কালার রেভল্যুশন, রেভল্যুশন নাকি গণ-অভ্যুত্থান
Published: 13th, January 2025 GMT
আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি সমর্থন দুর্বল হওয়ার পেছনে বহিঃশক্তির ভূমিকা নগণ্য
গণ-অভ্যুত্থানের আগে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি রাজনৈতিক সমর্থন আসলে কতটুকু সরকারি সুবিধা হাসিলের জন্য আর কতটুকু প্রকৃত অর্থে আদর্শিক কারণে ছিল, তা নিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বিভিন্ন ধরনের তর্কে লিপ্ত থাকতে পারেন। তবে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, দুর্নীতি, অর্থনৈতিক বৈষম্য বৃদ্ধি ও উন্নয়নের নামে লুটপাট বহুদিন ধরেই সরকারের ওপর অনাস্থার কারণ হয়েছিল। হাসিনা ও তাঁর মন্ত্রীরা বহুদিন ধরেই কখনো জনগণকে হেয় করে, কখনো শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের হেয় করে, কখনো সাংবাদিকদের হেয় করে উসকানিমূলক বক্তৃতা দিতেন।
যেকোনো সমস্যার দায়ভার অন্যদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া, নিজেরা যেকোনোভাবে দায়মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করা—এগুলো বহুদিন ধরে মানুষের মধ্যে ক্ষোভের জন্ম দিয়েছিল। আবু সাঈদের বুকে গুলি করে এই সরকার আরও একবার প্রমাণ করেছিল যে সরকার জনগণের জানমালের নিরাপত্তা রক্ষার্থে নয়, বরং জনগণের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গেছে। এ অনুভূতি যদিও এর আগে ছিল, এ ঘটনা নতুন স্ফুলিঙ্গ তৈরি করে; যার প্রতিক্রিয়ায় ব্যাপকভাবে বিভিন্ন মহল থেকে সরকারের প্রতি রাজনৈতিক সমর্থন লোপ পেতে থাকে।
ছাত্র আন্দোলনের একটি সমষ্টিগত প্রভাব ধীরে ধীরে সাধারণ জনগণের মধ্যে সরকারের প্রতি রাজনৈতিক সমর্থনের অবসান ঘটায়। শুরুতে এই সমর্থন হ্রাসের লক্ষণগুলো স্পষ্ট না হলেও প্রথমে ছাত্রলীগ থেকে বিপুলসংখ্যক কর্মী-সদস্যের পদত্যাগ; দ্বিতীয়ত শিক্ষক, চিকিৎসক, শ্রমজীবী মানুষ ও আইনজীবীদের আন্দোলনের প্রতি সংহতি জনমনে প্রভাব সৃষ্টি করে। পরের দিকে আন্দোলনের প্রতি সশস্ত্র বাহিনীর সমর্থন শাসনব্যবস্থার মধ্যে বিভাজন তৈরি করে দিতে সমর্থ হয়।
সেনাবাহিনী হাসিনাকে সমর্থন না করে কেন অভ্যুত্থানকারীদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল?
