অধ্যাপক আনিসুর রহমান, বাংলাদেশ তথা বিশ্বের একজন প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ও উন্নয়নবিশেষজ্ঞ এবং একই সঙ্গে একজন রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী ও আরও নানা অভিধায় পরিচিত এক মহান ব্যক্তিত্ব। তবে আমরা এ লেখায় আজ তাঁকে একান্তভাবে স্মরণ করেছি রিসার্চ ইনিশিয়েটিভস, বাংলাদেশের (আরআইবি) একজন স্বপ্নদ্রষ্টা, পথনির্দেশক এবং পরিচালনা পর্ষদের একজন বিশিষ্ট সদস্য হিসেবে তাঁর ভূমিকা নিয়ে।

অধ্যাপক আনিসুর রহমান ৫ জানুয়ারি প্রয়াত হয়েছেন। তাঁর স্মরণে আরআইবি অফিসে চেয়ারম্যান ড.

শামসুল বারির পরিচালনায় আরআইবি কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে এক স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে আরআইবির প্রতিষ্ঠাকাল থেকে আমৃত্যু অধ্যাপক আনিসুর রহমান যে ভূমিকা পালন করে গেছেন, তার ওপর আলোচনা করা হয়।

আরআইবি প্রতিষ্ঠিত হয় ২০০২ সালে সাতজন বোর্ড সদস্য নিয়ে। তার মধ্যে অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য অধ্যাপক আনিসুর রহমান। নেদারল্যান্ডস সরকারের দীর্ঘমেয়াদি আর্থিক সহায়তায় শুরুতে আরআইবির কার্যক্রম ছিল প্রধানত দুই ধরনের। এক. দারিদ্র্য বিমোচন গবেষণার কাজে বিভিন্ন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়া। দুই. জনগণের চাহিদাভিত্তিক ও অংশগ্রহণমূলক গবেষণার জন্য নতুন গবেষক সৃষ্টিতে সহায়তা করা।

দারিদ্র্য বিমোচনসংক্রান্ত গবেষণায় আরআইবি দারিদ্র্যকে সামগ্রিকভাবে ও মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করে নতুন ধারা সৃষ্টির উদ্যোগ নেয়। দারিদ্র্যের মানবিকীকরণ দৃষ্টিভঙ্গি তৈরির ক্ষেত্রে অধ্যাপক আনিসুর রহমান গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। তাঁর মতাদর্শ অনুসরণ করে আরআইবি মনে করে, দরিদ্র জনগণের চাহিদা শুধু অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-স্বাস্থ্য-শিক্ষার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এর বাইরেও সুবিচার, সাম্য, বৈষম্য দূরীকরণ, সুশাসন, মানবাধিকার, সংস্কৃতি, জ্ঞানতৃষ্ণা পূরণসহ সর্বোপরি সৃজনশীলতা ও সৌন্দর্য বিকাশের সুযোগ সৃষ্টির চাহিদা রয়েছে। দারিদ্র্যকে সার্বিকভাবে অনুধাবন করার এই যে অনন্য দৃষ্টিভঙ্গি, তা একান্তই আনিস স্যারের মানসজাত।

আরআইবি গবেষণাকে শুধু টেকনিক্যাল প্রশ্নে সীমাবদ্ধ রাখেননি। এর লক্ষ্য, অভীষ্ট জনগোষ্ঠীর জীবনের উন্নয়ন তথা জনগণের আত্ম-উন্নয়ন। সারা দেশে তৃণমূল পর্যায়ে অনেক সুবিধাবঞ্চিত ও অধিকারবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর নিজেদের প্রচেষ্টায় স্বাবলম্বী হওয়ার অনেক দৃষ্টান্ত আছে, যাকে উন্নয়নের পরিসরে সামনে নিয়ে আসা প্রয়োজন। এ বিষয়ে আনিস স্যার সব সময় জনগণের আত্মশক্তির কথা সামনে তুলে ধরেছেন। জনগণকে ‘দরিদ্র’অভিধায় অভিহিত করার যে প্রয়াস এই শতকের গোড়ার দিকের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে দেখা যেত, তার প্রচণ্ড রকম বিরোধিতা করেছেন তিনি। দরিদ্রজনের অর্থনৈতিক দারিদ্র্যকে অস্বীকার না করে, বরং তাদের অফুরন্ত সম্ভাবনা ও সৃজনশীলতার প্রতি হাত বাড়িয়ে দিয়ে তাদের সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পথে কাজ করেছেন তিনি। তিনি ‘দরিদ্র’ না বলে ‘সুবিধাবঞ্চিত’ও ‘অধিকারবঞ্চিত’—এই টার্মগুলো ব্যবহার করতে আমাদের উদ্বুদ্ধ করেছেন। আরআইবি সেই ধারাবাহিকতা এখনো বজায় রেখেছে।

