আরআইবি পরিচালনা পর্ষদের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য অধ্যাপক আনিসুর রহমানকে স্মরণ
Published: 13th, January 2025 GMT
অধ্যাপক আনিসুর রহমান, বাংলাদেশ তথা বিশ্বের একজন প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ও উন্নয়নবিশেষজ্ঞ এবং একই সঙ্গে একজন রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী ও আরও নানা অভিধায় পরিচিত এক মহান ব্যক্তিত্ব। তবে আমরা এ লেখায় আজ তাঁকে একান্তভাবে স্মরণ করেছি রিসার্চ ইনিশিয়েটিভস, বাংলাদেশের (আরআইবি) একজন স্বপ্নদ্রষ্টা, পথনির্দেশক এবং পরিচালনা পর্ষদের একজন বিশিষ্ট সদস্য হিসেবে তাঁর ভূমিকা নিয়ে।
অধ্যাপক আনিসুর রহমান ৫ জানুয়ারি প্রয়াত হয়েছেন। তাঁর স্মরণে আরআইবি অফিসে চেয়ারম্যান ড.
আরআইবি প্রতিষ্ঠিত হয় ২০০২ সালে সাতজন বোর্ড সদস্য নিয়ে। তার মধ্যে অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য অধ্যাপক আনিসুর রহমান। নেদারল্যান্ডস সরকারের দীর্ঘমেয়াদি আর্থিক সহায়তায় শুরুতে আরআইবির কার্যক্রম ছিল প্রধানত দুই ধরনের। এক. দারিদ্র্য বিমোচন গবেষণার কাজে বিভিন্ন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়া। দুই. জনগণের চাহিদাভিত্তিক ও অংশগ্রহণমূলক গবেষণার জন্য নতুন গবেষক সৃষ্টিতে সহায়তা করা।
দারিদ্র্য বিমোচনসংক্রান্ত গবেষণায় আরআইবি দারিদ্র্যকে সামগ্রিকভাবে ও মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করে নতুন ধারা সৃষ্টির উদ্যোগ নেয়। দারিদ্র্যের মানবিকীকরণ দৃষ্টিভঙ্গি তৈরির ক্ষেত্রে অধ্যাপক আনিসুর রহমান গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। তাঁর মতাদর্শ অনুসরণ করে আরআইবি মনে করে, দরিদ্র জনগণের চাহিদা শুধু অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-স্বাস্থ্য-শিক্ষার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এর বাইরেও সুবিচার, সাম্য, বৈষম্য দূরীকরণ, সুশাসন, মানবাধিকার, সংস্কৃতি, জ্ঞানতৃষ্ণা পূরণসহ সর্বোপরি সৃজনশীলতা ও সৌন্দর্য বিকাশের সুযোগ সৃষ্টির চাহিদা রয়েছে। দারিদ্র্যকে সার্বিকভাবে অনুধাবন করার এই যে অনন্য দৃষ্টিভঙ্গি, তা একান্তই আনিস স্যারের মানসজাত।
আরআইবি গবেষণাকে শুধু টেকনিক্যাল প্রশ্নে সীমাবদ্ধ রাখেননি। এর লক্ষ্য, অভীষ্ট জনগোষ্ঠীর জীবনের উন্নয়ন তথা জনগণের আত্ম-উন্নয়ন। সারা দেশে তৃণমূল পর্যায়ে অনেক সুবিধাবঞ্চিত ও অধিকারবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর নিজেদের প্রচেষ্টায় স্বাবলম্বী হওয়ার অনেক দৃষ্টান্ত আছে, যাকে উন্নয়নের পরিসরে সামনে নিয়ে আসা প্রয়োজন। এ বিষয়ে আনিস স্যার সব সময় জনগণের আত্মশক্তির কথা সামনে তুলে ধরেছেন। জনগণকে ‘দরিদ্র’অভিধায় অভিহিত করার যে প্রয়াস এই শতকের গোড়ার দিকের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে দেখা যেত, তার প্রচণ্ড রকম বিরোধিতা করেছেন তিনি। দরিদ্রজনের অর্থনৈতিক দারিদ্র্যকে অস্বীকার না করে, বরং তাদের অফুরন্ত সম্ভাবনা ও সৃজনশীলতার প্রতি হাত বাড়িয়ে দিয়ে তাদের সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পথে কাজ করেছেন তিনি। তিনি ‘দরিদ্র’ না বলে ‘সুবিধাবঞ্চিত’ও ‘অধিকারবঞ্চিত’—এই টার্মগুলো ব্যবহার করতে আমাদের উদ্বুদ্ধ করেছেন। আরআইবি সেই ধারাবাহিকতা এখনো বজায় রেখেছে।