আন্দোলনের ঘটনাক্রমের মধ্য দিয়ে নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর মধ্যে হাসিনা শাসনের পক্ষে-বিপক্ষে বড় ধরনের বিভাজন তৈরি হয়। প্রায় শেষ সময় পর্যন্ত শেখ হাসিনা কর্তৃক নিযুক্ত সেনাবাহিনীর শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা হাসিনার সমর্থনে কাজ চালিয়ে যান। তবে সেনাবাহিনীর জুনিয়র অফিসার ও সৈনিকদের মধ্যে অস্থিরতা তৈরি হয় এবং তাঁরা সাধারণ জনগণের দিকে গুলি করতে অনিচ্ছুক ছিলেন। তাঁরা হাসিনা সরকারকে সমর্থনকারী নিরাপত্তা বাহিনীর প্রতি সাধারণ মানুষের ক্রমবর্ধমান অসন্তোষের কথা উল্লেখ করে বিক্ষোভে অংশ নেওয়া সাধারণ মানুষের ওপর গুলি চালাতে অনীহার কথা জানিয়ে দেন।
৪ আগস্ট রাজধানীর রাওয়া ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলন করে সাবেক সেনাপ্রধানসহ সশস্ত্র বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা সশস্ত্র বাহিনীকে ছাত্র-জনতার মুখোমুখি না দাঁড়ানোর আহ্বান জানান। সামরিক কর্মকর্তা ও সৈন্যদের বেশির ভাগ আওয়ামী লীগ সরকারের দমন-পীড়নে অংশ না নেওয়ার অবস্থান নেন। এ সিদ্ধান্ত ব্যাপক জনসমর্থন পেয়েছিল। এ ধরনের পদক্ষেপ পূর্বপরিকল্পিত হওয়া সম্ভব ছিল না।
বিদ্যমান শাসনব্যবস্থাকে অবজ্ঞা করে ৩ আগস্ট ব্যাপক বিক্ষোভের পর শিক্ষার্থী সমন্বয়ক এবং আন্দোলনের অন্য নেতারা শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ এবং ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার জন্য এক দফা দাবি ঘোষণা করেন। অভ্যন্তরীণ বিতর্ক ও পরামর্শের ফলে সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব আন্দোলনের বিরোধিতা না করার সিদ্ধান্ত নেন। বলপ্রয়োগের মাধ্যমে আন্দোলন দমনে আওয়ামী লীগের মরিয়া চেষ্টা অব্যাহত ছিল শেষ পর্যন্ত। ৪ আগস্ট আওয়ামী লীগের সশস্ত্র ক্যাডাররা বল প্রয়োগ করে আন্দোলনকে দমনের চেষ্টা করে। ক্ষমতায় থাকার জন্য আওয়ামী লীগ সরকার এবং তার দলীয় কর্মী বাহিনীর এই চূড়ান্ত চেষ্টা ছাত্ররা এবং সাধারণ জনগণ রাস্তার লড়াইয়ে সফলভাবে প্রতিহত করেছিলেন।
কোন পর্যায়ে শেখ হাসিনা পালিয়ে যেতে বাধ্য হলেন?
২ আগস্ট দ্রোহযাত্রার ডাক দিয়েছিল সম্মিলিত নাগরিকদের একটি কমিটি, যার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বিভিন্ন অভিজ্ঞ বামপন্থী নেতা, শিক্ষক নেটওয়ার্ক এবং সম্মিলিত ছাত্র-জনতা। প্রেসক্লাবে হাসিনা পদত্যাগের এক দফা দাবি ঘোষণা করেন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। ঘোষণার পরপর একটি মিছিল প্রেসক্লাব থেকে যাত্রা করে শহীদ মিনার অভিমুখে। বিগত দিনগুলোর কারফিউর থমথমে পরিবেশকে পেছনে ফেলে এই মিছিলে অংশ নেয় দল-মত-শ্রেণি-পেশা-বয়সনির্বিশেষে সব ধরনের মানুষ। হাসিনার পদত্যাগের দাবিতে ঐকমত্য ও জনসমর্থন সেদিনই দৃশ্যমান হয় জনসমক্ষে।