পার্টিসিপেটরি অ্যাকশন রিসার্চ (পিএআর) বা গণগবেষণাতত্ত্বকে বাংলাদেশে পরিচিত করেছেন অধ্যাপক আনিসুর রহমান। এই তত্ত্বকে আরআইবি তার সব গবেষণার কাজে প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন করে এগিয়ে যাচ্ছে আগামীর দিকে। প্রথম দিকে এই তত্ত্বকে বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষা কর্মসূচিতে সামাজিক বিজ্ঞানের মানদণ্ডের পরিসরে মেনে নিতে অনীহা ছিল। কিন্তু আরআইবির বাস্তবায়ন ও জনমনে এর গ্রহণযোগ্যতা এবং সেই সঙ্গে আরও কিছু বেসরকারি সংগঠনের কর্মসূচিতে এর অন্তর্ভুক্তি গণগবেষণাতত্ত্বের গ্রহণযোগ্যতাকে দৃঢ় করেছে।

গণগবেষণার একটি মৌলিক ধারণা হলো চিন্তাশক্তি বা জ্ঞানের দিক দিয়ে কোনো শ্রেণিই অন্য কোনো শ্রেণির চাইতে অগ্রসর নয়। দৈনন্দিন সংগ্রামের কারণে কারও চিন্তা করার অবকাশ কম বা কারও বেশি। কিন্তু সব মানুষই প্রকৃতপক্ষে সৃজনশীল। সুযোগ পেলে তার বিকাশ ঘটে ও সামনে এগিয়ে নিয়ে যায়। তাই অন্যান্য গোষ্ঠী থেকে আলাদা করে প্রান্তিক জনগণের উন্নয়ন কখনো অন্যের ‘অবজেক্ট’ হতে পারে না, তারা নিজেই তাদের জীবনের, কর্মের অধীশ্বর। পারস্পরিক সম্পর্ক তাই ‘সাবজেক্ট-সাবজেক্ট’।

এভাবে সাধারণ মানুষকে, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে যথাযথ সম্মান দেওয়া এবং তারা যে নিজস্ব সমস্যা সমাধানের জন্য চিন্তা ও কাজ করার ক্ষমতা রাখে এই বোধকে সামনে তুলে ধরার ক্ষেত্রে আনিসুর রহমান স্যার প্রাগ্রসর ভূমিকা রেখে গেছেন। প্রায় পঁচিশ বছর ধরে আরআইবির প্রতিটি গবেষণায়, তিনি আমাদের বলেছেন, জনগণকে আত্মশক্তিতে সচেতন করে তুলতে হবে, যাতে আরআইবির ওপর তাদের নির্ভরশীলতা তৈরি না হয়।

আরআইবি গবেষণা এলাকা থেকে সরে এলে কীভাবে তারা নিজেকে টিকিয়ে রেখে বিদ্যমান কর্মকাণ্ড চালিয়ে নিতে পারবে, সেই বিষয়ে তাদের সচেতন করার জন্য তিনি দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। তাঁর এই নির্দেশনা সব সময়ই আরআইবির কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের সতর্ক করে রেখেছে, ভবিষ্যতেও রাখবে।

এখানেই আনিস স্যারের ব্যতিক্রমী চিন্তাচেতনা আমাদের মনোজগৎকে প্রভাবিত করেছে। জনগণকে প্রাধান্য দিয়ে চিন্তার জগৎ বা গবেষণার ফোকাস করা শিখিয়েছেন তিনি আমাদের।