পার্টিসিপেটরি অ্যাকশন রিসার্চ (পিএআর) বা গণগবেষণাতত্ত্বকে বাংলাদেশে পরিচিত করেছেন অধ্যাপক আনিসুর রহমান। এই তত্ত্বকে আরআইবি তার সব গবেষণার কাজে প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন করে এগিয়ে যাচ্ছে আগামীর দিকে। প্রথম দিকে এই তত্ত্বকে বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষা কর্মসূচিতে সামাজিক বিজ্ঞানের মানদণ্ডের পরিসরে মেনে নিতে অনীহা ছিল। কিন্তু আরআইবির বাস্তবায়ন ও জনমনে এর গ্রহণযোগ্যতা এবং সেই সঙ্গে আরও কিছু বেসরকারি সংগঠনের কর্মসূচিতে এর অন্তর্ভুক্তি গণগবেষণাতত্ত্বের গ্রহণযোগ্যতাকে দৃঢ় করেছে।
গণগবেষণার একটি মৌলিক ধারণা হলো চিন্তাশক্তি বা জ্ঞানের দিক দিয়ে কোনো শ্রেণিই অন্য কোনো শ্রেণির চাইতে অগ্রসর নয়। দৈনন্দিন সংগ্রামের কারণে কারও চিন্তা করার অবকাশ কম বা কারও বেশি। কিন্তু সব মানুষই প্রকৃতপক্ষে সৃজনশীল। সুযোগ পেলে তার বিকাশ ঘটে ও সামনে এগিয়ে নিয়ে যায়। তাই অন্যান্য গোষ্ঠী থেকে আলাদা করে প্রান্তিক জনগণের উন্নয়ন কখনো অন্যের ‘অবজেক্ট’ হতে পারে না, তারা নিজেই তাদের জীবনের, কর্মের অধীশ্বর। পারস্পরিক সম্পর্ক তাই ‘সাবজেক্ট-সাবজেক্ট’।
এভাবে সাধারণ মানুষকে, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে যথাযথ সম্মান দেওয়া এবং তারা যে নিজস্ব সমস্যা সমাধানের জন্য চিন্তা ও কাজ করার ক্ষমতা রাখে এই বোধকে সামনে তুলে ধরার ক্ষেত্রে আনিসুর রহমান স্যার প্রাগ্রসর ভূমিকা রেখে গেছেন। প্রায় পঁচিশ বছর ধরে আরআইবির প্রতিটি গবেষণায়, তিনি আমাদের বলেছেন, জনগণকে আত্মশক্তিতে সচেতন করে তুলতে হবে, যাতে আরআইবির ওপর তাদের নির্ভরশীলতা তৈরি না হয়।
আরআইবি গবেষণা এলাকা থেকে সরে এলে কীভাবে তারা নিজেকে টিকিয়ে রেখে বিদ্যমান কর্মকাণ্ড চালিয়ে নিতে পারবে, সেই বিষয়ে তাদের সচেতন করার জন্য তিনি দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। তাঁর এই নির্দেশনা সব সময়ই আরআইবির কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের সতর্ক করে রেখেছে, ভবিষ্যতেও রাখবে।
এখানেই আনিস স্যারের ব্যতিক্রমী চিন্তাচেতনা আমাদের মনোজগৎকে প্রভাবিত করেছে। জনগণকে প্রাধান্য দিয়ে চিন্তার জগৎ বা গবেষণার ফোকাস করা শিখিয়েছেন তিনি আমাদের।
আরআইবির শুরুতে গবেষণাকাজের ফোকাস হিসেবে ‘প্রান্তিক জনগোষ্ঠী’ নির্ধারণে অধ্যাপক আনিসুর রহমানের ভূমিকা ছিল অন্যতম। সেই সময় তিনি আরআইবি চেয়ারম্যান ড. শামসুল বারি, পরিচালনা পর্ষদ সদস্য ড. হামিদা হোসেন, নির্বাহী পরিচালক ড. মেঘনা গুহঠাকুরতাসহ অন্যদের সঙ্গে ঢাকার বাইরের জেলাগুলোয় নিরন্তর ভ্রমণ করতেন এবং বিভিন্ন প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সদস্যদের সঙ্গে বসে তাদের সমস্যা জানা এবং কীভাবে তারা তাদের সমস্যাকে মূল্যায়ন করে সমাধানের অন্বেষণ করে তা অধ্যয়ন করতেন।
এভাবেই বাংলাদেশের আনাচকানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ৪০টির বেশি জনগোষ্ঠী আমাদের জ্ঞানকাণ্ডে, গবেষণার জগতে উল্লিখিত হয়। এসব অপ্রচলিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে নাগারচি, শব্দকর, কাওরা, মুচি, কৈবর্ত, মাহাতো, সন্ন্যাসী, চৌধালী, বেহারা জনগোষ্ঠী অন্যতম। এসব জনগোষ্ঠীর আত্ম-উন্নয়নও অধিকার রক্ষায় আরআইবি ধারাবাহিকভাবে কাজ করে আসছে। আগে যাযাবর বেদে জনগোষ্ঠীর ভোটাধিকার ছিল না। কারণ, তাদের কোনো স্থায়ী আবাস ছিল না। তাদের ভোটাধিকার ইস্যু নিয়ে নীতিনির্ধারক পর্যায়ে রিইবের ক্রমাগত চেষ্টার ফলে বর্তমানে তারা ভোটের অধিকার লাভ করতে সক্ষম হয়। এ রকম আরও সফলতার অন্যতম নেপথ্য রূপকার ছিলেন আনিস স্যার।
