পাঠ্যপুস্তক সংস্কার শিক্ষায় কী প্রভাব ফেলতে পারে
Published: 12th, January 2025 GMT
সম্প্রতি বাংলাদেশের সাধারণ শিক্ষাধারার সংস্কারকৃত তথা পরিমার্জিত পাঠ্যপুস্তক প্রকাশিত হয়েছে। সীমিত কয়েকটি ক্লাসে সীমিত সংখ্যক বই বিতরণ করা হয়েছে। পাশাপাশি শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে অনলাইনে বইগুলোর পিডিএফ কপি প্রকাশ করেছে। বইগুলো নিয়ে সঙ্গে সঙ্গেই কিছু বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। বিতর্কটি মূলত বইগুলোর সংস্কার বা পরিমার্জন নিয়ে। জাতীয় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে বিতর্ক হওয়াই স্বাভাবিক। বিশেষত যার সঙ্গে কোটি কোটি শিশু-কিশোরের এবং একই সঙ্গে দেশের ভবিষ্যৎ নির্ভরশীল। আর বাংলাদেশের মানুষ এখন শিক্ষা বিষয়ে সচেতন ও খানিকটা স্পর্শকাতরও। কৌতুক করে বলা হয়, শ্রীলঙ্কার শতভাগ মানুষ শিক্ষিত আর বাংলাদেশের শতভাগ মানুষ শিক্ষাবিদ।
রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে ওঠার পর রাষ্ট্রের শিক্ষা রাষ্ট্রের রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত। যে রাষ্ট্র রাজাশাসিত, সে রাষ্ট্রের সত্য রাজার উৎপাদিত সত্যের সম্পর্কিত হয়েছে। ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্রে যেমন শিক্ষামন্ত্রী বলেন, হিতাহিতের বিচার করেন কে? রাজা। আধুনিক সভ্য রাষ্ট্রে অবশ্য শিক্ষা রাজার সে হস্তক্ষেপের অনেকটাই বাইরে। শিক্ষা একাডেমিক স্বাধীনতা ভোগ করে।
১৮১৩ সালের আগে পর্যন্ত বাংলা অঞ্চলের শিক্ষার সঙ্গে রাষ্ট্রের বা শাসক শ্রেণির খুব বেশি ভূমিকা ছিল না। ওই বছর শিক্ষায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রথমবারের মতো এক লাখ টাকা বরাদ্দ করে। তখন শিক্ষায় শাসক শ্রেণির হস্তক্ষেপ নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়। এর পরিসমাপ্তি ঘটে কুখ্যাত ঔপনিবেশিক কেরানি তৈরির মেকলে নীতি গ্রহণের ভেতর দিয়ে। এ অঞ্চলে পাঠ্যপুস্তকের উন্নয়নও সে সময়েই ঘটে। স্কুল বুক সোসাইটির মাধ্যমে। পাঠ্যপুস্তক রচনায় যুক্ত হন বিদ্যাসাগর থেকে রবীন্দ্রনাথের মতো মনীষীরা।
বাংলাদেশের জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড মূলত স্কুল বুক সোসাইটিরই উত্তরাধিকার। প্রতিবছর এ প্রতিষ্ঠানটি দেশের মূলধারার শিক্ষার উচ্চ মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত ব্যবস্থার পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করে থাকে। এ বছরও তাই করেছে। তবে এ বছরের পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের প্রেক্ষাপট একটু ভিন্ন।
২০২১ সালে তৎকালীন সরকার অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করে। এর ভিত্তিতে কয়েকটি শ্রেণিতে পাঠ্যপুস্তকও প্রণীত হয়। তখন সেসব পাঠ্যপুস্তকের শিখন ও মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে বিশৃঙ্খলা ও ব্যাপক বিতর্ক ওঠে। কিন্তু প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ্যপুস্তক আগের ধারায় থাকায় এটা নিয়ে কোনো বিতর্ক সৃষ্টি হয়নি।
এর মধ্যে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। নতুন শিক্ষাক্রম বাতিল ও শিক্ষা সংস্কারের দাবি ওঠে। তখন অন্তর্বর্তী সরকার সাময়িক ব্যবস্থা হিসেবে মাধ্যমিকে ২০১২ সালে প্রণীত পাঠ্যপুস্তকগুলো ফিরিয়ে আনা ও প্রাথমিকে প্রচলিত পাঠ্যপুস্তকগুলো বহাল রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। অবশ্য প্রকাশের আগে বইগুলো সংস্কার তথা পরিমার্জনের সিদ্ধান্ত হয়। এ লক্ষ্যে সরকার একটি কমিটিও গঠন করে, যদিও কমিটির কয়েকজন সদস্য নিয়ে একটি পক্ষের ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার মুখে সে কমিটি বাতিল হয়। তারপর কোনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা ছাড়াই বইগুলো পরিমার্জন করা হয়। কাদের দিয়ে কী কী পরিমার্জন করা হচ্ছে, তা ঘোষণা করা হয়নি। এ নিয়ে জল্পনা-কল্পনার সৃষ্টি হয়।
পরিমার্জিত বইগুলোর টাইটেল পৃষ্ঠাগুলোতে দেখা যাচ্ছে, প্রণয়নকারী হিসেবে প্রথম পরীক্ষামূলক সংস্করণের লেখকবৃন্দের নামই রয়েছে। কিন্তু বিয়োজন-সংযোজন-পরিমার্জনের কাজগুলো কারা করেছেন, তা টাইটেল পৃষ্ঠায় উল্লেখ করা হয়নি; যা করা সমীচীন ছিল।
প্রাথমিক পাঠে মনে হচ্ছে– পরিবর্তনগুলো মূলত ঘটানো হয়েছে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও ইতিহাস-সংক্রান্ত বিষয়গুলোতে। প্রাথমিকের পাঠ্যপুস্তকে জাতীয় সংগীত শুরুতেই ছিল। তা পেছনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা নিয়ে প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের দাবির মধ্যে ভিন্নতা রয়েছে। বিগত সরকারের দাবি অনুসারে পাঠ্যপুস্তকে যে বয়ান ছিল, তা বদলে এবার অন্য পক্ষের বয়ানটি এসেছে। বিষয়টি ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক। শিক্ষাবিদদের মতামত দেওয়ার বিশেষ সুযোগ নেই। তবে এ ক্ষেত্রে নতুন যে সংকট সৃষ্টি হতে পারে, একটি ব্যবস্থার পরবর্তী ক্লাসে শিক্ষার্থীরা দু’রকম তথ্যের মুখোমুখি হবে। তারা আগের ক্লাসে যে তথ্য শিখে এসেছে, তার সঙ্গে নতুন তথ্য সাংঘর্ষিক মনে হবে। একই শিক্ষাব্যবস্থা তাদের দু’রকম তথ্য প্রদান করছে। তবে এ ক্ষেত্রে প্রশংসনীয় দিক হচ্ছে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে মওলানা ভাসানীসহ আরও বড় বড় ব্যক্তির অবদানও যুক্ত করা হয়েছে। যুক্ত করা হয়েছে ২০২৪-এর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পাঠ ও গ্রাফিতি। পাঠ্যপুস্তকের প্রতিটি বিষয় শিক্ষাক্রমের সঙ্গে সম্পর্কিত। তবে এ বিয়োজন ও সংযোজন শিক্ষাক্রমের সঙ্গে অ্যালাইনমেন্ট বা সাযুজ্য রেখে করা হয়েছে কিনা, জানা যায়নি।
পাঠ্যপুস্তকের এ প্রসঙ্গগুলো বিষয়বস্তুগত। কিন্তু শিখন শিখানো ও মূল্যায়নগত প্রসঙ্গও আলাপের অপেক্ষা রাখে।
এসব পাঠ্যপুস্তক ক্লাসে পড়ানোর জন্য শিক্ষাক্রমে ১৬৫-১৮৫টি ক্লাস রাখা আছে। পরিমার্জিত পাঠ্যপুস্তকগুলো সব ক্লাসে দেওয়া সম্ভব হয়নি। ক্লাসে পৌঁছাতে আরও কয়েক মাস লাগবে– অনুমান করা যাচ্ছে। এতে শিখন সময়ের ঘাটতি তৈরি হবে। শিশু শ্রেণি বাদে বর্তমান শিক্ষার্থীরা এমনিতেই শিখন ঘাটতিতে আছে। করোনার ঘাটতি কাটানো সম্ভব হয়নি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ২৪-এর আন্দোলনজনি ত শিখন ঘাটতি। স্কুলে শিখন পবিবেশও নষ্ট হয়েছে। বিশেষত শিক্ষার্থী-শিক্ষক সম্পর্ক। এটা স্বাভাবিক করতেও সময় লাগবে। সময় লাগবে সব শিক্ষার্থীর ক্লাসে ফিরে যেতে। ২০১২ সালের পাঠ্যপুস্তকগুলোতে সৃজনশীল মূল্যায়ন যুক্ত রয়েছে। এখন মূল্যায়ন পদ্ধতি বদলের কারণে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকরা পাঠ্যপুস্তক ব্যবহারে সমস্যার মুখোমুখি হতে পারেন। স্বল্প সময়ে শিক্ষক সংস্করণও করা সম্ভব হবে না। সর্বোপরি আগামী বছর আবার নতুন শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করা হবে; এসব পাঠ্যপুস্তকও বদলে যাবে– এ চিন্তা শিক্ষার্থী-শিক্ষক সবার মনেই অনিশ্চয়তাবোধ সৃষ্টি করবে।
শিক্ষাক্রম উন্নয়ন একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। তাই পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই যেতে হবে। তবে পরিবর্তনগুলো করতে হবে যুক্তির সঙ্গে। শিক্ষার সঙ্গে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় ইস্যুগুলো যত কম জড়ানো যায়, তত ভালো। বিশেষত অমীমাংসিত রাজনৈতিক বিষয়। ভাষা ও সাহিত্য শিক্ষার পাঠ্যপুস্তকে বিষয়বহির্ভূত বিষয়বস্তু (যাকে শিক্ষা পরিভাষায় বলা হয় ক্রস কাটিং ইস্যুজ) রাখার যুক্তি খুব সবল নয়। রাজনৈতিক বিষয়গুলো থাকবে ইতিহাস বা সমাজবিজ্ঞানের পাঠ্যপুস্তকে; ধর্মীয় বিষয়গুলো নিজ নিজ ধর্মের পাঠ্যপুস্তকে– এটাই অধিক যুক্তিযুক্ত। আর কাজগুলো সব সময় করাতে হবে অভিজ্ঞ ও পেশাদার শিক্ষাবিদ নিয়ে।
শিক্ষাক্রমের যে কোনো পরিবর্তন সাধন করতে হয় সতর্কতার সঙ্গে, ধীরে ধীরে। একসঙ্গে বড় আকারের পরিবর্তন সাধন করলে কী বিপর্যয় ও বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হতে পারে, তার প্রমাণ বিগত সরকারের মাধ্যমিক শিক্ষাক্রম পরিবর্তনের ঘটনা থেকে দেখা গেছে। এটা থেকে শিক্ষা নেওয়ার আছে।
এবারের নতুন বইগুলোর প্রকাশনার মান অপেক্ষাকৃত ভালো। কাগজ, মুদ্রণের মান– সবদিক থেকেই। এ ধারা অব্যাহত রাখতে হবে। এখন এ বইগুলো দ্রুত সব শিক্ষার্থীর হাতে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে। আসছে বছরে শিক্ষার্থীরা সঠিক সময়ে ভালো বই হাতে পাক– শিক্ষাজনের এটাই কামনা।
ড.
