বেসরকারি খাতের একাধিক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে বড় পরিবর্তন আসছে। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অনেক ব্যাংক পরিচালক গা ঢাকা দিয়েছেন, কেউ কেউ আবার বিদেশে পাড়ি দিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে অনেক ব্যাংকের চেয়ারম্যানও রয়েছেন। অনেকেই অবশ্য বিভিন্ন কৌশলে টিকে থাকার চেষ্টা করছেন। আওয়ামী লীগ–সংশ্লিষ্ট এসব পরিচালকের টানা অনুপস্থিতির কারণে বিভিন্ন ব্যাংক পর্ষদ সভা কমিয়ে এনেছে।

করোনার সময়ে বিদেশে বসে বা দেশে থেকে অনলাইনে ব্যাংকের সভায় অংশ নেওয়ার যে সুযোগ দেওয়া হয়েছিল, তা করোনা কেটে যাওয়ার পরও চালু রাখা হয়। ফলে পরিচালনা পর্ষদের পাশাপাশি নির্বাহী, নিরীক্ষা ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যরা একইভাবে সভায় অংশ নিতে পারতেন। কিন্তু সরকার পরিবর্তনের পর সে সুযোগ তুলে নেওয়া হয়। তবে আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ ও মেঘনা ব্যাংকের চেয়ারম্যান এইচ এন আশিকুর রহমানকে একটি সভায় অনলাইনে যোগ দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়।

ব্যাংক কোম্পানি আইন ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী, পরপর তিনটি সভায় বা তিন মাস কোনো পরিচালক সভায় অংশ না নিলে তাঁর পদ শূন্য হয়ে যায়। এর মধ্যে যেটি বেশি সময় হবে, সেটিই কার্যকর হয়। কিন্তু করোনার সময় এই বিধান স্থগিত করা হয়। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে বিধানটি আবার কার্যকর করা হয়েছে। ফলে সভায় অংশ না নেওয়ার কারণে অনেক পরিচালক চলতি মাসেই পদ হারাবেন বলে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিভিন্ন ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান।

এ ধরনের পরিচালকদের মধ্য রয়েছেন ডিএসসিসির সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদের স্ত্রী, সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর ভাইয়ের স্ত্রী ও চাচাতো ভাই, সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর ছেলে, সাবেক স্থানীয় সরকারমন্ত্রীর ছেলে, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফর উল্যাহর স্ত্রী।যেসব ব্যাংকে পরিবর্তন হয়েছে

বাংলাদেশ ব্যাংক আওয়ামী লীগের মেয়াদে বড় ধরনের অনিয়ম হয়েছে এমন ১১টি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পরিবর্তন করেছে। ব্যাংকগুলো হলো ইসলামী, সোশ্যাল ইসলামী, গ্লোবাল ইসলামী, ইউনিয়ন, ন্যাশনাল, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী, বাংলাদেশ কমার্স, আল-আরাফাহ্‌ ইসলামী, আইএফআইসি, এক্সিম ও ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি)। এর মধ্যে আটটিরই নিয়ন্ত্রণ ছিল সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত এস আলম গ্রুপের কাছে। এ ছাড়া একটি সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, একটি সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর পরিবার ও আরেকটি ব্যাংক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিএবির চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদারের নিয়ন্ত্রণে ছিল। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরিস্থিতিতে মার্কেন্টাইল, সিটিজেন ও সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদ ছেড়ে দেন। দেশে বেসরকারি খাতে ৪৩টি ব্যাংক রয়েছে। এর মধ্যে তিনটি ব্যাংক হলো যথাক্রমে সেনাবাহিনী, বাংলাদেশ পুলিশ ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি)। ব্যাংকগুলো প্রতি মাসে সর্বোচ্চ দুটি পর্ষদ সভা আয়োজন করতে পারে। সভায় অংশ নেওয়ার জন্য পরিচালকেরা সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা সম্মানী নিতে পারেন।