অধ্যাপক আনিসুর রহমানের জীবন-দর্শন ছিল জনগণকেই তাদের যাবতীয় উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার দেওয়া। তাদের আত্মশক্তিতে বলীয়ান করে, তাদের হাত ধরে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে সহায়তা করা। তিনি ছিলেন রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী ও রবীন্দ্র-অনুরাগী। রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবন-দর্শনে গভীরভাবে রেখাপাত করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে আত্মশক্তির যে চর্চা করেছিলেন এবং সে বিষয়ে তাঁর যাবতীয় লেখা থেকে আনিস স্যার উদ্ধৃতি ব্যবহার করেছেন তাঁর বিভিন্ন লেখায়। জনগণের প্রতি এই যে দায়বদ্ধতার এই প্রকাশ আমরা দেখি তাঁর রচিত—যে আগুন জ্বলেছিল, পথে যা পেয়েছি—বইয়ের প্রতি পাতায়।
জনগণের সামষ্টিক শক্তি যে একটা বড় শক্তি এবং তা যে সমাজ রূপান্তরের কাজে বড় ভূমিকা রাখতে পারে, তা আনিস স্যার আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন তাঁর লেখা পার্টিসিপেটরি অ্যাকশন রিসার্চ: জীবনের পাঠশালা থেকে শিক্ষা বইটিতে। মানুষকে সঠিক পথে চলার পথে অ্যানিমেটর বা উজ্জীবকের ভূমিকা অনস্বীকার্য। এর প্রতিফলন আমরা আরআইবির পক্ষ থেকে দেখেছি আনিস স্যারের নিজের মধ্যেই।
আরআইবির গবেষকদের তিনি সরাসরি পথনির্দেশক ছিলেন না, তিনি বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরতেন, যাতে অন্যদের সিদ্ধান্ত নিতে এবং নেটওয়ার্ক সৃষ্টি করতে সহজ হয়। এসব কাজ স্যার অগোচরেই করে গেছেন। আরআইবির গবেষণা ও প্রকাশনার মাধ্যমে সুবিধাবঞ্চিত মানুষের সৃজনশীল সফল উদ্যোগগুলোর কথা প্রচার ও প্রসারের কাজে নিরন্তর সহযোগী হয়ে দেশজুড়ে এক শর কাছাকাছি সাংবাদিককে অনুপ্রাণিত ও শাণিত করেছিলেন তিনি।
আরআইবিকে নিজস্ব স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে দেশের অন্যতম গবেষণাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে এভাবেই অবদান রেখে গেছেন অধ্যাপক আনিসুর রহমান। আরআইবি পরিবার থেকে আমরা তাঁকে গভীর কৃতজ্ঞতায় শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি।
সুরাইয়া বেগম পরিচালক, রিসার্চ ইনিশিয়েটিভস, বাংলাদেশ (আরআইবি)
উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
বৈষম্যবিরোধীদের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অবস্থান অগ্রহণযোগ্য
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট যে গণঅভ্যুত্থান হয়, তা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আন্দোলন-সংগ্রামের ধারাবাহিকতার ফসল, সন্দেহ নেই। আন্দোলনটি জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহের আগে নেহাতই সরকারি চাকরিতে কোটা প্রথা অবসানের দাবিতে সীমাবদ্ধ ছিল, যদিও ১৪ জুলাই দেওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘রাজাকারের নাতি-পুতি’ বক্তব্যটি আন্দোলনে ঘৃতাহুতি দিয়েছিল। জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে কয়েকজন সমন্বয়ককে ডিবি হারুনের অফিসে ধরে নিয়ে গিয়ে ‘মিডিয়া-ডিনার’ খাওয়ানোর দৃশ্য এবং সমন্বয়কদের একজনকে দিয়ে লুঙ্গি পরিহিত অবস্থায় আন্দোলন সমাপ্ত করার ঘোষণা দিতে