বাজেটে টাকার জন্য মরিয়া হয়ে বিকল্প পথ খুঁজছে সরকার। এ জন্য শুল্ক-কর বাড়িয়ে সহজ পথে কর আদায়ের পথ বেছে নিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। গত বৃহস্পতিবার শতাধিক পণ্য ও সেবায় ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হলো। ধনী-গরিবনির্বিশেষ বাড়তি ভ্যাট আদায় করে বাজেটের ঘাটতির জোগান দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।
আবার সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার বাড়িয়ে ক্রেতা আকৃষ্ট করার উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। মুনাফার হার বাড়ালে সঞ্চয়পত্র কেনায় আরও আগ্রহী হবেন মানুষ। ব্যাংক খাতের দুর্বল পরিস্থিতির কারণে সেখান থেকে বাড়তি অর্থ ঋণ নেওয়ার মতো অবস্থা নেই। এ ছাড়া বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ (এডিবি) বিভিন্ন দাতার কাছে চলতি অর্থবছরে ১৭০ কোটি ডলার বাজেট সহায়তা পেতে চায় সরকার। এ পর্যন্ত পাওয়া গেছে মাত্র তিন ভাগের এক ভাগ অর্থ। সার্বিকভাবে অর্থের জোগান পেতে নানা পথে হাঁটছে সরকার; যা সাধারণ মানুষের ওপর চাপ বাড়াচ্ছে।
চলতি অর্থবছরে সরকারের খরচ কমেনি, বরং বেড়েছে। গত কয়েক বছরে সরকারি বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য খরচ আগের চেয়ে কয়েক গুণ বাড়িয়েছিল বিগত আওয়ামী লীগ সরকার। এবার উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার কথা ভাবছে অন্তর্বর্তী সরকার। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সন্তুষ্ট রাখতে এ বছরের সংশোধিত বাজেটে মহার্ঘ ভাতায় বরাদ্দ রাখা হবে বলে জানা গেছে।
বাজেটে টাকার প্রয়োজন আছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। অভ্যন্তরীণ খাত থেকে কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আদায় হচ্ছে না। আবার রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ও অনিশ্চয়তায় ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি কম। শুল্ক-কর বাড়ানোর আইএমএফের শর্তের চাপ সামাল দিতে পারেনি সরকার।বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি এক্সচেঞ্জ অব বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মাসরুর রিয়াজঅন্যদিকে সরকারের আয় তেমন একটা বাড়েনি। লক্ষ্য অনুসারে রাজস্ব আদায় হচ্ছে না। চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ঘাটতি সাড়ে ৪২ হাজার কোটি টাকা। বিদেশি ঋণ পরিশোধ গতবারের তুলনায় অনেক বেড়েছে। দেশি ঋণও বেড়েছে।
এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি এক্সচেঞ্জ অব বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মাসরুর রিয়াজ প্রথম আলোকে বলেন, বাজেটে টাকার প্রয়োজন আছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। অভ্যন্তরীণ খাত থেকে কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আদায় হচ্ছে না। আবার রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ও অনিশ্চয়তায় ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি কম। শুল্ক-কর বাড়ানোর আইএমএফের শর্তের চাপ সামাল দিতে পারেনি সরকার।
তারপরও কর বাড়ানোর সিদ্ধান্ত একদম সময়োপযোগী হয়নি বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, এতে মানুষের ভোগান্তি বাড়বে। কর হার বাড়িয়ে আদায় বাড়বে কি না, সন্দেহ আছে। সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার বাড়ানো হচ্ছে মূলত টাকার জন্য। বিগত সরকার আমলাদের তোষণ করতে গিয়ে বাজেটে পরিচালন খরচ অনেক বাড়িয়ে ফেলেছে। এখন আর কমানোর সুযোগ নেই।
চলতি অর্থবছরের ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৫ লাখ ৬ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা হলো পরিচালন ব্যয়। সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন–ভাতা, দেশি-বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধেই সিংহভাগ অর্থ খরচ হয়। বাকিটা উন্নয়ন বাজেটের প্রকল্পে খরচ হয়।
