ভারত–পাকিস্তানের ৯ বন্দীর মরদেহ পড়ে আছে হাসপাতালের হিমঘরে
Published: 12th, January 2025 GMT
ভারত ও পাকিস্তানের ৯ বন্দীর মরদেহ দেশের তিনটি হাসপাতালের হিমঘরে ছয় মাস থেকে সাড়ে তিন বছর ধরে পড়ে আছে।
বারবার তাগাদা দেওয়া সত্ত্বেও ভারত ও পাকিস্তান নিজেদের নাগরিকদের মরদেহগুলো বুঝে নিচ্ছে না বলে জানিয়েছে কারা অধিদপ্তর। দিনের পর দিন মরদেহগুলো হিমঘরে সংরক্ষণে বাংলাদেশ সরকারের অর্থ যাচ্ছে।
কারা অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মো.
কারা অধিদপ্তর জানায়, নয়জনের মধ্যে আটজন ভারতীয়, একজন পাকিস্তানি। তাঁদের মধ্যে ছয়জনের মরদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হিমঘরে আছে। দুজনের মরদেহ আছে শরীয়তপুরের সদর হাসপাতালের হিমঘরে। আর খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হিমঘরে আছে অপর মরদেহটি।
ঢাকার হিমঘরে ছয় মরদেহকারা অধিদপ্তরের তথ্যমতে, পাকিস্তানের নাগরিক মোহাম্মদ আলী ২০২১ সালের ১৮ জুন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান। তিনি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের হেফাজতে ছিলেন। তাঁর বাবার নাম সালামত। বাড়ি পাকিস্তানের করাচি। অনুপ্রবেশের অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা থানায় মামলা হয়েছিল।
ভারতের নাগরিক ইমতাজ ওরফে ইনতাজের (৪৭) বাড়ি দেশটির উত্তর প্রদেশে। তাঁর বাবার নাম ফারুক আলী। নীলফামারী জেলায় তাঁর বিরুদ্ধে অনুপ্রবেশের অভিযোগে মামলা হয়েছিল। নীলফামারী জেলা কারাগারে থাকা অবস্থায় তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আনা হয়। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের হেফাজতে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২০২১ সালের ১৪ জুলাই তিনি মারা যান।
তারেক বাইনের বাড়ি ভারতের বিহারে। বাবার নাম মরন বাইন। ২০২১ সালের ৮ জুলাই শরীয়তপুরের জাজিরা থানায় তাঁর বিরুদ্ধে অনুপ্রবেশের অভিযোগে মামলা হয়েছিল। গোপালগঞ্জ জেলা কারাগারের হেফাজতে স্থানীয় একটি হাসপাতালে তিনি চিকিৎসাধীন ছিলেন। ২০২২ সালের ৩০ অক্টোবর তিনি মারা যান। পরে তাঁর মরদেহ গোপালগঞ্জ থেকে এনে ঢাকা মেডিকেল কলেজের হিমঘরে রাখা হয়।
ভারতের নাগরিক খোকন দাসের বাড়ি দেশটির পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে। বাবার নাম অচিন দাস। ২০২২ সালের ৩ মার্চ খোকনের বিরুদ্ধে শরীয়তপুরের জাজিরা থানায় অনুপ্রবেশের অভিযোগে মামলা হয়েছিল। তিনি শরীয়তপুর জেলা কারাগার ছিলেন। অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়। অসুস্থ হয়ে পড়লে ২০২৩ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। তাঁকে মৃত ঘোষণা করা হয়।
অশোক কুমারের বাড়ি ভারতের দিল্লি। তাঁর বাবার নাম মহেষ আগরওয়াল। অশোক নেত্রকোনা জেলা কারাগারে ছিলেন। অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়। ২০২৩ সালের ২ আগস্ট ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তাঁকে মৃত ঘোষণা করা হয়।
ভারতের নাগরিক কুনালিকার বাড়ি দেশটির ঝাড়খন্ড রাজ্যে। বাবার নাম শাম্মাদি। ২০১৮ সালে তাঁর বিরুদ্ধে লালমনিরহাটের আদিতমারী থানায় অনুপ্রবেশের অভিযোগে মামলা হয়েছিল। কুনালিকা লালমনিরহাট জেলা কারাগারে ছিলেন। অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আনা হয়। এই কারাগারের হেফাজতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। ২০২৩ সালের ২২ সেপ্টেম্বর তিনি চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