৪ আগস্টও পুলিশ প্রতিবাদী ক্ষুব্ধ জনতার ওপর আক্রমণ চালায়। প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন অবরোধের জন্য দেশজুড়ে ব্যাপক বিক্ষোভ প্রদর্শনে ছাত্রসমন্বয়কেরা ‘লং মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচির আহ্বান জানান। মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচি প্রথমে ৬ আগস্ট ঘোষণা করা হলেও ব্যাপক জনসমর্থনের কারণে সমন্বয়কেরা ঘোষণা দিয়ে ৫ আগস্ট এগিয়ে আনেন। শিক্ষার্থীরা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ঢাকা শহরে বিক্ষোভকারীদের প্রবেশের সমন্বয় করেন। বিভিন্ন দিক থেকে লাখ লাখ বিক্ষোভকারী মিছিল নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের দিকে আসতে থাকেন। সম্মিলিত জনতার শক্তি প্রদর্শনের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন বাহিনীর প্রধানেরা শেখ হাসিনাকে বলেন, গুলি চালিয়েও তাঁরা জনস্রোত থামাতে পারেননি।
এটি ছিল সেই অন্তিম মুহূর্ত, যা হাসিনাকে ক্ষমতা ত্যাগ করতে এবং দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য করেছিল; একই সঙ্গে আওয়ামী লীগের কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান ঘটিয়েছিল। এ অন্তিম মুহূর্ত তৈরির কারিগর ছিলেন হাসিনা নিজেই। অভ্যুত্থানে জনতার বিপুল অংশগ্রহণ যেমন এখানে ছিল, তেমনি সশস্ত্র বাহিনীর সিদ্ধান্ত শেষের দিকে আরও রক্তক্ষয় এড়াতে সহায়ক হয়েছে।
১৫ বছরে সামরিক বাহিনী যে গোষ্ঠীস্বার্থভিত্তিক সরকার-সামরিক বন্ধন (গভর্নমেন্ট-মিলিটারি কমপ্লেক্স) জোরদার করেছিল, তাতে সাধারণ মানুষের ধারণা ছিল, সামরিক বাহিনী হাসিনার কথা অনুযায়ী কাজ করবে। অনেকেই মনে করেন, সেনাবাহিনীর জন্য জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে কাজ করা কঠিন হয়ে যেত, যদি সেনাবাহিনী হাসিনা সরকারের পক্ষে অবস্থান নিত। আবার কেউ কেউ মনে করেন, সেনাবাহিনীর নিরীহ মানুষের ওপর গুলি চালানো প্রত্যাখ্যান করার পেছনের কারণ হলো বহিঃশক্তির প্রভাব। শেখ হাসিনা সেনবাহিনীকে নানাভাবে যে সুযোগ-সুবিধা দিয়েছেন তাতে স্বাভাবিকভাবে মনে হতে পারে যে সেনাবাহিনীর তো তাঁর প্রতি অনুগত থাকার কথা। কিন্তু ঘটনা ঘটেছে উল্টো। এর কারণ হতে পারে দুটি।
প্রথমত, সামরিক বাহিনীর জওয়ানরা নিরীহ জনতার ওপর গুলি চালাতে আগ্রহী ছিলেন না। এ ক্ষেত্রে জোর করে কিছু করতে গেলে সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা বা চেইন অব কমান্ড ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। এটা আঁচ করেই হয়তো সেনাবাহিনী হাসিনার পক্ষ হয়ে গুলি চালাতে বিরত থাকে। দ্বিতীয়ত, গভর্নমেন্ট-মিলিটারি কমপ্লেক্স এমন একটি পর্যায়ে উপনীত হয়েছে যে সামরিক বাহিনীর সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার বিষয়টি আর আওয়ামী লীগ থাকা না-থাকার ওপর নির্ভর করে না; বরং গুলি চালালে সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে যে ব্যাপক অসন্তোষ হতো, তা সেনাবাহিনীর জন্য বেশি ক্ষতিকর হতে পারত। সেনাবাহিনীর এ সিদ্ধান্ত শেখ হাসিনার অন্তিম মুহূর্ত ঘনিয়ে আনার ব্যাপারে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
কালার রেভল্যুশন, না রেভল্যুশন?