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
ধানমন্ডিতে মশা নিধনসহ বিশেষ পরিচ্ছন্নতা অভিযান, অংশ নিলেন ৭০০ ব্যক্তি
রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকায় মশক নিধনসহ বিশেষ পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালানো হয়েছে। একযোগে চালানো এই অভিযানে ৭০০ ব্যক্তি সক্রিয়ভাবে অংশ নেন।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) উদ্যোগ আজ শুক্রবার সকাল সাড়ে সাতটা থেকে অভিযান শুরু হয়। চলে বেলা সাড়ে ১২টা পর্যন্ত।
ডিএসসিসির জনসংযোগ বিভাগ থেকে জানানো হয়, অভিযানে সংস্থাটির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের ৪৫০ জন কর্মী ও স্বাস্থ্য বিভাগের ৫০ জন মশক কর্মী অংশ নেন। এ ছাড়া বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির ১০০ জন, বিডি ক্লিনের ৫০ জন ও ধানমন্ডি সোসাইটির ৫০ জন স্বেচ্ছাসেবক এই কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেন।
অভিযান চালানোর ক্ষেত্রে ধানমন্ডি আবাসিক এলাকাকে সাতটি জোনে ভাগ করা হয় বলে জানায় ডিএসসিসির জনসংযোগ বিভাগ। তারা বলে, এভাবে মূল রাস্তা, লেক, পার্ক, মসজিদ, ঈদগাহসংলগ্ন এলাকায় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও মশকনিধন ওষুধ প্রয়োগ করা হয়।
অভিযান চলাকালে অতিথির বক্তব্যে স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব রেজাউল মাকছুদ জাহেদী বলেন, ঢাকাকে সুন্দর ও বাসযোগ্য নগরী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য ডিএসসিসিসহ বিভিন্ন এলাকাভিত্তিক সোসাইটিগুলো আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে রাজউক, গণপূর্ত, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ), ঢাকা মহানগর পুলিশসহ অন্যান্য সংস্থার অংশগ্রহণে সরকার একটি সুপরিকল্পিত-সমন্বিত মাস্টারপ্ল্যান (মহাপরিকল্পনা) প্রণয়ন করছে। এ ছাড়া পয়োনিষ্কাশনের জন্য মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন হচ্ছে।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে ডিএসসিসির প্রশাসক শাহজাহান মিয়া বলেন, বর্ষা মৌসুমে ডেঙ্গুর প্রকোপ রোধে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রতিটি অঞ্চলে বিশেষ পরিচ্ছন্নতা ও মশকনিধন অভিযান পরিচালনা করা হবে। ধানমন্ডি থেকে এই অভিযান শুরু হয়েছে।
ডিএসসিসির প্রশাসক আরও বলেন, ব্রিটিশ আমল থেকে এ পর্যন্ত ঢাকা শহরকে নিয়ে ৩টি মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করা হয়েছে। ১৯১৭ সালে স্যার প্যাট্রিক গেডেস যে মাস্টারপ্ল্যান করেছিলেন, সেখানে বলা হয়েছিল, ঢাকা হবে একটি বাগানের শহর। কিন্তু দুঃখের বিষয় বেসরকারি হাউজিং শুরু হওয়ার পরে ঢাকা থেকে সবুজ ও জলাশয় হারিয়ে যেতে থাকল। তাঁরা ঢাকার সবুজ ফিরিয়ে আনতে এ বছর বর্ষার শুরুতেই বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি গ্রহণ করবেন।
অভিযান কার্যক্রমের অংশ হিসেবে অতিথিরা জনসচেতনতামূলক একটি র্যালিতে অংশগ্রহণ করেন। অভিযান চলাকালে ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জিল্লুর রহমান, সংস্থাটির সব বিভাগীয় প্রধান ও ধানমন্ডি সোসাইটির নেতারা উপস্থিত ছিলেন।