উল্লিখিত ছয়জনেরই মরদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হিমঘরে আছে।
দুই মরদেহ শরীয়তপুর সদর হাসপাতালের হিমঘরেসতেন্দ্র কুমারের বাড়ি ভারতের দিল্লি। বাবার নাম চন্দ্র পাল। অনুপ্রবেশের অভিযোগে ২০২২ সালের ৮ অক্টোবর তাঁর বিরুদ্ধে পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানায় মামলা হয়েছিল। তিনি শরীয়তপুর জেলা কারাগারে ছিলেন। অসুস্থ হলে তাঁকে শরীয়তপুর সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২০২৩ সালের ১৮ জানুয়ারি তিনি মারা যান। তাঁর মরদেহ হাসপাতালটির হিমঘরে আছে।
একই দেশের নাগরিক বাবুল সিং। অনুপ্রবেশের অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে শরীয়তপুরের জাজিরা থানায় মামলা হয়েছিল। তিনি শরীয়তপুর জেলা কারাগারে ছিলেন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২০২৩ সালের ১৫ এপ্রিল তিনি শরীয়তপুর সদর হাসপাতালে মারা যান।
খুলনা মেডিকেলের হিমঘরে এক মরদেহসুরাজ সিংহের বাড়ি ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। বাবার নাম সুদ্ধ সিং। অনুপ্রবেশের অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে ঝিনাইদহের মহেশপুর থানায় মামলা হয়েছিল। সর্বশেষ তিনি খুলনা জেলা কারাগারে ছিলেন। তিনি খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২০২৪ সালের ৭ জুলাই মারা যান।
কারা অধিদপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি, উন্নয়ন ও গণমাধ্যম) জান্নাত-উল-ফরহাদ প্রথম আলোকে বলেন, এই ৯ বিদেশি বার্ধক্যের কারণসহ অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
কারা সূত্র জানায়, বর্তমানে সারা দেশের ৬৮টি কারাগারে ৪৬৭ জন বিদেশি বন্দী আছেন। কোনো বিদেশি বন্দী মারা গেলে তাঁর লাশ হস্তান্তরের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট দেশের হাইকমিশন বা দূতাবাসকে চিঠি দেওয়া হয়। নাম–পরিচয়-ঠিকানা যাচাই করে হাইকমিশন বা দূতাবাস পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করে। কিন্তু ২০২১ সালের ১৮ জুন থেকে ২০২৪ সালের ৭ জুলাই পর্যন্ত সময়ে মারা যাওয়া আট ভারতীয় ও এক পাকিস্তানি বন্দীর মরদেহ হস্তান্তরের বিষয়টি ঝুলে আছে। এসব মরদেহ নেওয়ার জন্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বারবার দেশ দুটির হাইকমিশনে চিঠি দেওয়া হলেও সাড়া মিলছে না।
কারা অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মো. মোতাহের হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, বিধি অনুযায়ী তিন মাসের মধ্যে লাশ কোনো দেশ বুঝে না নিলে তা আঞ্জুমান মুফিদুলের মাধ্যমে দাফন বা সৎকার করা হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে মানবিক বিবেচনায় তাঁরা লাশগুলো এখনো হিমঘরে সংরক্ষণ করছেন। তবে দেশ দুটি মহদেহগুলো গ্রহণ না করলে আঞ্জুমান মফিদুল ইসলাম বা অন্য কোনো স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের মাধ্যমে দাফন-কাফন বা সৎকারের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হতে পারে।
উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
মাটি, পানি, খাবার থেকে দেহে ঢুকছে প্লাস্টিক
বড় প্লাস্টিক চোখে দেখা যায়। এ কারণে পরিবেশ ও স্বাস্থ্যগত বিপদ কেমন হতে পারে– সে ধারণা কম-বেশি সবারই জানা। তবে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণা প্রাণ-প্রকৃতিতে নীরবে বিষ ঢাললেও এর ভয়াবহতা থেকে যাচ্ছে আড়ালেই। বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণ মিলেছে– লবণ, আটা, চিনি, মাছ, মাটি, বাতাস, নদী, সমুদ্র এমনকি খাবার পানিতেও রয়েছে মাইক্রোপ্লাস্টিকের অস্তিত্ব।
গবেষকরা বলছেন, মাইক্রোপ্লাস্টিকের আকার ৫ মিলিমিটারের চেয়ে ছোট হয়। দিনের পর দিন শরীরে এই বিষ মিশতে থাকলে দেহে মরণব্যাধি বাসা বাঁধতে পারে। বিপজ্জনক মাইক্রোপ্লাস্টিক ঠেকানোর উদ্যোগ হিসেবে বিশ্বের প্রথম দেশ বাংলাদেশ ২০০২ সালে পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ করেছিল। উপকূলীয় অঞ্চলে একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকেও লাগাম টানা হয়েছে। পলিথিন আর প্লাস্টিকের বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক সময়ে দেশজুড়ে চলছে অভিযান। তবু থামছে না এর ব্যবহার। সরকার এ ব্যাপারে নানামুখী উদ্যোগ নিলেও মানুষকে এখনও সচেতন করা যায়নি।
ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ডের তথ্য অনুসারে, প্লাস্টিক দূষণের কারণে প্রতিবছর ১ লাখ সামুদ্রিক প্রাণী মারা যাচ্ছে। ২০৫০ সালে সাগরে যত মাছ থাকবে, তার চেয়ে বেশি থাকবে প্লাস্টিক। প্রতিদিন প্রায় ৭৩ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে সমুদ্রে গিয়ে পড়ছে। পরিমাণের দিক থেকে এটি বিশ্বে পঞ্চম।
সরকার-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পলিথিন ও মাইক্রোপ্লাস্টিক যে কতটা ক্ষতিকর, তা জনগণকে অনুধাবন করতে হবে। পরিবর্তন আনতে হবে মানুষের মনোজগতে। সবাই মিলে কাজ করলে প্লাস্টিকের সমস্যা থেকে উত্তরণ সম্ভব।
এ পটভূমিতে আজ মঙ্গলবার বিশ্বজুড়ে পালিত হচ্ছে ধরিত্রী দিবস। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য– ‘আমাদের শক্তি, আমাদের পৃথিবী’। এ উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠন নানা কর্মসূচি পালন করবে।
কোথায় নেই মাইক্রোপ্লাস্টিক
ময়মনসিংহের পুরোনো ব্রহ্মপুত্র নদের পানি, মাটি এবং মাছের পেটে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি পেয়েছে আন্তঃরাষ্ট্রীয় এক গবেষক দল। গত ১৯ এপ্রিল প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই নদের প্রতি বর্গকিলোমিটার পানিতে ২৫ লক্ষাধিক ভাসমান কণা এবং তলদেশে প্রতি কেজি মাটিতে সাড়ে ৪০০ কণা মাইক্রোপ্লাস্টিকের অস্তিত্ব মিলেছে। মাছের পেটেও পাওয়া গেছে মাত্রাতিরিক্ত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্লাস্টিক।
গত ২৫ মার্চ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের অর্থায়নে হবিগঞ্জ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় রিসার্চ সিস্টেম পরিচালিত গবেষণায় সেখানকার সুতাং নদের পানিতে মাইক্রোপ্লাস্টিকের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া গেছে। এমনকি হাওরের ধানেও মাইক্রোপ্লাস্টিক থাকার কথা বলছেন গবেষকরা।
গত বছরের এপ্রিলে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (যবিপ্রবি) গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের বিভাগীয় শহরে প্রতি গ্রাম ধুলায় ৫২টি, ঢাকায় প্রতি গ্রাম ধুলায় ১০৬টি মাইক্রোপ্লাস্টিক উড়ছে।
২০২৩ সালের আগস্টে নেদারল্যান্ডসের সায়েন্স অব দ্য টোটাল এনভায়রনমেন্ট সাময়িকীতে প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ও ভারতের গঙ্গা অববাহিকা অঞ্চলের পানি, পলি এবং বাতাসে মাইক্রোপ্লাস্টিকের আশঙ্কাজনক উপস্থিতি দেখা গেছে। গঙ্গা অববাহিকার নদীর প্রতি ২০ লিটার পানিতে অন্তত একটি মাইক্রোপ্লাস্টিকের কণা পাওয়া গেছে। প্রতি কিলোগ্রাম পলিতে মিলেছে ৫৭টি কণা। আর বাতাসে প্রতি বর্গমিটারে মাইক্রোপ্লাস্টিকের কণার সংখ্যা ছিল ৪১। গবেষণায় অনুমান করা হয়েছে, গঙ্গা নদী এবং এর উপনদীগুলোর মাধ্যমে প্রতিদিন ১০০ থেকে ৩০০ কোটি মাইক্রোপ্লাস্টিকের কণা বঙ্গোপসাগরে যাচ্ছে। মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপাদানের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পাওয়া গেছে রেয়ন।
২০২৩ সালের জুনে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, গত কয়েক বছরে দেশে উৎপাদিত সামুদ্রিক লবণে ক্ষতিকর মাইক্রোপ্লাস্টিকের পরিমাণ বেড়েছে। নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (নোবিপ্রবি) গবেষকরা কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের ১২টি লবণ উৎপাদনকারী স্থান থেকে সংগ্রহ করা কাঁচা লবণের প্রতি কেজিতে ৫৬০ থেকে ১ হাজার ২৫৩টি প্লাস্টিক কণা শনাক্ত করেছেন।
লবণের ওপর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল পরিবেশ বিজ্ঞানী ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে আরেকটি গবেষণা করেছেন। সেখানে বলা হয়, বাজারের সুপরিচিত ১০টি ব্র্যান্ড ও খোলাবাজার থেকে সংগৃহীত নমুনায় দেখা গেছে প্রতি কেজি লবণে রয়েছে আড়াই হাজারেরও বেশি প্লাস্টিকের কণা। এই হিসাবে দেশের একজন মানুষ প্রতি বছর গড়ে প্রায় ১৩ হাজার মাইক্রোপ্লাস্টিক খাচ্ছে।
শুধু লবণ নয়, চিনি এমনকি টি-ব্যাগেও মাইক্রোপ্লাস্টিকের অস্তিত্ব মিলেছে। ২০২২ সালের মে মাসে ‘ইজ দেয়ার টি কমপ্লিমেন্টেড উইথ দি অ্যাপেইলিং ফ্লেভার অব মাইক্রোপ্লাস্টিক? এ পায়োনিয়ারিং স্টাডি অন প্লাস্টিক পলিউশন ইন কমার্শিয়ালি এভেইলেবল টি-ব্যাগস ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক একটি গবেষণা প্রতিবেদন আন্তর্জাতিক জার্নাল ‘সায়েন্স অব দ্য টোটাল এনভায়রনমেন্টে’ প্রকাশিত হয়। চিনি ও টি-ব্যাগ নিয়ে দুটি গবেষণাতেই অংশ নেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের একদল শিক্ষক। রাজধানীর বিভিন্ন সুপারমার্কেট থেকে সংগ্রহ করা পাঁচটি ব্র্যান্ড ও দুটি নন ব্র্যান্ডের চিনির প্রতি কেজিতে গড়ে ৩৪৩.৭টি প্লাস্টিক কণা পেয়েছেন গবেষকরা। নমুনা হিসেবে ব্যবহৃত পাঁচটি ব্র্যান্ডের টি-ব্যাগেও প্লাস্টিক কণা পাওয়া গেছে।
২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের ৭৩ শতাংশ মাছে রয়েছে প্লাস্টিকের ক্ষুদ্র কণা। বাজারে পাওয়া যায় এমন দেশি মাছের ওপর গবেষণা করে জানা যায়, ১৫ প্রজাতির মাছে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি রয়েছে।
সমুদ্রের গভীরতা থেকে আর্কটিক বরফ পর্যন্ত সর্বত্র প্লাস্টিকের ঝুঁকি রয়েছে। ফলে সুন্দরবন এর ব্যতিক্রম হবে– এমনটা আশা করা যায় না। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং ব্রাজিলের তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় সুন্দরবনের মাছ নিয়ে যৌথভাবে গবেষণা করে। পশুর, রূপসা ও মোংলা নদী থেকে ২০ প্রজাতির ১৪১টি নমুনা সংগ্রহ করা হয়। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে প্রকাশিত ওই গবেষণা প্রতিবদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনের তিনটি প্রধান নদী থেকে অন্তত ১৭ প্রজাতির মাছ ও ৩ প্রজাতির সেলফিশ মাইক্রোপ্লাস্টিকে সংক্রমিত।