এবার দেখা যাক, এই বাজেটের অর্থ আসবে কীভাবে। শুল্ক-কর (এনবিআর), শুল্ক-করবহির্ভূত রাজস্ব, বিদেশি সহায়তাসহ সব মিলিয়ে ৫ লাখ ৪৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা পাওয়ার লক্ষ্য ধরা হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রাক্কলন অনুসারে, বাকি ২ লাখ ৫১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা আসবে দেশি-বিদেশি ঋণ থেকে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণ; সঞ্চয়পত্র বিক্রি করেই সাধারণত অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ নেয় সরকার।
কিন্তু চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই বাজেটের অর্থ জোগানে টান পড়ে। জুলাই-আগস্টের আন্দোলন; আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, দাবিদাওয়া নিয়ে আন্দোলনসহ নানা অনিশ্চয়তায় ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি কমে যায়। এর প্রভাব পড়ে রাজস্ব আদায়ে। প্রতি মাসেই এনবিআরের রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি বাড়তে থাকে। তাই শুল্ক-কর বাড়িয়ে বাড়তি রাজস্ব আদায়ের চেষ্টা করছে সরকার। এ ছাড়া সঞ্চয়পত্র বিক্রি বাড়িয়েও ঋণ নিতে চায় সরকার। বাজেট সহায়তার মাধ্যমে বিদেশি সংস্থার কাছে ঋণ আরও বাড়ানো হচ্ছে।
সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার বাড়ানো হচ্ছে মূলত টাকার জন্য। বিগত সরকার আমলাদের তোষণ করতে গিয়ে বাজেটে পরিচালন খরচ অনেক বাড়িয়ে ফেলেছে। এখন আর কমানোর সুযোগ নেই।আইএমএফের চাপআন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাপে চলতি অর্থবছরের মাঝপথে এক শর বেশি পণ্য ও সেবার ওপর মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট এবং সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হলো। এর ফলে দৈনন্দিন জীবনযাত্রার খরচ বেড়ে যাচ্ছে। ভ্যাট বাড়ানোর ফলে ধনী-গরিবনির্বিশেষে সবাইকে বাড়তি ভ্যাট দিতে হবে। মুঠোফোন সেবার ওপর সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধির ফলে কথা বলা ও ইন্টারনেটে খরচ বাড়বে। আবার পোশাকের দাম বাড়তে পারে। রেস্তোরাঁর খাবারের বিল বেশি আসবে।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, শতাধিক পণ্যে ভ্যাট বাড়ানোর ফলে এ বছরের বাকি ৬ মাসে ১০-১২ হাজার কোটি টাকার বাড়তি রাজস্ব আদায় হবে। এ ছাড়া মূল্যবৃদ্ধির তালিকায় আছে টিস্যু পেপার, মিষ্টি, ওষুধ, এলপি গ্যাস, ফলের রস, ড্রিংক, বিস্কুট, চশমার ফ্রেম, সিগারেট ইত্যাদি।
এনবিআরের কর্মকর্তারা বলছেন, ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের চতুর্থ কিস্তি ছাড়ের জন্য আইএমএফ শুল্ক-কর বৃদ্ধির শর্ত দিয়েছে। এ জন্য শুল্ক-কর বাড়ানো হয়।
চলতি অর্থবছরের এনবিআরকে ৪ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য দেওয়া হয়েছে। পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) আদায় হয়েছে মাত্র ১ লাখ ২৬ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা; যা পাঁচ মাসের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৪২ হাজার ২৩৮ কোটি টাকা কম।
দেশে সঞ্চয়পত্র বিক্রি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে গেছে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম তিন মাস জুলাই-সেপ্টেম্বরে বিক্রি সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা বা ৩১ শতাংশ কমেছে। গত অক্টোবর থেকে সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমার ধারা অব্যাহত আছে বলে জানা গেছে।সঞ্চয়পত্র বিক্রি বাড়ানোর চেষ্টাসঞ্চয়পত্র বিক্রি করে বেশি ঋণ নিতে মুনাফার হার বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। সঞ্চয়পত্রের ধরন অনুযায়ী এ হার বেড়ে হতে যাচ্ছে ১২ দশমিক ২৫ থেকে ১২ দশমিক ৫৫ শতাংশ পর্যন্ত।