আরআইবির শুরুতে গবেষণাকাজের ফোকাস হিসেবে ‘প্রান্তিক জনগোষ্ঠী’ নির্ধারণে অধ্যাপক আনিসুর রহমানের ভূমিকা ছিল অন্যতম। সেই সময় তিনি আরআইবি চেয়ারম্যান ড. শামসুল বারি, পরিচালনা পর্ষদ সদস্য ড. হামিদা হোসেন, নির্বাহী পরিচালক ড. মেঘনা গুহঠাকুরতাসহ অন্যদের সঙ্গে ঢাকার বাইরের জেলাগুলোয় নিরন্তর ভ্রমণ করতেন এবং বিভিন্ন প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সদস্যদের সঙ্গে বসে তাদের সমস্যা জানা এবং কীভাবে তারা তাদের সমস্যাকে মূল্যায়ন করে সমাধানের অন্বেষণ করে তা অধ্যয়ন করতেন।

এভাবেই বাংলাদেশের আনাচকানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ৪০টির বেশি জনগোষ্ঠী আমাদের জ্ঞানকাণ্ডে, গবেষণার জগতে উল্লিখিত হয়। এসব অপ্রচলিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে নাগারচি, শব্দকর, কাওরা, মুচি, কৈবর্ত, মাহাতো, সন্ন্যাসী, চৌধালী, বেহারা জনগোষ্ঠী অন্যতম। এসব জনগোষ্ঠীর আত্ম-উন্নয়নও অধিকার রক্ষায় আরআইবি ধারাবাহিকভাবে কাজ করে আসছে। আগে যাযাবর বেদে জনগোষ্ঠীর ভোটাধিকার ছিল না। কারণ, তাদের কোনো স্থায়ী আবাস ছিল না। তাদের ভোটাধিকার ইস্যু নিয়ে নীতিনির্ধারক পর্যায়ে রিইবের ক্রমাগত চেষ্টার ফলে বর্তমানে তারা ভোটের অধিকার লাভ করতে সক্ষম হয়। এ রকম আরও সফলতার অন্যতম নেপথ্য রূপকার ছিলেন আনিস স্যার।

অধ্যাপক আনিসুর রহমানের জীবন-দর্শন ছিল জনগণকেই তাদের যাবতীয় উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার দেওয়া। তাদের আত্মশক্তিতে বলীয়ান করে, তাদের হাত ধরে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে সহায়তা করা। তিনি ছিলেন রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী ও রবীন্দ্র-অনুরাগী। রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবন-দর্শনে গভীরভাবে রেখাপাত করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে আত্মশক্তির যে চর্চা করেছিলেন এবং সে বিষয়ে তাঁর যাবতীয় লেখা থেকে আনিস স্যার উদ্ধৃতি ব্যবহার করেছেন তাঁর বিভিন্ন লেখায়। জনগণের প্রতি এই যে দায়বদ্ধতার এই প্রকাশ আমরা দেখি তাঁর রচিত—যে আগুন জ্বলেছিল, পথে যা পেয়েছি—বইয়ের প্রতি পাতায়।

জনগণের সামষ্টিক শক্তি যে একটা বড় শক্তি এবং তা যে সমাজ রূপান্তরের কাজে বড় ভূমিকা রাখতে পারে, তা আনিস স্যার আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন তাঁর লেখা পার্টিসিপেটরি অ্যাকশন রিসার্চ: জীবনের পাঠশালা থেকে শিক্ষা বইটিতে। মানুষকে সঠিক পথে চলার পথে অ্যানিমেটর বা উজ্জীবকের ভূমিকা অনস্বীকার্য। এর প্রতিফলন আমরা আরআইবির পক্ষ থেকে দেখেছি আনিস স্যারের নিজের মধ্যেই।

আরআইবির গবেষকদের তিনি সরাসরি পথনির্দেশক ছিলেন না, তিনি বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরতেন, যাতে অন্যদের সিদ্ধান্ত নিতে এবং নেটওয়ার্ক সৃষ্টি করতে সহজ হয়। এসব কাজ স্যার অগোচরেই করে গেছেন। আরআইবির গবেষণা ও প্রকাশনার মাধ্যমে সুবিধাবঞ্চিত মানুষের সৃজনশীল সফল উদ্যোগগুলোর কথা প্রচার ও প্রসারের কাজে নিরন্তর সহযোগী হয়ে দেশজুড়ে এক শর কাছাকাছি সাংবাদিককে অনুপ্রাণিত ও শাণিত করেছিলেন তিনি।

