৬ জানুয়ারি ১১ জন ইয়েমেনি বন্দীকে ওমানে পাঠানো হয়েছে। তাঁরা গুয়ানতানামো বন্দিশালায় ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্র সরকার তাঁদের মুক্তির অনুমতি দিয়েছে। 

এর আগে পেন্টাগন রিদাহ বিন সালেহ আল-ইয়াজিদি নামের একজনকে গুয়ানতানামো কারাগার থেকে ছেড়ে দিয়ে তিউনিসিয়ায় ফেরত পাঠায়। তিনি ২০০২ সালে গুয়ানতানামো খোলার সময় থেকে কোনো অভিযোগ ছাড়াই বন্দী ছিলেন। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি আরও তিনজন বন্দী মুক্তি পান। তাঁদের দুজনকে মালয়েশিয়ায় এবং একজনকে কেনিয়ায় পাঠানো হয়। 

গুয়ানতানামো কারাগার বানানোর ২৩ বছর পর এখন সেখানে বন্দীর সংখ্যা সবচেয়ে কম। বর্তমানে সেখানে মাত্র ১৫ জন বন্দী রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ‘নাইন–ইলেভেন ফাইভ’খ্যাত পাঁচজনও রয়েছেন। 

বন্দীর সংখ্যা কমে গেলেও এই অধ্যায় শেষ হয়নি। কারণ, যাঁরা এখনো বন্দী, তাঁদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। আর যাঁরা মুক্তি পেয়েছেন, তাঁদের অনেকেই এখনো গুয়ানতানামোর নির্যাতন–পরবর্তী মানসিক ও শারীরিক ক্ষতির সঙ্গে লড়াই করছেন। 

গুয়ানতানামো শুধু একটি বন্দিশালা নয়; এটি সাম্রাজ্যবাদ, বৈষম্য ও নিষ্ঠুরতার প্রতীক। এটি দেখায় যে ভিন্ন সম্প্রদায়কে অপরাধী সাব্যস্ত করতে যুক্তরাষ্ট্র কত নিচে নামতে পারে। একই সঙ্গে এটি কিউবার ভূমির ওপর মার্কিন দখলদারির কথাও মনে করিয়ে দেয়।

দুই দশকের বেশি সময় ধরে গুয়ানতানামো যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এমন একটি জায়গা হিসেবে পরিচিত, যেখানে আগেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, কারা শাস্তি পাবে আর কারা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত থাকবে। 

মার্কিন গবেষক অ্যামি ক্যাপলান তাঁর ‘হয়্যার ইজ গুয়ানতানামো?’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘গুয়ানতানামোকে আজকের বন্দিশিবির হিসেবে ব্যবহার করার বিষয়টি জায়গাটির ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত। এটি সাম্রাজ্যবাদের একটি উদাহরণ; যেখানে জাতীয় সীমান্তের বাইরে এবং আইনের শাসনের বাইরে রাষ্ট্রের ক্ষমতা জোর করে ব্যবহার করা হয়।’ 

গুয়ানতানামো দখল করেও যুক্তরাষ্ট্র বলে আসছে, কিউবার এই এলাকার সার্বভৌমত্ব আছে। কিন্তু কিউবার এখানে কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই বা মার্কিন আধিপত্যের বিরুদ্ধে কিছু করার ক্ষমতা নেই। এই সাম্রাজ্যবাদী আচরণের কারণেই গুয়ানতানামোয় এত মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে। ২০০১ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অনেক দেশে যুদ্ধ করেছে, দখল করেছে এবং অনেক বন্দীকে এসব দেশ থেকে ধরে এনেছে। 

গুয়ানতানামো দখল করেও যুক্তরাষ্ট্র বলে আসছে, কিউবার এই এলাকার সার্বভৌমত্ব আছে। কিন্তু কিউবার এখানে কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই বা মার্কিন আধিপত্যের বিরুদ্ধে কিছু করার ক্ষমতা নেই। এই সাম্রাজ্যবাদী আচরণের কারণেই গুয়ানতানামোয় এত মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে। ২০০১ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অনেক দেশে যুদ্ধ করেছে, দখল করেছে এবং অনেক বন্দীকে এসব দেশ থেকে ধরে এনেছে। 