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পটভূমি, ঘটনাক্রম, বিভিন্ন গোষ্ঠী ও শ্রেণি-পেশার মানুষের প্রতিক্রিয়া বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এই অভ্যুত্থান কোনোভাবেই পরিকল্পনা করে করা সম্ভব ছিল না। এই অভ্যুত্থানে বিভিন্ন ধরনের জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ, বিচ্ছিন্নভাবে তৈরি হওয়া প্রতিরোধ, আবার একই সঙ্গে কেন্দ্রীয় সমন্বয়কদের সঙ্গে দূর থেকে সংগতি বজায় রাখা—এই সবকিছু আন্দোলনকে একটি নির্দিষ্ট পরিণতির দিকে ক্রমান্বয়ে এগিয়ে নিয়ে গেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সেনাবাহিনীর সমর্থন, যা আবার তৈরি হয়েছে সেনাসদস্যদের পরিবার ও আত্মীয়স্বজনের সরাসরি আন্দোলনে অংশগ্রহণের কারণে।
জুলাই আন্দোলনের সময় একের পর এক এমন ঘটনা ঘটেছে, যা মানুষকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল, তরুণদের উজ্জীবিত করেছিল। নানা রকম ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নতুন নতুন কৌশল উদ্ভাবন কোনো একক সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের পক্ষে করা সম্ভব ছিল না। এখানে এমন বিচ্ছিন্ন ও সংগঠিত—উভয় ধরনের মানুষের সহাবস্থান ও সহযোগিতা ছিল যে এমনকি কোনো দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাও এখানে এককভাবে ভূমিকা রাখতে পারত না। সোভিয়েত-উত্তর দেশগুলোতে সরকার পরিবর্তনের আন্দোলনে যুক্তরাষ্ট্র যে ধরনের সহায়তা দিয়েছিল বলে কেউ কেউ প্রচার করেন, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সে ধরনের কোনো সহায়তা এখানে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে পারেনি। তাই এই আন্দোলনকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রযোজিত কোনো রেভল্যুশন বলা যাবে না।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ভূরাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের অবদান আবশ্যক ছিল না। ব্যাখ্যা হিসেবে ভূরাজনৈতিক ভারসাম্য রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহের কথা বলাই যায়; কিন্তু সরাসরি প্রমাণ করা যায় না যে এই আন্দোলন যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনার ফল। শ্রীলঙ্কা, নেপাল, মালদ্বীপ, পাকিস্তানের মতো বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে ভারতের আধিপত্যের প্রতি বিরোধী মনোভাব গত এক দশকে বেড়েছে। ভারতের আধিপত্যবাদী নীতি এবং আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সম্প্রসারণ নীতির কারণে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে ভারতের নানান টানাপোড়েন তৈরি হয়েছে। জুলাই আন্দোলনের পর প্রতিবেশী ভারতের আধিপত্যকে বিরোধিতা করা দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশের এই নতুন সংযোজন তাই আন্দোলনে যুক্তরাষ্ট্রের অবদানকে নতুন করে আলোচনায় এনেছে।
যুক্তরাষ্ট্র খুব বেশি অর্থ বা শক্তি অপচয় না করেই তার কর্তৃত্ব প্রদর্শনের জন্য আন্দোলনের শেষের দিকে এসে তাদের অবদানগুলো সুচিন্তিতভাবেই প্রচার করেছে। জো বাইডেনের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার সাক্ষাৎ এমন একটি দৃশ্যমান দৃষ্টান্ত, যার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের অবদান সম্পর্কে কৌতূহল তৈরি হয়। জুলাই আন্দোলন বুঝতে হলে এ ধরনের আলামত দিয়ে ভেতরের হিসাব-নিকাশ বোঝার চেষ্টা করলে আসল ঘটনাগুলো আড়াল হয়ে যাবে। অনেক গোষ্ঠীই চায়, এ ধরনের বোঝাপড়া সর্বজনের কাছে গ্রহণীয় হোক। কিন্তু জুলাই আন্দোলনকে খুব ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলে এ ধরনের আশঙ্কা আর থাকার কথা নয়।
