সিরিয়ায় বাশার আল আসাদ সরকারের পতন সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিসরসহ মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশকে সতর্ক করেছে। কিন্তু সুনির্দিষ্টভাবে ইসরায়েল সিরিয়ার পটপরিবর্তনে উদ্বিগ্ন।

ইসরায়েল সরকারের একটি কমিটি এমন পরামর্শও দিয়েছে যে সুন্নি মুসলিমশাসিত সিরিয়া, যারা ইসরায়েলের অস্তিত্বের অধিকারকেই স্বীকৃতি দেয় না, শেষ পর্যন্ত ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় শত্রু ইরানের চেয়েও সম্ভাব্য বড় হুমকি হয়ে উঠতে পারে।

এই কমিটি সুনির্দিষ্টভাবে সিরিয়ায় তুরস্কের প্রভাব নিয়ে বিচলিত ছিল। তারা দাবি করেছে, তুরস্ক সিরিয়ার নতুন সরকারকে প্রক্সি বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করতে পারে, যাতে করে ‘অটোমান সাম্রাজ্যকে তার পূর্বের গৌরবে ফিরিয়ে আনা যায়’।

প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, সিরিয়ার নতুন সরকারকে তুরস্ক খুব দ্রুত অস্ত্র দিয়ে সজ্জিত করতে পারে, সম্ভাব্যভাবে যেটা ইসরায়েল ও তুরস্কের মধ্যে সরাসরি সংঘাতের সূত্রপাত ঘটাতে পারে।

কিন্তু এটা কি বাস্তব চিত্র? সংক্ষেপে উত্তর হলো, না।

যদিও তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান ধারাবাহিকভাবে তুরস্ক-ইসরায়েল দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক দুর্বল করেছেন। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য কমিয়ে দিয়েছেন, ইসরায়েলে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের বিমান ভ্রমণ করতে দেননি, আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে তেল আবিবের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ দিয়েছেন। তুরস্কের সেনাবাহিনী একদিন ফিলিস্তিনি জনগণের সহযোগিতায় এগিয়ে যাবে, এমন জনতুষ্টিবাদী বক্তব্যও দিয়েছেন। এ সবকিছুর পরও ইসরায়েলের সঙ্গে তুরস্ক সামরিক সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার কোনো কারণ নেই।

ইতিহাসের বাস্তবতা হলো, তুরস্ক ও ইসরায়েল দুটি দেশই মার্কিন মিত্র। দুই পক্ষ কখনোই পরস্পরের সঙ্গে সামরিক সংঘাতে জড়ায়নি। তুরস্কের এ ধরনের অ্যাডভেঞ্চারে জড়ানোর কোনো খায়েশ নেই। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে যখন ইরান ও ইসরায়েল একটা যুদ্ধের মধ্যে আছে এবং গাজায় বিপর্যয় ঘটে গেছে।

সিরিয়ায় তুরস্কের উদ্দেশ্য খুবই পরিষ্কার। সিরিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত সব ক্রীড়ানকের সঙ্গে প্রকাশ্যে ও ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করেছে।

প্রথমত, তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাকান ফিদান বলেছেন, আঙ্কারা চায় একটা স্থিতিশীল সিরিয়া, যেটা অন্য কোনো দেশের ওপর হুমকি তৈরি করবে না।

দ্বিতীয়ত, সিরিয়াকে একটি গণতান্ত্রিক, এককেন্দ্রিক ও বেসামরিক রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চায় তুরস্ক। সব সংঘ্যালঘু ও জাতিসত্তাকে নিয়ে হতে হবে নতুন সিরিয়া। একই সঙ্গে কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি (পিকেকে) যেন ক্ষুদ্ররাষ্ট্র গঠন করতে না পারে, সেটা ঠেকাতে চায় তুরস্ক।

আমি যত দূর শুনেছি, সিরিয়ায় তুরস্কের সামরিক সম্পৃক্ততা সীমিত থাকবে। তুরস্কের সেনাবাহিনীর বিশেষজ্ঞরা হামা ও দামেস্কের বাইরে যাবে না। এর মাধ্যমে তুরস্ক ইসরায়েলকে বার্তা দিতে চায় যে সিরিয়ায় তাদের পদক্ষেপ ইসরায়েলের জন্য শত্রুতাবশত নয়।