এ সহিংসতা শুধু ওই অঞ্চলে নয়, বন্দীদের শরীরেও ফুটে উঠেছে। দখল করা কিউবার মাটিতে বন্দীদের প্রতি এ আচরণ যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতার এক নগ্ন উদাহরণ।

এ অবস্থা এখনো চলছে। অনেক বন্দীকে তাঁদের নিজের দেশ, বিশেষ করে ইয়েমেনে ফেরত পাঠানো হয়নি। কারণ, সেখানে এখনো যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ চালাচ্ছে। 

মিশেল ফুকো তাঁর ডিসিপ্লিন অ্যান্ড পানিশ বইয়ে বলেছেন, উনিশ শতকের শুরুতে শাস্তি দেওয়ার প্রকাশ্য পদ্ধতি বদলে যায়। শারীরিক যন্ত্রণা বা প্রকাশ্য শাস্তি কমে আসে। কারণ, ক্ষমতা প্রয়োগের সূক্ষ্ম পদ্ধতি মানুষের ক্ষোভ কমিয়ে কর্তৃত্ব বজায় রাখতে চায়। কিন্তু গবেষক সোহাইল দৌলতজাই দেখিয়েছেন, ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের’ ক্ষেত্রে ফুকোর তত্ত্বের উল্টোটা ঘটেছে। নাইন–ইলেভেন হামলার পর যুক্তরাষ্ট্র শাস্তি ও নির্যাতনের একটি ‘অতিরিক্ত যুগ’ চালু করে। বিশেষ করে মুসলিমদের বিরুদ্ধে এ নির্যাতন প্রকাশ্যে দেখানো হয়। এখানে যুদ্ধ জেতার প্রমাণ হিসেবে এ নির্যাতনকে প্রকাশ্যে আনা হয় এবং নির্যাতনকে ন্যায়সংগত বলে প্রচার করা হয়। 

দৌলতজাই আরও বলেন, মুসলিমদের শাস্তি যেন স্বাভাবিক ও সঠিক মনে করা হয়; কারণ, ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে’ মুসলিমদের হুমকির প্রতীক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। 

২৩ বছর আগে গুয়ানতানামোয় আনা বন্দীদের একটি ছবি তোলা হয়েছিল। ওই ছবিতে দেখা যাচ্ছিল, বন্দীরা কমলা রঙের পোশাক পরে হাঁটু গেড়ে বসে ছিলেন। তাঁদের চোখে চশমা ছিল। মুখ বাঁধা অবস্থায় ছিল। নাইন–ইলেভেন হামলার পর মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগ ইচ্ছা করে এ ছবি প্রকাশ করেছিল। 

জেনারেল রিচার্ড মায়ার্স তখন বলেছিলেন, এই বন্দীরা এত বিপজ্জনক যে তাঁরা দাঁত দিয়ে কামড়ে বিমান ভেঙে ফেলতেও সক্ষম। ক্যাম্প এক্স-রের কমান্ডার মাইকেল লেহনার্ট তাঁদের ‘সবচেয়ে ভয়ংকর অপরাধী’ বলে বর্ণনা করেছিলেন।

এ ধরনের কথাবার্তা মুসলিম বন্দীদের শত্রু হিসেবে তুলে ধরতে এবং তাঁদের আইনগত অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে সাহায্য করেছিল।

এ কারাগার যত দিন খোলা থাকবে, তত দিন এটি বন্দীদের জন্য একটি অবিচারের স্থান হিসেবে থাকবে। তাই এটি বন্ধ করা সময়ের দাবি। 

ড.

মাহা হিলাল গবেষক ও লেখক। তিনি মুসলিম কাউন্টারপাবলিকস ল্যাবের প্রতিষ্ঠাতা নির্বাহী পরিচালক এবং উইটনেস এগেইনস্ট টর্চারের সংগঠক

মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

‘মাফিয়া বসদের মতো’ আচরণ করেছেন ট্রাম্প

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির মধ্যে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়ের ঘটনা বৈশ্বিক গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার হয়েছে। একই চিত্র দেখা গেছে ইউরোপের গণমাধ্যমেও।