একটা গুরুত্বপূর্ণ সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কিছু সাহায্য, কূটনৈতিক মন্তব্য ও খোঁজখবর যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য যোগসাজশ সম্পর্কে জনমনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছিল। এটা হয়েছিল আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে যখন কোটা আন্দোলন গণ-অভ্যুত্থানে পরিণত হয়েছে নিজ অভ্যন্তরীণ গতিশীলতার মধ্য দিয়ে। তাই এই অভ্যুত্থানকে কালার রেভল্যুশন বলা যাবে না।
তাহলে এ আন্দোলনকে কি শুধু রেভল্যুশন বা বিপ্লব বলা যাবে? এ উত্তর খুঁজতে হলে আন্দোলনকারীদের পরবর্তী কার্যক্রমের দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। দেখা যাচ্ছে, আন্দোলনকারীদের মধ্যে সংস্কারের আকাঙ্ক্ষা থাকলেও তা বাস্তবায়নের জন্য আদর্শিক অবস্থানের অভাব রয়েছে। এমনকি অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হলেও এবং আন্দোলনকারীদের সমন্বয়ে নতুন দল গঠনের চেষ্টা হলেও এখানে এত ভিন্নমতের মানুষের সমন্বয়ের চেষ্টা চলছে যে এখানে কোনো নির্দিষ্ট আদর্শের ভিত্তিতে কার্যপরিধি সংজ্ঞায়িত করার বিষয় ওঠে আসেনি। এ অভ্যুত্থানের ফলে শ্রেণিকাঠামো, উৎপাদনকাঠামো, অথবা জনমুখী সরকার গঠনে আদর্শিক অবস্থান পরিবর্তনের কোনো লক্ষণ এখনো দেখা যাচ্ছে না। কাজেই এটি হতে পারে বড়জোর গণতান্ত্রিক বিপ্লব, যা যেকোনো সময় আবার একটি অর্থনৈতিক ভিত্তির অভাবে উল্টো দিকে যাত্রা শুরু করতে পারে।
’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, ’৯০-এর গণ-অভ্যুত্থানের পর যেভাবে শাসকগোষ্ঠীর পরিবর্তন হয়েছে, উৎপাদনকাঠামোর মধ্যে তার কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি। এবারের অভ্যুত্থানের ছয় মাসের পরও তেমন মৌলিক কোনো সংস্কারের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। এখনো এই অভ্যুত্থানকে বিপ্লব বলার মতো ঘটনা ঘটেনি। কেউ কেউ মনে করেন, রেভল্যুশন হওয়ার জন্য উৎপাদনকাঠামো পরিবর্তনের প্রয়োজন নেই, গণতান্ত্রিক কাঠামো প্রতিষ্ঠাই বিপ্লব বলার জন্য যথেষ্ট। এদিক থেকে বাংলাদেশে পূর্বাভিজ্ঞতার দিকে আলোকপাত করা প্রয়োজন। অতীতে প্রতিটি ক্ষেত্রেই গণতান্ত্রিক সরকারের আবির্ভাব ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। স্বৈরাচারী শক্তি বারবার এসেছে।
কালার রেভল্যুশন বলা হোক বা না হোক, তাতে শাসকগোষ্ঠী পরিবর্তন হলেও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় না। অর্থনৈতিক ভিত তৈরি না করলে, পরনির্ভরতা বৃদ্ধি পেলে এবং সর্বোপরি গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের পাশাপাশি অর্থনৈতিক সংস্কারের মাধ্যমে উৎপাদনব্যবস্থা পরিবর্তন না হলে এ ধরনের দেশগুলোয় মৌলিক পরিবর্তন সাধন হয় না। এসব অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, বাংলাদেশে সে অর্থে বৈপ্লবিক পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা কম।