আরআইবিকে নিজস্ব স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে দেশের অন্যতম গবেষণাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে এভাবেই অবদান রেখে গেছেন অধ্যাপক আনিসুর রহমান। আরআইবি পরিবার থেকে আমরা তাঁকে গভীর কৃতজ্ঞতায় শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি।

সুরাইয়া বেগম পরিচালক, রিসার্চ ইনিশিয়েটিভস, বাংলাদেশ (আরআইবি)

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

নতুন দলকে নতুন যে রাজনীতি দিতে হবে

জনগণের শক্তিকে ভয় পাওয়া অশুভ শক্তি নিজেদের অপকর্ম এবং অন্যায় অবস্থানের জন্য অপরাধবোধ প্রকাশের সৎ সাহস রাখে না। তারাই ইদানীং সমাজের চোরাগলিতে বলাবলি করছে, ক্ষমতার পরিবর্তনের পর গত ছয় মাসে দেশের অবস্থা কী যে হয়ে গেল!

আজকের অর্থনৈতিক দৈন্যদশা, প্রতিষ্ঠানগুলোর ভগ্নদশা, রাজনৈতিক অবসাদ এবং সামাজিক অবক্ষয় যে পতিত সরকারের সৃষ্ট এবং রেখে যাওয়া, তা স্বীকার করা দূরে থাক, বিবেকহীনরা তা বুঝতে নারাজ।

যেন হত্যাকাণ্ড, মেগা দুর্নীতি, বৈষম্য বৃদ্ধি, রাষ্ট্রীয় স্বার্থ জলাঞ্জলি বা মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণের মতো ঘটনা ঘটেইনি বিগত আমলে! অজ্ঞাত স্থান থেকে কুকর্মকারীদের প্রতিশোধ ও নাশকতার ভার্চ্যুয়াল হুমকি বলে দেয় ক্ষমতার রাজনীতিতে কতটা ভয়ংকর এই ফ্যাসিবাদী শক্তি।

তবু ‘অন্ধকার যুগ বনাম নতুন সম্ভাবনার অনিশ্চিত সময়’ নিয়ে কোনো বিতর্কে আওয়ামী চেতনার ধ্বজাধারীদের যুক্তি অকাট্য হলে তা এত ইনিয়ে-বিনিয়ে বলার চেষ্টা কেন বন্ধুরা?

কারণ, ওটাই পুরোনো রাজনীতির নমুনা: নিজের মিথ্যা আড়াল করো এবং আরেকজনের সত্যকে অস্বীকার করতে থাকো; ফলে মানুষকে বিভ্রান্ত করে স্বীয় স্বার্থ উদ্ধার করা সহজ হবে, প্রতিপক্ষও ভিলেন বনে যাবে। কী সহজ সমীকরণ নির্ণয় করে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ! বিএনপি-জামায়াতকে গালাগাল দাও, ক্ষমতায় টেকার নাটক সাজাও।

তিন তিনটি জোচ্চুরির জাতীয় নির্বাচন সম্পন্ন করার পর ২০২৪-এর ১০ জানুয়ারি ঢাকার এক সমাবেশে জবরদখলকারী প্রধানমন্ত্রী হাসিনা বলেছিলেন, ‘আমরা জনগণের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছি। জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোটে অংশ নিয়েছে।

বিএনপির জ্বালাও-পোড়াওয়ের মাঝেও তারা নিজের ভোট নিজে দিয়েছে।’ তাঁর নির্লজ্জ মিথ্যার রাজনীতি ও রাজত্ব শেষ হয় সংক্ষুব্ধ জনতার চূড়ান্ত প্রতিরোধে। ৫ আগস্টের ক্ষমতার পরিবর্তন শুধু এক দিনের ঘটনা নয়, সেটি ছিল নতুন রাজনীতির সূচনালগ্ন।
হাসিনার বিদায়ের অন্যতম সুফল হলো অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি এবং সংস্কারের মাধ্যমে তার উপযোগী পরিবেশ তৈরির তাগিদ।

ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের সুযোগ অবশ্যই আরেকটি ধাপ। এসব বিষয়ে আমরা যে নানা তর্ক-বিতর্ক করছি, সেটি পর্যন্ত অসম্ভব ছিল ফ্যাসিবাদী যুগে। সুতরাং ‘ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত’। ওই কবিতার মতোই বাংলাদেশ এখন নতুন যুগের সন্ধিক্ষণে, তা সবাই দেখুক না দেখুক। ‘আলোর চোখে কালো ঠুলি পরিয়ে/ তারপর খুলে-/ মৃত্যুর কোলে মানুষকে শুইয়ে দিয়ে/ তারপর তুলে-/ যে দিনগুলো রাস্তা দিয়ে চলে গেছে/ যেন না ফেরে।’

যাহোক আমরা যদি ইচ্ছাশক্তি ও যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারি, তাহলে নতুন রাজনীতি সমাজ ও জাতিকে আগামীর পথ দেখাবে, রাজনীতিকেরা সেই যাত্রায় নেতৃত্ব দেবেন। এর অন্যথা জনগণের কাছে খুব একটা গ্রহণযোগ্য হবে না।

কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় চাননি পুরোনোয় ফিরে যেতে। আমরা ২০২৪-এর আগস্ট-পূর্ববর্তী আমলের রাজনৈতিক ধারায় ফেরার ওকালতি করব কোন মুখে? যে রাজনীতি ছিল মিথ্যুকের বন্দনা, দুর্নীতিবাজের আরাধনা, অন্যায়কারীকে প্রশ্রয় দান, ভণ্ডের অশ্রুবিসর্জনের সার্কাস প্রদর্শন, গণশত্রুর শাসন নির্বিঘ্ন এবং চিরস্থায়ী করার অপচেষ্টা, নিষ্ঠুরের জয়গান গাওয়া আর শোনা, বর্বরের কাছে আত্মসমর্পণের আহ্বান; সে রাজনীতিতে আমরা কেন ফিরব?

আসলে এই শতাব্দীর শুরুতে একশ্রেণির রাজনীতিকদের নীতিহীন কর্মকাণ্ড ও বিরাজনীতিকীকরণে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র এবং পরবর্তী সময়ে ফ্যাসিবাদী শাসনের মধ্যেই চালাকি, বজ্জাতি আর ভয় দেখানোর রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে মানুষ ভেতরে-ভেতরে প্রত্যাখ্যান করে পুরোনো রাজনীতি অচল হয়ে পড়েছিল অনেক আগেই।

কিছুটা বুঝে, কিছুটা না বুঝে বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা ঝোড়ো হাওয়ার মতো বিপ্লব ঘটায়, রক্তের অক্ষরে লিখে তুলে ধরে নতুন রাজনীতির আকাঙ্ক্ষা। তারপরও সেকেলে মানসিকতার রাজনীতিকদের অপ্রাসঙ্গিকতা আরও পরিষ্কার হয় অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের জমানায়। কী বয়ান নিয়ে রাজনীতি করবেন যেখানে দলীয় সরকার নেই, নেই রাজনৈতিক মাঠের সংজ্ঞায়িত শত্রু? তাই কিছু আওয়ামী প্রলাপ এখনো প্রতিধ্বনিত হয় এখানে-সেখানে।

সে ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত নতুন রাজনীতির ধারণাটা কী হতে পারে? ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে মানুষের সমমর্যাদা, সম্ভাবনার বিকাশ, সত্য, শান্তি, সৌহার্দ্য, ন্যায়নিষ্ঠতা, নিয়মকানুন বা সভ্য মূল্যবোধ অনুসরণের জন্য কাজ করবে যে রাজনীতি, তা-ই হয়তো আজকের প্রজন্মের প্রত্যাশা।

২৮ ফেব্রুয়ারি জাতীয় নাগরিক পার্টি নামে যে দলটির আত্মপ্রকাশ ঘটল জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের ছাত্র নেতৃত্বের হাত ধরে, তার চ্যালেঞ্জ হবে জনগণকে বিকল্প রাজনীতির মডেল উপহার দেওয়া। পরিবর্তিত সংস্কৃতির দলটি প্রতিক্রিয়ার রাজনীতি করবে না, কাজ করবে দেশ ও জনগণের চলমান ও ভবিষ্যৎমুখী নানা ইস্যু নিয়ে। সে দলের সব কর্মকাণ্ড হবে স্বচ্ছ এবং নেতৃত্ব সর্বদা অনুসরণ করবে গণতান্ত্রিক পথ। এই আমাদের প্রত্যাশা।