স্থানীয় সময় গত শুক্রবার সন্ধ্যা থেকেই ইউরোপীয় গণমাধ্যমগুলোর প্রধান সংবাদ এখন হোয়াইট হাউসে ট্রাম্প ও জেলেনস্কির বৈঠক। জেলেনস্কির প্রতি ট্রাম্পের আচরণের সমালোচনা করে ইউরোপের সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, ট্রাম্প ও তাঁর ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স ওভাল অফিসে রাষ্ট্রনায়কের মতো আচরণ করেননি, বরং ‘মাফিয়া বসদের’ মতো আচরণ করেছেন।

ফরাসি দৈনিক লে ফিগারো ট্রাম্পকে একজন রুশ শাসকের সঙ্গে তুলনা করেছে। পত্রিকাটি লিখেছে, ‘আমেরিকাতে এখন একজন জারের খেলা খেলছেন, যিনি গণতান্ত্রিক রীতিনীতি ভুলেছেন এবং পশ্চিমাদের পতন চান।’ ফরাসি দৈনিকটি আরও বলেছে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের আগামী শাসনামল সম্পর্কে এখান থেকে ধারণা পাওয়া যায়।

যুক্তরাজে্যর সংবাদমাধ্যম দ্য টেলিগ্রাফ বলেছে, ‘পশ্চিমা ঐক্য অপরিহার্য বলেই মনে হচ্ছে।’ পত্রিকাটি আরও লিখেছে, এই উত্তপ্ত বাগ্‌বিতণ্ডার ভয়াবহ দৃশ্য দেখে ব্রিটেন এবং ইউরোপের যে কেউ তাদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হবে।

ইতালির সংবাদপত্র কোরিয়ের ডেলা বলেছে, ‘ইউরোপ এখন নিজেদের সবচেয়ে খারাপ আশঙ্কাকে সত্য হতে দেখছে। কিয়েভকে তার ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দেওয়া ছাড়া উপায় নেই। আটলান্টিকের অপর পারে যাদের বন্ধু ভাবা হতো, তারা আদতে বন্ধু নয়।’

স্প্যানিশ সংবাদপত্র এল পাইস লিখেছে, ‘ওভাল অফিস থেকে একটি স্পষ্ট বার্তা এসেছে, তা হলো যদি আমাদের জরুরি প্রয়োজন ও নিরাপত্তা সম্পর্কে কোনো সংশয় থাকে, তাহলে বিশ্বে আমাদের বন্ধু কারা, সেই বিষয় পুনর্বিবেচনা করতে হবে।’

সুইজারল্যান্ডের সংবাদপত্র নিউ জুরচার জেইতুং পরামর্শ দিয়ে লিখেছে, ‘যদি ইউরোপীয়রা সত্যিই ইউক্রেনে টেকসই শান্তি চায়, তাহলে সম্ভবত তাদের নিজেদেরই নেতৃত্ব নিতে হবে, আমেরিকান আশ্বাসে ভরসায় থেকে নয়।’

জার্মানির ডের স্পিগেল পত্রিকা লিখেছে, ‘ট্রাম্প ও জেলেনস্কির মধ্যে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আলোচনা দেখে মনে হয়েছে, আমরা একটি নতুন বিশ্বে বাস করছি। পশ্চিমা বিশ্বে এখন তার পুরোনো শীর্ষ বন্ধুর কবল থেকে বের হয়ে আসার সময় হয়েছে।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ইউক্রেন-রাশিয়ার শান্তিচুক্তির ভবিষ্যৎ কী?
  • কুয়েটের দুই প্রকৌশলীকে হুমকির পর একজনকে মারধর, অভিযোগ বিএনপি নেতার বিরুদ্ধে
  • ট্রাম্প স্পষ্ট করেছেন, ইউরোপকে একলা চলতে হবে
  • আপনার আচরণ এমন হবে ভাবিনি: জামিলকে নূনা আফরোজ
  • সরকার জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের মর্মবস্তু ধারণ করতে ক্রমাগত ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে
  • ‘মাফিয়া বসদের মতো’ আচরণ করেছেন ট্রাম্প
  • ক্ষমতা অপব্যবহারের দায় সরকার এড়াতে পারে না: টিআইবি
  • ক্ষমতার অপব্যবহারের দায় সরকার এড়াতে পারে না: টিআইবি
  • রিয়াল মাদ্রিদকে বড় অঙ্কের জরিমানা উয়েফার
  • গার্দিওলার সঙ্গে সমর্থকদের বাজে আচরণে জরিমানা রিয়ালের