পর্ষদে ভালো লোক ছিল না বলেই ব্যাংকগুলোতে এত বড় অনিয়ম করা সম্ভব হয়েছে। এখন তাঁদের অনুপস্থিতির কারণে যদি পদ খালি হয়, তাহলে তা নিয়ম মেনে দ্রুতই পূরণ করা উচিত হবে। মোস্তফা কে মুজেরী, সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ, বাংলাদেশ ব্যাংকঝুঁকিতে যেসব ব্যাংক পরিচালক

পদ হারানোর সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছেন আওয়ামী লীগের আমলে অনুমোদন পাওয়া ও দখল হওয়া ব্যাংকের পরিচালকেরা। কারণ, এসব পরিচালকের মধ্যে শেখ পরিবারের সদস্য, সাবেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য, আওয়ামী লীগ–সমর্থিত ব্যবসায়ী ও পেশাজীবীরা এবং তাঁদের পরিবারের সদস্যরা রয়েছেন। ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বাদ পড়বেন মেঘনা ব্যাংকের পরিচালকেরা। ওই ব্যাংকের বড় নিয়ন্ত্রণ সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর পরিবারের হাতে। এ ছাড়া মধুমতি, মিডল্যান্ড, প্রিমিয়ার, যমুনা, মিউচুয়াল ট্রাস্ট, শাহজালাল ইসলামীসহ আরও অনেক ব্যাংকের পরিচালকেরা পদ হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মেঘনা ব্যাংকের চেয়ারম্যান এইচ এন আশিকুর রহমানকে সম্প্রতি অনলাইনে পর্ষদের একটি সভায় যোগ দেওয়ার সুযোগ প্রদান করা হয়। এ ছাড়া ব্যাংকটির পরিচালক ইমরানা জামান চৌধুরী অনুপস্থিত, যিনি সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর ভাই আনিসুজ্জামান চৌধুরীর স্ত্রী। অনুপস্থিত আছেন নুরান ফাতেমা, তিনি সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদের স্ত্রী। এ ছাড়া পর্ষদ সভায় অনুপস্থিত থাকা জাহারা রাসূল জেনেক্স ইনফোসিস লিমিটেডের চেয়ারম্যান আদনান ইমামের বোন। অনুপস্থিত রয়েছেন সাবেক ভূমিমন্ত্রীর চাচাতো ভাই জোনায়েদ শফিক।

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সাবেক সভাপতি মাহবুবুল আলম ইতিমধ্যে বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংকের পরিচালক পদ হারিয়েছেন। আরেক পরিচালক ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক দিলীপ কুমার আগরওয়ালা আটক হয়ে জেলহাজতে আছেন।

মিডল্যান্ড ব্যাংকের চেয়ারম্যান নিলুফার জাফরুল্লাহও নিয়মিত সভায় যাচ্ছেন না। তিনি আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফর উল্যাহর স্ত্রী।

মধুমতি ব্যাংকের পরিচালকদের মধ্যে একজন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য শেখ সালাহউদ্দিন জুয়েল, অন্যজন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। তাঁরাও পর্ষদের সভায় যাচ্ছেন না।

যমুনা ব্যাংকের সাবেক দুই চেয়ারম্যান গাজী গোলাম আশরিয়া ও সাইদুল ইসলাম আওয়ামী সরকারের পতনের পর থেকে ব্যাংকের পর্ষদ সভায় যোগ দিচ্ছেন না। তাঁরা দুজনে যথাক্রমে সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী এবং সাবেক স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী তাজুল ইসলামের ছেলে।

প্রিমিয়ার ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও সাবেক সংসদ সদস্য এইচ বি এম ইকবাল, ভাইস চেয়ারম্যান মইন ইকবাল, পরিচালক শাহ মো.

নাহিয়ান হারুনও দেশে নেই। আরেক পরিচালক সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুস সালাম মুর্শেদী আটক হয়ে এখন জেলহাজতে। মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের পরিচালক সাবেক সংসদ সদস্য ওয়াকিল উদ্দিন ও হেদায়েত উল্লাহ পর্ষদের সভায় যাচ্ছেন না। শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের পরিচালক সাবেক এমপি আনোয়ার হোসেন খানও ব্যাংকে যাচ্ছেন না। তিনি আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালের মালিক।

তবে সাবেক সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরা জড়িত থাকলেও সব ব্যাংকে ঢালাওভাবে অনিয়ম হয়েছে, তা বলা যাবে না। কারণ, কোনো কোনো ব্যাংক পেশাদারির সঙ্গে পরিচালিত হয়েছে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মোস্তফা কে মুজেরী প্রথম আলোকে বলেন, পর্ষদে ভালো লোক ছিল না বলেই ব্যাংকগুলোতে এত বড় অনিয়ম করা সম্ভব হয়েছে। এখন তাঁদের অনুপস্থিতির কারণে যদি পদ খালি হয়, তাহলে তা নিয়ম মেনে দ্রুতই পূরণ করা উচিত হবে। পাশাপাশি শূন্য পদগুলোতে পেশাদার ব্যক্তিদের স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দিতে পারে বাংলাদেশ ব্যাংক। তাহলে এসব ব্যাংকে অনিয়মের সুযোগ থাকবে না। এখনই সময় ব্যাংক খাতকে নিয়মের মধ্যে ফেরানোর।

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

সামারিক শক্তিতে মিয়ানমারের চেয়ে ২ ধাপ এগিয়ে বাংলাদেশ

চলতি বছর সামরিক শক্তির দিক থেকে মিয়ানমারের চেয়ে দুই ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ। চলতি সপ্তাহে সামরিক শক্তি পর্যবেক্ষক প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার প্রকাশিত সূচকে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

সংস্থাটি তাদের প্রতিবেদনে জানিয়েছে, এই র‌্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের সামরিক বাজেট। সেনাবাহিনীর আকার, নৌবাহিনী এবং বিমানবাহিনীর শক্তিকেও বিবেচনা করা হয়েছে সমীক্ষায়।

গ্লোবাল ফায়ারপাওয়ারের সূচক অনুযায়ী, বিশ্বে সামরিক শক্তির ক্ষেত্রে শীর্ষে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, এরপরে পরে রয়েছে রাশিয়া, চীন, ভারত ও দক্ষিণ কোরিয়া। পরমাণু শক্তিধর হলেও পাকিস্তানের অবস্থান ১২ নম্বরে। তালিকায় বাংলাদেশ রয়েছে ৩৫তম অবস্থানে। বাংলাদেশের আগে রয়েছে উত্তর কোরিয়া ও আর্জেন্টিনা। আর বাংলাদেশের প্রতিবেশী মিয়ানমার রয়েছে ৩৭তম অবস্থানে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটির বেশি। এর মধ্যে প্রায় ৬ কোটি ৬১ লাখ মানুষ সামরিক বাহিনীতে যুক্ত হওয়ার যোগ্য। বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীতে মোট সেনা সংখ্যা ১ লাখ ৬৩ হাজার। বাংলাদেশ বিমানবাহিনীতে রয়েছে ১৭ হাজার ৪০০ সদস্য এবং নৌবাহিনীতে রয়েছে ২৫ হাজার ১০০ সেনা। 

অন্যদিকে, মিয়ানমারের মোট জনসংখ্যা ৫ কোটি ৭৫ লাখ। এর মধ্যে প্রায় ২ কোটি ২০ লাখ মানুষ সামরিক বাহিনীতে যুক্ত হওয়ার যোগ্য। মিয়ানমারের সক্রিয় সৈন্য সংখ্যা ১ লাখ ৫০ হাজার। মিয়ানমারের রিজার্ভ সৈন্য রয়েছে ২০ হাজার। দেশটির বিমানবাহিনীতে রয়েছে ১৫ হাজার সদস্য এবং নৌবাহিনীতে রয়েছে ১৬ হাজার সেনা। 

ঢাকা/শাহেদ

সম্পর্কিত নিবন্ধ