ষাব্যবস্থা, এর চেয়ে বড় বৈষম্য আর কী হতে পারে!
নতুন বছর মানে, যাঁরা ভাড়া বাসায় থাকেন, তাঁদের বাসাভাড়া বাড়া। যাঁরা বাড়তি খরচের সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারেন না, তাঁদের চলে যেতে হয় শহরের আরেক প্রান্তে, কম ভাড়ার বাসায়। ওই যে ঋত্বিক ঘটকের নাগরিক সিনেমার শেষ দৃশ্যটা এই শহরের একটা রূঢ় বাস্তবতা।
দুই.
নতুন বছরে ধনী, মধ্যবিত্ত, গরিব—সবার খরচ বাড়ছে। এখানে সরকারের নীতিটা সাম্যবাদী। কারণ, সরকার ১০০-এর বেশি পণ্য ও সেবায় ভ্যাট বাড়িয়ে দিয়েছে। ভ্যাট হলো পরোক্ষ কর। পোশাক কিনতে, ওষুধ কিনতে, বেড়াতে গেলে খরচ বাড়বে। রেস্তোরাঁয় খেতে গেলে খরচ বাড়বে। বিদেশি ফল খেতে গেলে খরচ বাড়বে।
মুঠোফোনে কথা বলতে গেলে খরচ বাড়বে। খরচ বাড়বে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে গেলে। অর্থ উপদেষ্টা অবশ্য বলেছেন, এই বর্ধিত ভ্যাটে মূল্যস্ফীতি হবে না। কিন্তু এটা নিশ্চিত, এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন ছোট, মাঝারি ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তা। ব্যয়ের মানুষ ভোগ কমিয়ে দিলে তাতে শেষ পর্যন্ত অর্থনীতির বারোটা বাজবে।
প্রথম আলোর খবর বলছে, রাজস্ব আদায় কম, আইএমএফ চাপ দিচ্ছে, বিদেশি ঋণ আসছে না। তাই বাজেটঘাটতি মেটাতে শুল্ক-কর ও ভ্যাট বাড়ানোর সহজ রাস্তা নিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এই ভ্যাট বাড়ানোর কারণে মানুষের পকেট থেকে সরকারের কাছে যাবে ১২ হাজার কোটি টাকা। এ রকম সিদ্ধান্তে মানুষ যে অসন্তুষ্ট ও ক্ষুব্ধ, তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম খুললেই আঁচ করা যায়। বিএনপি, নাগরিক কমিটিসহ সব ধারার রাজনৈতিক দল সরকারকে এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার আহ্বান জানিয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনও বর্ধিত ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকে ট্রল করে এটিকে বলছেন ‘ভ্যাট্যাভ্যুত্থান’। প্রশ্ন হচ্ছে, মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কে চলমান যখন, তখন জনগণের ওপর ১২ হাজার কোটি টাকার শুল্ক-কর বসানোর যুক্তি কী?
তিন.
আমনের ভরা মৌসুমেও চালের দাম বেড়েছে। সবচেয়ে শঙ্কার বিষয় হচ্ছে, মোটা চালের দামও বেড়েছে। এটি আমাদের ২০০৭-০৮ সালের কথা মনে করিয়ে দেয়। বন্যা, সিডরের কারণে ধানের উৎপাদন কম হওয়ায় সে সময়ে এক লাফে চালের দাম বেড়ে গিয়েছিল। বন্যার কারণে এবার আমনের উৎপাদন কিছুটা কম হবে, সেটা আগে থেকেই ধারণা করা হয়েছিল। আগেভাগেই ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। সরকার চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নিলেও বাস্তবে আমদানি হয়েছে অনেক কম।
গরিব মানুষের খাবার খরচের সিংহভাগ ব্যয় হয় চালের পেছনে। চালের দাম বেড়ে গেলে সবচেয়ে বড় সংকটে পড়েন তাঁরা। টিসিবির ট্রাকের পেছনে মানুষের লম্বা লাইনই বলে দিচ্ছিল সংকটটা কতটা প্রকট। বাজারের থেকে কম দামে চাল, তেল ও ডাল কেনার লাইনে দাঁড়িয়েও অনেককে শূন্য হাতে ফেরত যেতে হতো। কিন্তু হঠাৎই ট্রাক সেল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের ট্রাকে করে ভর্তুকি মূল্যে কৃষিপণ্য বিক্রিও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে অনিয়মের অভিযোগে ৪৩ লাখ পরিবারের কার্ড বাতিল করা হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এই ৪৩ লাখ পরিবার সচ্ছল নাকি রাজনৈতিক বিবেচনায় তাদের কার্ড বাতিল করা হয়েছে?