এক দশকের বেশি সময় ধরে লাখ লাখ সিরীয় শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়ে রেখেছে তুরস্ক। বেশ কয়েকবার তুরস্কের সেনাবাহিনীকে সামরিক অভিযান করতে হয়েছে। এ সবকিছু তুরস্কের নাগরিকদের জীবনযাপনের ওপর প্রভাব ফেলেছে। শত শত মিলিয়ন ডলার ব্যয় করতে হয়েছে। এ বাস্তবতায় তুরস্ক চায় সিরিয়া যেন অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে বিকশিত হতে পারে। ইসরায়েলের সঙ্গে সরাসরি কিংবা পরোক্ষ কোনো সংঘাত শুরু হলে তুরস্কের সেই লক্ষ্য বাস্তবায়িত হবে না।

এখন পর্যন্ত তুরস্কের পদক্ষেপগুলো তাদের উদ্দেশ্যের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ।

প্রথম পর্যায়ে সিরিয়ায় আসাদ সরকারের সামরিক স্থাপনা লক্ষ্য করে ইসরায়েলের বিমান হামলায় চোখ বন্ধ করে রেখেছিল তুরস্ক। হামলার পরিসর বাড়ার পর ফিদান বলেন, ইসরায়েলকে অবশ্যই এ ধরনের হামলা বন্ধ করতে হবে।

সিরিয়ার রাসায়নিক অস্ত্র ভুল হাতে চলে যেতে পারে—এ–সংক্রান্ত ইসরায়েলের উদ্বেগকে স্বীকার করে নেন ফিদান। এখানে উল্লেখ করা দরকার যে ইসরায়েল হায়াত আল-শামের (এইচটিএস) লক্ষ্যবস্তুতে হামলা এড়িয়ে চলেছে।

এ ছাড়া সিরিয়ায় ইসরায়েলি বাহিনীর সঙ্গে সংঘাত যাতে না বাঁধে, তার জন্য একটা ব্যবস্থা তৈরিতে উদ্যোগ নিয়েছে তুরস্ক। দুই দেশের গোয়েন্দা সংস্থা নিয়মিতভাবে যোগাযোগ করে চলেছে।

আমার সূত্রগুলো জানিয়েছে, আহমদ আল-শারাসহ এইচটিএসের নেতাদের আঙ্কারা পরামর্শ দিয়েছে, ইসরায়েলের সঙ্গে তারা যেন শান্ত থাকে। এইচটিএসের কয়েকজন নেতা জনসম্মুখে বলেছেন যে তারা ইসরায়েলের সঙ্গে সংঘাত চান না।

এদিকে তুরস্কের কিছু সূত্র জানিয়েছে, এমন ইঙ্গিত আছে যে দামেস্ক সামরিকভাবে আঙ্কারার সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে আগ্রহী। বিশেষ করে সিরিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন সিরিয়ার সেনাবাহিনী পুনর্গঠনে তুরস্কের সহযোগিতা চাইবে সিরিয়া।

এ ধরনের সহযোগিতার ব্যাপারে ইসরায়েলের উদ্বেগ নিয়ে সচেতন তুরস্ক। আমি যত দূর শুনেছি, সিরিয়ায় তুরস্কের সামরিক সম্পৃক্ততা সীমিত থাকবে। তুরস্কের সেনাবাহিনীর বিশেষজ্ঞরা হামা ও দামেস্কের বাইরে যাবে না। এর মাধ্যমে তুরস্ক ইসরায়েলকে বার্তা দিতে চায় যে সিরিয়ায় তাদের পদক্ষেপ ইসরায়েলের জন্য শত্রুতাবশত নয়।

কিন্তু ইসরায়েলকে এই শর্ত মেনে নিতে হবে যে সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে পিকেকে নিয়ন্ত্রিত ছোট রাষ্ট্রের অস্তিত্ব সহ্য করবে না তুরস্ক। তুরস্ক বারবার করে বলে আসছে, কুর্দি গোষ্ঠীগুলো যেন একীভূত সিরিয়ার অংশ হয়।

ইসরায়েলের একটি প্রতিবেদন থেকে দেখা যাচ্ছে, তেল আবিব তার নিরাপত্তার স্বার্থে ভাগ হয়ে যাওয়া সিরিয়াকেই পছন্দ করবে। এটা একটা ভুল।

খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে যাওয়া সিরিয়া সশস্ত্র গোষ্টীগুলোর বিকাশের জন্য উর্বর ক্ষেত্র হবে। সেটা হলে পুরো অঞ্চলে অস্থিতিশীলতা তৈরি হবে। দীর্ঘ মেয়াদে যেটা ইসরায়েলের জন্য ঝুঁকির কারণ হবে। এর বিপরীতে একটি গণতান্ত্রিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সিরিয়া সবার স্বার্থ রক্ষা করবে।

রাগিপ সোয়লু আঙ্কারায় মিডল ইস্ট আইয়ের ব্যুরো প্রধান
মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত

.

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

গুগল-ফেসবুক আগ্রাসনে সংবাদমাধ্যমের করণীয়

গুগল, ফেসবুক ও ইউটিউবের মতো বৈশ্বিক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের আয়ের সিংহভাগই আসে ডিজিটাল বিজ্ঞাপন বাণিজ্য থেকে। এর উৎস সংবাদসহ ডিজিটাল কনটেন্ট। এসব কনটেন্ট থেকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার আয় করলেও গুগল কিংবা ফেসবুক কনটেন্ট প্রকাশকদের সঙ্গে আয় ভাগাভাগি নামমাত্র করে থাকে। সংবাদমাধ্যমগুলো একদিকে গুগল, ফেসবুক ও ইউটিউবের কাছে বাজার হারাচ্ছে, অন্যদিকে তাদের ডিজিটাল আয়ের ছিটেফোঁটা পেতে ভিউ আর কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ডের পেছনে ছুটতে ছুটতে মুমূর্ষু দশা। এই জিম্মি দশা থেকে সংবাদমাধ্যমের উত্তরণের উপায় কী?

সামাজিক মাধ্যমের আগ্রাসন থেকে বাঁচাতে ইতোমধ্যে বিভিন্ন দেশে নানা উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে। নিউইয়র্ক টাইমস, সিএনএন, ব্লুমবার্গ, ওয়াশিংটন পোস্টের মতো গুরুত্বপূর্ণ সংবাদমাধ্যমগুলো ডিজিটাল সাবস্ক্রিপশন চালু করেছে। কোনো কোনো মিডিয়া আংশিক সাবস্ক্রিপশন চালু করেছে; নির্বাচিত কিছু সংবাদ বিনামূল্যে পড়া গেলেও এক্সক্লুসিভগুলো পড়তে অর্থ গুনতে হবে। সাবস্ক্রাইবার বিজ্ঞাপন ছাড়া খবর পড়ারও সুযোগ পাবেন। কিছু মিডিয়া ডোনেশন পদ্ধতি চালু করেছে; খবর বিনামূল্যে পড়া গেলেও শুভানুধ্যায়ী ও পাঠকরা অর্থ দিতে পারবেন। অনেক সংবাদমাধ্যম ডেটা সেলিং, পেইড কনটেন্টসহ নতুন নতুন ধারণা বাস্তবায়নে সফল হচ্ছে।

সংবাদের জন্য পেইড সাবস্ক্রিপশন পদ্ধতি আমাদের মতো দেশে বেশ কঠিন; দর্শক-পাঠকরা বিনামূল্যে খবর পেতে অভ্যস্ত। অস্ট্রেলিয়া সরকার নিবিড় পর্যবেক্ষণ করে দেখেছে, সামাজিক মাধ্যম সংবাদ থেকে প্রাপ্ত আয়ের সর্বোচ্চ ১৯ শতাংশ দেয় প্রকাশকদের। বৈষম্যমূলক এ ব্যবস্থা পরিবর্তন করে প্রকাশকদের ন্যায্য হিস্যা দিতে ‘নিউজ মিডিয়া বার্গেইনিং কোড (এনএমবিসি)’ নামে আইন চালু করেছে দেশটি। প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ডিজিটাল কনটেন্টের আয়ের সুষম বণ্টনে ২০২১ সালে প্রণীত এ আইনে গুগল, ফেসবুক, ইউটিউবে কোনো সংবাদ কনটেন্ট শেয়ার হলে সেখান থেকে আয়ের একটি অংশ সংশ্লিষ্ট প্রকাশককে দিতে বাধ্য করা হয়। কিন্তু ওই সময় বেঁকে বসে ফেসবুক-গুগল। দেশটির জন্য সংবাদ কনটেন্ট দেখার সুযোগই বাতিল করে দেয় ফেসবুক। তবে অস্ট্রেলিয়া সরকারের কঠোর অবস্থানের কারণে পরবর্তী সময়ে লেজ সোজা করতে বাধ্য হয় ফেসবুক। ফলে শুধু গত বছরই ফেসবুকে খবরের লিংক শেয়ারের মাধ্যমে অস্ট্রেলিয়ার প্রকাশকরা প্রায় ৪৭ মিলিয়ন ডলার বাড়তি আয় করেছে। 
অস্ট্রেলিয়ার প্রায় কাছাকাছি আইন পাস করেছে কানাডা, দক্ষিণ আফ্রিকা, জাপান, নিউজিল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, ব্রাজিল। যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি রাজ্যও এ ধরনের আইন পাসের পথে। ভারতও নিজেদের মতো আইন পাস করেছে। তবে সংবাদ কনটেন্ট থেকে প্রকাশকদের আয় বিগটেকের আয়ের তুলনায় এ পদ্ধতিতেও নগণ্য। 

যুক্তরাষ্ট্রের হিউস্টন ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক হারিস মাতিন, ব্র্যাটেল গ্রুপের জ্যেষ্ঠ সহযোগী হারিস তাবাকোভিচ এবং প্যাট্রিক হোল্ডার যৌথ এক গবেষণায় দেখিয়েছেন, সংবাদনির্ভর ভালো কনটেন্টের কারণেই গুগল-ফেসবুক-ইউটিউবের মতো মাধ্যমে বেশি বেশি আসছেন ব্যবহারকারীরা। এতে বাড়তি আয় হচ্ছে এসব মাধ্যমের। এ আয়ে সংবাদ কনটেন্ট নির্মাতা ও পরিবেশকদেরও ন্যায্য হিস্যা রয়েছে। এখানে বৃহৎ ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম এবং সংবাদ কনটেন্ট নির্মাতা ও পরিবেশক পরস্পরের পরিপূরক। কাজেই এখানে আয়েরও সুষম বণ্টন হওয়া উচিত। এক হিসাবে দেখা গেছে, ২০২২ সালেই ১৫ বিলিয়ন ডলার হিস্যা থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যমকে বঞ্চিত করেছে বিগটেকগুলো।

যেখানে উন্নত দেশের সংবাদমাধ্যমকেই নাকানিচুবানি খাওয়াচ্ছে ফেসবুক-গুগল, সেখানে আমরা তো কোন ছার! এক দশক ধরে সরকার নানাভাবে চেষ্টা করেও বাংলাদেশে ফেসবুক-গুগলকে অফিস খোলাতে পারেনি। এ দেশ থেকে কী পরিমাণ আয় করে তারা, সে হিসাবও দেয়নি। সর্বশেষ ২০১৯ সালে সরকার নীতিমালা করার পর ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে এনবিআর বিগটেক কোম্পানি থেকে মোট ১১৬ কোটি ৪৩ লাখ টাকা ভ্যাট আদায় করতে পেরেছে। এর মধ্যে ফেসবুক দিয়েছে ৪৩ কোটি ৬২ লাখ টাকা। যৎসামান্য ভ্যাট দিলেও এখনও ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে যাচ্ছে এসব কোম্পানি। 
দেশের বিজ্ঞাপনদাতারা সাধারণত ক্রেডিট কার্ড বা অন্য কোনো উপায়ে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে অর্থ পরিশোধ করেন। তখন ব্যাংক কর্তৃপক্ষ স্বয়ংক্রিয়ভাবে ১৫ শতাংশ ভ্যাট কেটে রাখে। এখানে আলাদা করে ফেসবুক-গুগলসহ অন্যান্য বিদেশি টেক কোম্পানিকে ভ্যাট দিতে হয় না। ভ্যাটের কাগজ এনবিআরে কেবল জমা দেয়। ট্যাক্স তারা দিচ্ছেই না; যথাযথ ভ্যাটও কি দিচ্ছে? 
বাংলাদেশে ২০২২ সালে প্রিন্ট ও টেলিভিশনের বিজ্ঞাপনের বাজারমূল্য ছিল ৮ হাজার কোটি টাকার বেশি। ২০২৩ সালে এসে সেটি ৭ হাজার ৬৬৫ কোটি টাকায় নেমে আসে (সময় নিউজ, ২৭ সেপ্টেম্বর ২৪)। এখন নিশ্চয় আরও কমেছে। ডিজিটাল বিজ্ঞাপনের বাজার এর চেয়ে ঢের বেশি হওয়ার কথা। সেটি যদি আমরা ১০ হাজার কোটি টাকাও ধরে নিই এবং এর ৮০ শতাংশ যদি ফেসবুক-গুগলসহ অন্যান্য টেকজায়ান্ট পেয়ে থাকে, তবে ভ্যাটের পরিমাণ হয় ১২শ কোটি টাকা! 

ডিজিটাল বিজ্ঞাপন বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আরও একটি বড় সমস্যা হচ্ছে, টাকার পুরোটাই যাচ্ছে ডলার হিসেবে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে টান পড়ছে। এনবিআর ২০১৯ সালে বিগটেকের জন্য ভ্যাট এজেন্ট নিয়োগ বাধ্যতামূলক করার পর ২০২০ সালে দেশে এইচটিটিপুল নামে অথরাইজড এজেন্টের অফিস চালু করে ফেসবুক। শোনা যায়, ডলার সংকটে বাংলাদেশ থেকে আয়ের টাকা স্থানান্তর করতে ঝামেলায় পড়ে ২০২৩ সালের জুনেই কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করে এইচটিটিপুল। এমন পদক্ষেপ ভ্যাট-ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়ার কৌশল কিনা– সে প্রশ্নেরও অবকাশ রয়েছে। কেননা, ব্যাংকিং চ্যানেলে ট্রাভেল কোটায় একটি ক্রেডিট কার্ডের বিপরীতে বছরে ১২ হাজার ডলারের বেশি খরচ করার সুযোগ নেই। বেসিস সদস্যরা সর্বোচ্চ ৪০ হাজার ডলার খরচ করতে পারেন।

বাংলাদেশ থেকে ডিজিটাল বিজ্ঞাপন প্রচারে মোটা অঙ্কের অর্থ যে চলে যাচ্ছে, সেটা যাচ্ছে কীভাবে? অভিযোগ আছে, দেশের বৃহৎ প্রতিষ্ঠান বা বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশের বাইরে থাকা কার্যালয় থেকে বিজ্ঞাপনের মূল্য পরিশোধ করে। হুন্ডির মাধ্যমেও যায়। এইচটিটিপুল যখন বাংলাদেশে ছিল তখন ইচ্ছামতো ডিজিটাল বিজ্ঞাপনে ব্যয় করার সুযোগ ছিল, কিন্তু এখন? এইচটিটিপুল বন্ধ হওয়ার পর দেশে কি ফেসবুক-গুগলের বিজ্ঞাপন কমেছে? মনে হয় না। 

দেশীয় সংবাদমাধ্যম বাঁচানোর পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা পাচার বন্ধে ডিজিটাল বিজ্ঞাপন খাতকে নজরদারির আওতায় আনতে হবে। দেশের টাকা দেশের বিজ্ঞাপনের অর্থ যেন শতভাগ দেশীয় সংবাদমাধ্যম পায়, এ জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। প্রয়োজনে সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধি, শীর্ষ বিজ্ঞাপনদাতা, এজেন্সিসহ সংশ্লিষ্ট অংশীদারদের নিয়ে আলোচনায় বসতে হবে। নীতিমালা করতে হবে– দেশীয় কোম্পানিগুলো যেন তার বিজ্ঞাপন খরচের পুরোটা না হোক; অন্তত বড় অংশ স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে দেয়। 

কার্যকর নীতিমালা হওয়ার আগ পর্যন্ত দেশের শীর্ষ কোম্পানিগুলোর গুগল-ফেসবুকে বিজ্ঞাপন প্রচার বন্ধ রাখতে হবে। আবার ছোট ছোট উদ্যোক্তা, যারা ফেসবুক-গুগলকেন্দ্রিক ব্যবসা করেন, তারা যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হন, সেটাও নিশ্চিত করতে হবে। এতে যেমন সংকটময় সময়ে ডলারের অপচয় রোধ হবে, তেমনি স্থানীয় সংবাদমাধ্যমও নিছক ভিউ ও ভাইরালের পেছনে না ছুটে বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতায় মনোযোগ দিতে পারবে। 

পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণকে টিকিয়ে রাখতে কাগজ আমদানিসহ অন্যান্য খাতে বাড়তি শুল্ক পরিহার করাও সময়ের দাবি। মিডিয়া বায়িং এজেন্সিও যেন বিজ্ঞাপনের কমিশনে স্ট্যান্ডার্ড মেনে চলে, এদিকটাও দেখা দরকার। মানসম্মত সাংবাদিকতা টিকিয়ে রাখার স্বার্থে সরকারকেই এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করতে হবে।
মিডিয়ার যখন সংস্কারের কথা উঠছে তখন টেকসই, জবাবদিহিমূলক, বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার স্বার্থে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আমরা বিষয়গুলো গুরুত্ব সহকারে ভেবে দেখার আহ্বান জানাই। সংবাদমাধ্যমকেও শুধু সরকারের দিকে না তাকিয়ে নিজেদের উদ্যোগী, উদ্যমী হতে হবে। নতুন প্রজন্মের চাহিদা মাথায় রেখে সংবাদ উপস্থাপনে নতুন চিন্তার পাশাপাশি আয় বাড়াতে নতুন নতুন উদ্ভাবনী ধারণা বাস্তবায়নে মনোযোগী হতে হবে।

হাসান জাকির: সহকারী সম্পাদক, সমকাল
prantojakir@gmail.com

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • গুগল-ফেসবুক আগ্রাসনে সংবাদমাধ্যমের করণীয়