এই দলকে আমরা সেই জায়গায় দেখতে চাই না, যে দল নতুন রাজনীতির ‘সোল এজেন্ট’ হিসেবে নিজেকে দাবি করে বসবে না বরং রাজনৈতিক বিতর্কে ন্যায্য দাবি বা যুক্তি মেনে নিতে নমনীয়তা দেখাবে।

অন্যদিকে আমাদের সেই রাজনৈতিক ঐকমত্যে পৌঁছা দরকার, যেখানে যে বা যারা বারবার গণতান্ত্রিক রীতিনীতি ও ভোটাধিকার প্রয়োগ বাধাগ্রস্ত করেছে এবং জাতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেই দলের নাম যা-ই হোক, তার ভাবী গণতন্ত্রে রাজনীতি করার অধিকার থাকবে না।

বিগত গণতান্ত্রিক সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা রাখা বিএনপি, জামায়াতসহ অন্য দলেরও নতুন রাজনীতি নিয়ে কথা বলা এবং জাতীয় সমঝোতার উদ্যোগ নেওয়ার সুযোগ না থাকার কারণ নেই। ভোটাধিকার প্রয়োগ ছাড়াও আধুনিক মানুষ পরিবার, প্রজন্ম, প্রতিবেশ, পরিবেশ, শিক্ষা, চিকিৎসা, চাকরি, ব্যবসা, নিরাপত্তা, গোপনীয়তা, নৈতিকতা, জনকল্যাণের সামাজিক বন্দোবস্ত ইত্যাদি অনেক বিষয়ে চিন্তিত। প্রতিপক্ষকে আক্রমণ ও বাগাড়ম্বর বাদ দিলেও রাজনীতিকদের ইস্যুর কোনো অভাব হওয়ার কথা নয়।

দেশবাসী আশা করে, রাজনীতি হবে তাদের কল্যাণে এবং রাজনীতিকেরা জনগণের সমস্যা ও মনের ভাব দ্রুতই বুঝতে পারবেন। দুঃখজনকভাবে সাম্প্রতিক বাংলাদেশে এমনটা ছিল না।

যাহোক আমরা যদি ইচ্ছাশক্তি ও যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারি, তাহলে নতুন রাজনীতি সমাজ ও জাতিকে আগামীর পথ দেখাবে, রাজনীতিকেরা সেই যাত্রায় নেতৃত্ব দেবেন। এর অন্যথা জনগণের কাছে খুব একটা গ্রহণযোগ্য হবে না।

খাজা মাঈন উদ্দিন সাংবাদিক।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • বাংলাদেশের সংস্কার কর্মসূচিকে সমর্থন করে ইইউ: হাদজা লাহবিব
  • যুক্তরাষ্ট্রের নীতিতে ‘মৌলিক পরিবর্তন নিয়ে’ উদ্বিগ্ন জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান
  • আপনারা সীমাবদ্ধ সুশীল, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নাক গলানো পছন্দ নয়
  • বাংলাদেশ নিয়ে অমর্ত্য সেনের বক্তব্য নিয়ে যা বলছেন জামায়াতের আমির
  • অভ্যুত্থানের মর্ম ধারণ করতে ব্যর্থ সরকার
  • অভ্যুত্থানের মর্ম ধারণ করতে ব্যর্থ সরকার: আনু মুহাম্মদ
  • স্বৈরাচারী শাসনামলের নৃশংসতা নথিভুক্তির ওপর গুরুত্বারোপ প্রধান উপদেষ্টার
  • রবীন্দ্রনাথ-নজরুল কেউই ইউপি চেয়ারম্যান হওয়ার যোগ্যতা রাখেন না!
  • নতুন দলকে নতুন যে রাজনীতি দিতে হবে
  • হোয়াইট হাউস থেকে বেরিয়ে এক পোস্টে চারবার ‘ধন্যবাদ’ দিলেন জেলেনস্কি