দাম না পাওয়ায় তাঁরা সেসব সবজি গরু-ছাগলকে খাওয়াচ্ছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, এই যে ধাক্কা, সেটা কাটিয়ে উঠতে কত দিন লেগে যাবে কৃষকদের?উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
ইউক্রেনে জেলেনস্কির বিকল্প নেতা খুঁজছে যুক্তরাষ্ট্র!
ইউক্রেনে শান্তিচুক্তির জন্য দেশটির প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির পদত্যাগ করা লাগতে পারে বলে জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইক ওয়ালৎস। তিনি বলেছেন, ‘ইউক্রেনের একজন নেতা প্রয়োজন, তিনি আমাদের সঙ্গে কাজ করতে পারবেন। তিনি শেষ পর্যন্ত রাশিয়ার সঙ্গে কাজ করতে পারবেন এবং এই যুদ্ধ থামাতে পারবেন।’ খবর- সিএনএন
গণমাধ্যমের সামনেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির নজিরবিহীন বাগবিতণ্ডার পর এ কথা বললেন তিনি। বাগবিতণ্ডার এ ঘটনাটি নিয়ে নানা আলোচনা চলছে বিশ্বজুড়ে। ওই ঘটনার পর ইউক্রেনের খনিজ সম্পদ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যে ঐতিহাসিক চুক্তি হওয়ার কথা ছিল, সেটিও বাতিল হয়ে যায়। আর এর পরই ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ কোন পথে, তা নিয়ে শুরু হয় আলোচনা।
এই প্রকাশ্য দ্বন্দ্ব ন্যাটোর ইউরোপীয় সদস্যদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বড় সংকটের ইঙ্গিত দিচ্ছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। শুক্রবারের ওই ঘটনায় সাবেক ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের গড়া ওয়াশিংটন-কিয়েভ সম্পর্ক ভেঙে পড়েছে। এই প্রকাশ্য দ্বন্দ্ব ন্যাটোর ইউরোপীয় সদস্যদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বড় সংকটের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
যদিও ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের বিষয়ে আবারও এক টেবিলে বসার ইঙ্গিত দিয়েছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও। তিনি বলেছেন, ইউক্রেন ও রাশিয়া-দুই পক্ষই আলোচনায় না বসলে যুদ্ধ থামবে না। হোয়াইট হাউসে শুক্রবার ট্রাম্প-জেলেনস্কি বিতণ্ডার পর থেকে ইউক্রেনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের আর কথা হয়নি। যুদ্ধ থামানোর জন্য রাশিয়াকে আলোচনার টেবিলে আনতে হবে। তবে তাদের প্রতি বৈরী মনোভাব রাখলে, মস্কোকে আলোচনায় যুক্ত করা সম্ভব হবে না। কোনো চুক্তি করার ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এই মনোভাবই দেখিয়ে আসছেন।
তিনি বলেন, ‘আমি আশা করি, সবকিছু আবার শুরু হতে পারে। আশা করি, তিনি (জেলেনস্কি) এটা বুঝতে পারবেন যে আমরা আসলে আরও হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুর আগে, তাঁর দেশকে সাহায্যের চেষ্টা করছি।’