বাধ্য করা জনগণের ক্রোধকে দ্রুত ঘনীভূত করে। অন্যদিকে আন্দোলন মোকাবিলার জন্য পুলিশ বাহিনীর পাশাপাশি ছাত্রলীগ ও যুবলীগের মাস্তান বাহিনীকে লেলিয়ে দেন শেখ হাসিনা ও ওবায়দুল কাদের, যার ফলে সারাদেশে এক দিনেই শতাধিক আন্দোলনকারীর প্রাণহানি ঘটে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সারাদেশে কারফিউ জারি করে তা বলবৎ করার জন্য সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন করা হয়। কিন্তু কারফিউ প্রায় ১০ দিন চলার পর সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান ৩ আগস্ট দুপুরে সামরিক বাহিনীর ঢাকায় অবস্থিত সব অফিসারের সভা (দরবার) ডাকেন। সভায় প্রধানত জুনিয়র অফিসাররা মতামত ঘোষণা করেন– সেনাবাহিনী জনগণের বিপক্ষে গুলি চালাবে না। সেনাপ্রধান তাদের মত মেনে নেন। সেনাবাহিনীর এই সিদ্ধান্ত জানাজানি হওয়ার পর ৩ আগস্ট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের বিশাল সমাবেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা সরকারের পদত্যাগ চেয়ে এক দফা দাবি ঘোষণা করেন। তাদের ঘোষিত ৬ আগস্টের ‘লং মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিকে এক দিন এগিয়ে ৫ আগস্ট নির্ধারণ করা হয়। একই সঙ্গে ৪ আগস্ট আবারও ছাত্রলীগ-যুবলীগ-পুলিশের যৌথ বাহিনীকে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেন শেখ হাসিনা। ওই দিনও শতাধিক মানুষ মৃত্যুবরণ করেন। ওই দিন দেশের প্রায় ৪০০ থানায় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ হয়। উপরন্তু, সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থানায় আক্রমণ চালিয়ে ১৩ জন ও নরসিংদীতে ৬ জন পুলিশকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে পুলিশ সাহস হারিয়ে রণে ভঙ্গ দিয়ে থানা থেকে পালিয়ে যায়। সাধারণ মানুষ বুঝে যায়, শেখ হাসিনার পতন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
এ প্রেক্ষাপট তুলে ধরার কারণ এটা বলা, গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী লাখ লাখ মানুষের একটাই উদ্দেশ্য ছিল, শেখ হাসিনাকে উৎখাত। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে কারা রয়েছে– সেটা তাদের কাছে বিবেচ্য ছিল না। শেখ হাসিনার স্থানে কে ক্ষমতায় আসবে– সেটাও তাদের ভাবনায় ছিল না। কিন্তু গণঅভ্যুত্থানের সাড়ে পাঁচ মাস অতিবাহিত হওয়ার পর জনগণের সিংহভাগ বুঝতে পারছে– বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রভাবশালী সমন্বয়কদের বড় অংশ একটি বিশেষ মতের। আন্দোলনের সময় তারা তাদের পরিচয় সযত্নে লুকিয়ে রেখেছিলেন। তাদের অনেকেই ছদ্মবেশে ছাত্রলীগের রাজনৈতিক পরিচয় পর্যন্ত ধারণ করেছিলেন। এখন শীর্ষ সমন্বয়করাই বলে বেড়াচ্ছেন, আন্দোলনের ভ্যানগার্ড ছিল ইসলামী ছাত্রশিবির, যদিও লাখ লাখ জনতার মিছিল সংঘটিত করার পেছনে ছাত্রশিবিরের কোনো দলীয় তৎপরতার চিহ্নই ছিল না।