আরও পড়ুনজুলাই অভ্যুত্থান যেসব কারণে পূর্বপরিকল্পিত নয়১২ জানুয়ারি ২০২৫শেষ কথা
একক কোনো দল বা গোষ্ঠী পুরো জুলাই অভ্যুত্থানের ওপর নিয়ন্ত্রণ করার মতো অবস্থানে ছিল না। সংগঠিত ছাত্রগোষ্ঠীগুলোর পরিকল্পনা ও সমন্বয় আন্দোলনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। তবে এর গতিপথ এবং ফলাফল পূর্ণাঙ্গ কোনো নকশা নির্ধারণ করেনি। বিদ্রোহের ভিত্তি আগেই প্রস্তুত হয়েছিল। প্রয়োজন ছিল শুধু একটি স্ফুলিঙ্গের। ছাত্র আন্দোলন সেই স্ফুলিঙ্গ তৈরি করে। এই আন্দোলনকে গণ-অভ্যুত্থান বলা যায়। কালার রেভল্যুশন বা রেভল্যুশন বলা যায় না।
এই গণ-অভ্যুত্থানের যদি কোনো মাস্টারমাইন্ড থেকে থাকে, তাহলে সেই ‘মাস্টারমাইন্ড’ কোনো বহিঃশক্তি যেমন নয়; তেমনি এর প্রযোজক কোনো একক গোষ্ঠীও নয়। এর মাস্টারমাইন্ড একজনের পক্ষেই হওয়া সম্ভব। তিনি হলেন শেখ হাসিনা নিজে। আন্দোলন দমনে এতটা বেপরোয়া হয়ে হাজারের ওপর মানুষ খুন করে ও ২০ হাজারের মতো মানুষকে আহত করে পঙ্গু করে দিয়ে তিনিই মানুষকে রাস্তায় নামিয়েছেন। কোনো পরিকল্পিত শক্তি, এনজিও, মিডিয়া বা একক ব্যক্তির পক্ষে এই আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে এ রকম প্রভাব তৈরি করা সম্ভব ছিল না, যতটা শেখ হাসিনার নিপীড়নমূলক নীতির মাধ্যমে ঘটেছিল।
ড.
মোশাহিদা সুলতানা সহযোগী অধ্যাপক, অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ বিশ্লেষণমূলক ত্রৈমাসিক জার্নাল সর্বজন কথার প্রকাশক।
উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
বইমেলা উপলক্ষে ঢাবিতে যানবাহন প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা শিথিল
অমর একুশে বইমেলা উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ক্যাম্পাসে বহিরাগত যানবাহন প্রবেশের ক্ষেত্রে আরোপিত নিষেধাজ্ঞা শিথিল করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
শুক্রবার (৩১ জানুয়ারি) ঢাবির জনসংযোগ দপ্তর থেকে পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, অমর একুশে বইমেলা আমাদের প্রাণের মেলা। সারা দেশ থেকে বিভিন্ন বয়স ও শ্রেণি-পেশার মানুষ এ বইমেলায় আসেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতর দিয়ে তাদের যাতায়াত নির্বিঘ্ন করতে প্রবেশপথগুলোতে যানবাহন নিয়ন্ত্রণে যে বিধি-নিষেধ থাকে, তা অমর একুশে বইমেলা উপলক্ষে শিথিল করা হলো। ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যানবাহন নিয়ন্ত্রণের জন্য কোনো ব্যারিকেড রাখবে না।
তবে, ঢাকা মহানগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ এ প্রবেশপথগুলোতে সুশৃঙ্খলভাবে যানবাহন প্রবেশ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে যানবাহনগুলো সুশৃঙ্খলভাবে পার্কিং করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বেচ্ছাসেবক দল এবং প্রক্টরিয়াল মোবাইল সিকিউরিটি টিমের সদস্যরা ট্রাফিক বিভাগকে এ ব্যাপারে সার্বিক সহায়তা করবে।
বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়েছে, বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ অমর একুশে বইমেলা উপলক্ষে যানবাহন চলাচল নির্বিঘ্ন করার জন্য ইতোমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করেছে। এ ব্যাপারে সবার সহযোগিতার জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ।
ঢাকা/সৌরভ/রফিক