ঢাকার ১৩টি এলাকা, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জের বাতাসে জরিপ করে অতি ক্ষুদ্র বিষাক্ত প্লাস্টিক কণা পাওয়ার তথ্য উঠে আসে ২০২৩ ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত এক গবেষণায়।
২০২৩ সালে ঢাকা শহরের তিনটি লেকের পানি, মাটি ও মাছের মধ্যে মাইক্রোপ্লাস্টিকের দূষণ নির্ণয়ের জন্য আরেকটি গবেষণা করা হয়। এসব লেকে দূষণের মাত্রা এতটাই বেশি যে মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণ লোড সূচক অনুযায়ী এগুলো ঝুঁকিপূর্ণ স্তরে রয়েছে।
২০২৩ সালের এক গবেষণায় বেঙ্গল ডেল্টার বিভিন্ন আবাসস্থল থেকে ৯টি প্রজাতির ২৭টি ব্যাঙ সংগ্রহ করে তাদের পাচনতন্ত্রে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি পরীক্ষা করা হয়। এতে দেখা গেছে, ব্যাংগুলোর ৯০ শতাংশের পাচনতন্ত্রে মাইক্রোপ্লাস্টিক রয়েছে। ২০২৪ সালের আরেকটি গবেষণায় ভূগর্ভস্থ পানিতেও ব্যাপকভাবে মাইক্রোপ্লাস্টিকের অস্তিত্ব শনাক্ত করা হয়, যা প্রতিনিয়ত সেসব এলাকার মানুষ পান করছে।
সাম্প্রতিক বিভিন্ন গবেষণায় পশুর ও বুড়িগঙ্গা নদীর পানি, মাটি ও মাছে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি নিশ্চিত করা হয়েছে, যা জনস্বাস্থ্যের ওপর গুরুতর হুমকির ইঙ্গিত দেয়। এ ছাড়া এ বছর গবেষকরা বাণিজ্যিক খাদ্য আটার মধ্যেও মাইক্রোপ্লাস্টিকের অস্তিত্বের প্রমাণ পান, যা মানুষের খাদ্যচক্রে এ ক্ষতিকর উপাদান প্রবেশের একটি উদাহরণ।
এ ছাড়া কর্ণফুলী নদীর পানি, মাটি ও মাছে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এতে বলা হয়, একজন ব্যক্তি প্রতিবছর এ নদীর মাছ থেকে প্রায় ৪ হাজার থেকে ৭ হাজার ৬৬০টি মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা গ্রহণ করতে পারে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক।
কারা কী বলছেন
স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, আমরা দৈনন্দিন যে প্লাস্টিক ব্যবহার করি, তা ব্যবস্থাপনার আওতায় নেই। ব্যবহার্য প্লাস্টিক ফেলে দেওয়ার পর কোনো না কোনো উপায়ে শেষ পর্যন্ত নদীতে গিয়ে পড়ে। একজন মা যখন সন্তানকে বুকের দুধ পান করান, নদীর মাছ খাওয়ান, তখন এসবের সঙ্গে মাইক্রোপ্লাস্টিকও খাওয়াচ্ছেন। প্লাস্টিক দূষণ রোধে কোম্পানিগুলোরও প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ নিতে হবে। তাদের শুধু বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্বই নয়, তা যেন একটা মূল্যবোধের মাধ্যমে পরিচালিত হয়, সেটাও খেয়াল রাখতে হবে।
এদিকে, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘ডিম্বাণু-শুক্রাণুতেও মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া যাচ্ছে। আপাতদৃষ্টিতে প্লাস্টিক কম দামি মনে হলেও পরিবেশ আর স্বাস্থ্যগত দিক বিবেচনায় মোটেও সাশ্রয়ী নয়। সরকার চেষ্টা করছে, একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিকের ক্রমবর্ধমান ব্যবহার থেকে মানুষকে সরিয়ে আনতে। পলিথিন শপিং ব্যাগ বন্ধে কাজ করছি। এখন পর্যন্ত সুপারশপে সফল হলেও অন্য জায়গায় আরও কাজ করতে হবে। কারণ পলিথিনের নেতিবাচক দিকগুলো মানুষ জানে না। সেক্ষেত্রে সচেতনতা সৃষ্টি এবং আইন প্রয়োগের মাধ্যমে পলিথিন ব্যাগসহ একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক বন্ধ করার চেষ্টা করব।