এখন পরিষ্কার হয়ে গেছে– সরকারে অন্তর্ভুক্ত ছাত্রনেতারাসহ অন্যান্য নেতৃস্থানীয় সমন্বয়ক, যারা বিভিন্ন বিতর্কিত বক্তব্যের কারণে ইতোমধ্যে জনপরিসরে ব্যাপক সমালোচনার সম্মুখীন; তারা সবাই মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শিবিরের লোক। এই ব্যাপারটি এখন জাতির সামনে একটি মহাবিপদ হিসেবে হাজির হয়েছে। কারণ তারা জাতির প্রধান ঐতিহাসিক অর্জন ও আদর্শ ‘মুক্তিযুদ্ধ’কে মুছে ফেলতে বদ্ধপরিকর বলে মনে হচ্ছে। বিষয়টি সিংহভাগ সাধারণ মানুষের কাছে একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। ১৯৭১ সালে কারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল, তা কারও অজানা নয়। তারা গণহত্যাকারী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ‘অক্সিলিয়ারি ফোর্স’ হিসেবে ‘আলবদর’ ও ‘আলশামস’ গঠন করেছিল। এই আলবদর ও আলশামস বাহিনীর ক্যাডাররা পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর ঘাতকদের সশস্ত্র সহায়তাকারী, গোয়েন্দা বাহিনী ও পথপ্রদর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার পাশাপাশি নিজেরাও অত্যন্ত নৃশংস ঘাতকের ভূমিকা পালন করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের অন্তিম লগ্নে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে জেনারেল রাও ফরমান আলীর নীলনকশা অনুসারে এই আলবদর বাহিনীর ক্যাডাররাই দেশের বুদ্ধিজীবী হত্যায় মেতে উঠেছিল।
মুক্তিযুদ্ধ নিছক একটি গণঅভ্যুত্থান ছিল না। ছিল এক জনযুদ্ধ, যেখানে ধনী-গরিব-মধ্যবিত্ত সব অংশের প্রায় সব সদস্য প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে যুক্ত ছিল। এ কথা সত্য, মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছে দুই বা আড়াই লাখ মানুষ। কিন্তু ভারতের মাটিতে গড়ে ওঠা শরণার্থী শিবিরের এক কোটিরও বেশি মানুষ বলতে গেলে সরাসরি এর সঙ্গে যুক্ত ছিল। দেশের ভেতরে কত লাখ পরিবার যে মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সহায়তা করেছে, তার কোনো হিসাব নেই। সর্বোপরি এ যুদ্ধের প্রস্তুতি চলেছে পাকিস্তানি শাসনের প্রায় ২৩ বছর ধরে। ফলে এর স্মৃতি, আবেগ ও চেতনা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বয়ে চলবে।
মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি যদি মনে করে, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের নিয়ন্ত্রণকারী সমন্বয়কদের মদদ পেলেই তারা জনগণকে ধোঁকা দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা স্বীয় কবজায় রাখতে পারবে– তাহলে তারা বোকার স্বর্গে বাস করছে। আমরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদেরও বলতে চাই, তাদের এই বিশেষ মহলকে তোষণ এবং মুক্তিযুদ্ধবিরোধী বক্তব্য ও অবস্থান দেশের সিংহভাগ জনগণ মোটেও পছন্দ করছে না।
অন্তর্বর্তী সরকার যে সংস্কার কমিশনগুলো গঠন করেছে, সেগুলোর প্রতিবেদনে যদি মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার কিংবা খাটো করার কোনো প্রয়াস দৃশ্যমান হয়, তাহলে তাদেরও জনরোষ মোকাবিলা করতে হবে। সম্প্রতি ছাত্রদের ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ নিয়ে বেশ হইচই হলো। বলা হচ্ছে, সব রাজনৈতিক দলের মত নিয়ে এই ঘোষণাপত্র সরকার দেবে। এই ঘোষণাপত্র আদৌ আলোর মুখ দেখবে কিনা, আমরা জানি না। তবে এতে যদি মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম অর্জন সংবিধানকে ‘ছুড়ে ফেলা’র মতো কোনো কোনো সমন্বয়কের দম্ভোক্তির প্রতিফলন ঘটে, তাহলে জনগণ এর উদ্যোক্তাদের শুধু রুখে দাঁড়াবে না, ছুড়েও ফেলতে পারে– আগেভাগেই এই সাবধানবাণী উচ্চারণ করছি।
অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম: একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ; সাবেক সভাপতি
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি