হাকালুকি হাওরের বিস্তীর্ণ জমিতে হলুদ ঢেউ
Published: 13th, January 2025 GMT
হাকালুকি হাওরপারে সম্ভাবনাময় ফসল হয়ে উঠেছে শর্ষের চাষ। বছরের দীর্ঘ সময় যে জমি পানির নিচে তলিয়ে থাকে, পানি সরে গেলেও যে জমির বেশির ভাগই একসময় পতিত পড়ে থাকত, অনুকূল পরিবেশ পেয়ে সেই জমিতে এখন প্রতিবছর শর্ষের চাষ বাড়ছে। শর্ষে চাষে আগ্রহী হয়ে উঠছেন স্থানীয় কৃষকেরা। এখন সেই জমি হলুদ বন্যায় ভাসছে। শর্ষের হলুদ ফুল ঢেউ খেলছে হাওরের বিস্তীর্ণ জমিতে।
মৌলভীবাজারের হাকালুকি হাওরের বড়লেখা উপজেলার হাওরপারের মাঠগুলো এখন শর্ষের আহ্লাদে আরেক রূপসী বাংলা হয়ে উঠেছে। চাষিদের দিন কাটছে শর্ষেখেতের পরিচর্যায়, শর্ষে ফুলের দিকে তাকিয়ে। এই শর্ষে চাষে অনেকে বাড়তি আয়ের সুযোগ পেয়েছেন। শর্ষেখেতে মৌ-চাষ করছেন অনেকে। মৌমাছিরা ফুল থেকে ফুলে উড়ছে, ঘটছে প্রাকৃতিক পরাগায়ন। ফসল ভালো হচ্ছে।
গত বৃহস্পতিবার হাকালুকি হাওরের হাল্লা এলাকায় দেখা গেছে, হাওরপারের এলাকাটি হলুদ হয়ে আছে। পর্যটন টাওয়ারের কাছে হলুদের বন্যা বইছে। বর্ষায় যেখানে পানি থইথই করে, পানি সরে গেলেও জমি পতিত থাকত; সেই জমিনে এখন শর্ষের ফুল বেণিখোলা কিশোরী হয়ে ঢেউ খেলছে। অনেকটা দূর পর্যন্ত শুধু হলুদেরই দেখা মিলছে। ফুলে ফুলে উড়ে বসছে মৌমাছির দল। কোনো জমিনে চাষিরা ঘাস, আগাছা বাছার কাজ করছেন। কেউ আলপথ ঘুরে ফসলের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছেন। বিকেলের আলোতে হলুদ ফুল আরও প্রাণখোলা হয়ে ফুটছে। বাতাসে ভাসছে শর্ষে ফুলের শান্ত, মৃদু ঘ্রাণ। হাওরে ঘুরতে এসে শর্ষে ফুলে মুগ্ধ হচ্ছেন পর্যটকেরাও।
হাল্লা গ্রামের আব্দুস সালাম বলেন, ‘আমরার বাড়ি একেবারে হাকালুকির মধ্যে। আগে আমরার এ (শর্ষেখেতের) জমিন পাকাল (পতিত) থাকত। কৃষি অফিসাররা সার, বীজ দিবা কওয়ায় (দেবেন বলায়) আমরা চাষ শুরু করছি। দুই বছর ধরি সরিষাখেত কররাম (করছি)। বহুত মাইনসে (অনেক মানুষ) এবার খেত করছে। সরিষার ফলনও ভালা অইছে (হয়েছে)।’
একই গ্রামের দেলওয়ার হোসেন বলেন, ‘আমি পাঁচ-সাত বছর ধরি খেত করছি। আগে অনেক জমিন পড়ি রইছে (পতিত থেকেছে)। আমি সরিষাখেত করি ভালা উপকার পাইরাম (পাচ্ছি)। এবার অন্যবারের থাকি (থেকে) ফসল ভালা অইছে দেখরাম (হচ্ছে দেখছি)।’ তিনি (দেলওয়ার হোসেন) জানিয়েছেন, তিনি ছয় কিয়ার জমিতে শর্ষেখেত করেছেন। আশা করছেন প্রতি কিয়ারে চার থেকে পাঁচ মণ ফসল পাবেন।
কৃষি বিভাগ ও স্থানীয় কৃষকদের সূত্রে জানা গেছে, প্রতিবছরই একটু একটু করে চাষের আওতা বাড়ছে। এ বছর হাকালুকি হাওরের বড়লেখার তালিমপুর ইউনিয়নের হাল্লা, খুটাউরা, মুর্শিবাদকুরা, ধর্মদেহী; সুজানগর ইউনিয়নের বাঘমারা, বাঘেরকোনা, তেরাকুরি, ঝগড়ি; দাসেরবাজার ইউনিয়নের মাইজমজুরি, দ্বিতীয়ারদেহী, মালিশ্রী এবং বর্ণি ইউনিয়নের ছালিয়া, কাজিরবন্দ, মালামবিল এলাকার মাঠে শর্ষের চাষ হয়েছে।
কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, গত বছর বড়লেখা উপজেলায় ২ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে শর্ষের চাষ হয়েছিল। চলতি বছর ২ হাজার ৫৫০ হেক্টরে শর্ষের আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে হাকালুকি হাওরপারে শর্ষের চাষ হয়েছে প্রায় ১ হাজার ৯০০ হেক্টরে। এ বছর বারি সরিষা-১৪, বারি সরিষা-১৭, বারি সরিষা-১৮, বিনা সরিষা-৯, বিনা সরিষা-১১ জাতের চাষ হয়েছে। হাওরপারে শর্ষে চাষে আগ্রহ বাড়ার বেশ কিছু অনুকূল পরিবেশ রয়েছে। এর মধ্যে আছে শর্ষের স্বল্প জীবনকাল, কম সময়ে ফসল এলেও এটি উচ্চ ফলনশীল। আছে শর্ষের বিভিন্ন জাতের সহজপ্রাপ্যতা। শর্ষে চাষে সেচ কম লাগে। অল্প উৎপাদন খরচ হওয়ায় কৃষকের ভালো মুনাফা হয়ে থাকে। প্রতি মণের দাম চার হাজার থেকে সাড়ে চার হাজার টাকা।
শর্ষের শুকনা গাছ বর্ষাকালে হাওরপারের চাষিরা জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন। শর্ষের খৈল গোখাদ্য হিসেবে চাষিদের কাজে আসে। পারিবারিক ভোজ্যতেলের চাহিদা পূরণ করে অনেকেই শর্ষে চাষে বাড়তি আয় করেন। শর্ষেখেতের ওপর নির্ভর করে অনেকেই মৌ চাষ করছেন। হাওরপারের খেতে প্রায় ২০০ মৌ বাক্স রয়েছে। এতে মধু হয়, আবার প্রাকৃতিক পরাগায়নের কারণে শর্ষের উৎপাদন বাড়ে।
বড়লেখা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো.
উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
সরস্বতি পূজা উপলক্ষে গোপালগঞ্জে জমজমাট প্রতিমার হাট
আগামী ২ ও ৩ ফেব্রুয়ারি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বিদ্যার দেবী সরস্বতী পূজা। এ উপলক্ষে গোপালগঞ্জ জেলার বিভিন্নস্থানে বসেছে প্রতিমার হাট। এখন চলছে প্রতিমার বেচাকেনা। এবার প্রতিমার দাম নিয়ে ক্রেতাদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রীয়া থাকলেও কারিগররা বলছেন, জিনিস পত্রের দাম বাড়ায় প্রতিমার দামও কিছুটা বাড়তি।
পঞ্জিকা মতে মাঘ মাসের শুক্লপক্ষের পঞ্চমী তিথিতে আশীর্বাদ লাভের আশায় বিদ্যার দেবী সরস্বতী পূজা করে থাকেন হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা। শুধু বাড়িতেই নয় বিদ্যার দেবী সরস্বতী পূজার আয়োজন করা হবে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। দেবীর পায়ে অঞ্জলী দিয়ে অনেক শিশুর শিক্ষাজীবন শুরু হবে।
এ পূজার প্রধান অনুসঙ্গ হলো প্রতিমা। ফলে জেলা শহরের গোহাট সার্বজনীন কালীবাড়ী, সদর উপজেলার সাতপাড়, বৌলতলী, কোটালীপাড়া উপজেলার রাধাগঞ্জ, ভাঙ্গারহাট, ঘাঘর বাজারসহ অনেক স্থানে বসেছে প্রতিমার হাট। এসব হাটে আনা এক একটি প্রতিমা প্রকার ভেদে বিক্রি হচ্ছে ২৫০ থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত দামে।
আরো পড়ুন:
লক্ষ্মীপুরে রাসপূর্ণিমা উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা শুরু
পুটিয়ার কৃষ্ণপুরে চলছে কাত্যায়নী পূজা
এ বছর ক্রেতাদের মধ্যে প্রতিমার দাম নিয়ে রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। ক্রেতাদের অনেকেই বলছেন, দাম সাধ্যের মধ্যে আবার কেউবা বলছেন দাম আগের চেয়ে বেশি নিচ্ছেন বিক্রেতারা। তবে, এর মধ্যেও বিভিন্ন বয়সের মানুষ এসব হাট থেকে কিনে নিচ্ছেন পছন্দমতো প্রতিমা। হাটে শুধু প্রতিমাই নয় বিক্রি হচ্ছে ফুল, মালা, মিষ্টিসহ পূজার অন্যান্য উপকরণও।
রীতি অনুযায়ী বিদ্যার দেবী সরস্বতি পূজার পাশাপশি বসন্ত পঞ্চমীতে গণেশ, লক্ষ্মী, নবগ্রহ, বই, খাতা, কলম ও বাদ্যযন্ত্রের পূজা করার রীতি প্রচলিত রয়েছে। এর মধ্য দিয়ে শীত ঋতুর অবসান হয়ে বসন্ত ঋতুর আগমন বার্তা ঘটবে।
প্রতিমা কিনতে আসা উত্তম সাহা বলেন, “শহরের গোহাট সার্বজনীন কালীবাড়ীতে সরস্বতী প্রতিমার হাট বসেছে। এবার বাড়িতে পূজা করাব। ছেলেকে নিয়ে হাটে প্রতিমা কিনতে এসেছি। ঘুরে ফিরে পছন্দমত প্রতিমা কিনেছি। আমি মনে করি, পূজা নির্বিঘ্নে অনুষ্ঠিত হবে।”
অপর ক্রেতা নারু গোপাল বলেন, “প্রতিবছর এখানে প্রতিমার হাট বসে। এবে এবার প্রতিমার আমদানি একটু কম। তারপরেও দেখে বুঝে দরদাম করে একটি প্রতিমা কিনেছি। এবার আমাদের বাড়িতে সরস্বতী পূজা হবে।”
অপর ক্রেতা পরিমল চন্দ্র ঢালী বলেন, “এক একটি প্রতিমা ২০০ তেকে ১০ হাজার টাকা পযর্ন্ত বিক্রি হচ্ছে। হাটে এসে প্রতিমা দেখছি। পছন্দ হলে কিনে নিয়ে যাব। গত বছরের তুলনায় এবার প্রতিমার দাম একটু বেশি।”
গোপালগঞ্জ শহরের গোহাট সার্বজনীন কালীবাড়ীর হাটে প্রতিমা বিক্রি করতে আসা উত্তম পাল বলেন, “এবার ২০টি প্রতিমা নিয়ে এসেছি। ইতোমধ্যে ১০টি বিক্রি করা হয়েছে। তবে এবার ক্রেতার সংখ্যা একটু কম। আশা করি, বাকি দুই দিনও বেচাকেনা হবে।”
কার্ত্তিক পাল বলেন, “কোটালীপাড়া উপজেলার হিরণ গ্রাম থেকে ৩০টি প্রতিমা নিয়ে এসেছি বিক্রির জন্য। চার থেকে পাঁচটি প্রতিমা বিক্রি করেছি। ক্রেতারা যে দাম বলছেন, তাতে প্রতিমা বিক্রি করা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ প্রতিমা তৈরির অনুসঙ্গের যে দাম তাতে খরচও উঠছে না।”
স্বপন পাল নামে এক বিক্রেতা বলেন, “প্রতিমা তৈরিতে ব্যবহৃত ছোন, রংসহ বিভিন্ন সরঞ্জামের দাম প্রতিবছর বেড়েই চলছে। ক্রেতারা যে দাম বলছেন, সেই দামে বিক্রি করলে লোকসানের মুখে পড়তে হবে। তারপরেও বাব-দাদার পেশা আমরা ধরে রেখেছি।”
ঢাকা/বাদল/মাসুদ