দেশে সঞ্চয়পত্র বিক্রি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে গেছে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম তিন মাস জুলাই-সেপ্টেম্বরে বিক্রি সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা বা ৩১ শতাংশ কমেছে। গত অক্টোবর থেকে সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমার ধারা অব্যাহত আছে বলে জানা গেছে।
বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ দাতাদের কাছে ১৭০ কোটি ডলার বাজেট সহায়তা পেতে চায় সরকার। কিন্তু এখন পর্যন্ত পাওয়া গেছে মাত্র ৬০ কোটি ডলার।বিদেশি ঋণ শোধ বেশি, প্রতিশ্রুতি নেইচলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই প্রতি মাসে যত বিদেশি ঋণ ছাড় হয়েছে, এর বেশি ঋণের সুদাসল পরিশোধ করতে হয়েছে। ফলে নিট বিদেশি ঋণপ্রাপ্তি নেতিবাচক। যদিও বাজেটে আলাদা বরাদ্দ থেকে অর্থাৎ খরচ খাত থেকে বিদেশি ঋণ পরিশোধ করা হয়।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্রে জানা গেছে, গত জুলাই-নভেম্বর সময়ে ১৫৪ কোটি ডলার বিদেশি ঋণ এসেছে। আর সরকারকে ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছে ১৭১ কোটি ডলার।
রাজস্ব আদায় সন্তোষজনক না হওয়ায় বাজেটে অর্থের জোগান বাড়াতে এবং রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে বিদেশি ঋণের ভরসা রাখতে হচ্ছে। ইতিমধ্যে বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ দাতাদের কাছে ১৭০ কোটি ডলার বাজেট সহায়তা পেতে চায় সরকার। কিন্তু এখন পর্যন্ত পাওয়া গেছে মাত্র ৬০ কোটি ডলার।
এদিকে এডিপির প্রকল্প সহায়তা হিসেবে বিদেশি সংস্থা ও দেশের কাছে ঋণ সহায়তার প্রতিশ্রুতিও মিলছে না। জুলাই-নভেম্বরে মাত্র ৫২ কোটি ডলারের প্রতিশ্রুতি মিলেছে; যা গত অর্থবছরের একই সময়ের ১০ ভাগের ১ ভাগের সমান।
খরচ কমাতে যা করছে সরকারমোটা দাগে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন–ভাতা, দেশ-বিদেশি ঋণ পরিশোধ খাতের বাজেটে বরাদ্দ কমানোর সুযোগ নেই। তাই অতীতের মতো উন্নয়ন প্রকল্পে খরচ কমানোকেই প্রাধান্য দিচ্ছে সরকার। ২ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকার এডিপিতে বরাদ্দ কমতে পারে ৩০-৩৫ হাজার কোটি টাকা। শুধু বিদেশি সহায়তাই কমবে ২৫ হাজার কোটি টাকা।
এ ছাড়া জুলাই গণ-অভ্যুত্থান এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে চলতি অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়ন পরিস্থিতি বেশ খারাপ। গত জুলাই-নভেম্বর সময়ে এডিপি বাস্তবায়ন হার (১২ শতাংশ) গত পাঁচ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম।
উন্নয়ন প্রকল্পে লাগাম টানা হলে এর প্রভাব পড়বে অর্থনীতিতে। বাজেটের অর্থ খরচ কম হলেও তা অর্থনীতিকে টেনে ধরে রাখবে। চার-পাঁচ মাস ধরে অর্থনীতি এমনিতেই শ্লথ। গত জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ৮১ শতাংশ। অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির এত সংকোচন কোভিডের সময়ও হয়নি।
বাজেটের অর্থ ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে বেশ কিছু পরামর্শ দেন পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান মাসরুর রিয়াজ। তিনি বলেন, দাতাদের কাছ থেকে বেশি পরিমাণ বাজেট সহায়তা ছাড় করা উচিত। প্রকল্পের বিদেশি ঋণ দ্রুত ছাড় করতে হবে। এ ছাড়া সরকারি অর্থের অপচয় ও অযথা খরচ কমানোর উদ্যোগ নিতে হবে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন–ভাতাসহ পরিচালন খরচের খাত অন্তত দুই বছর বাড়তে না দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
স্বাস্থ্যে গবেষণা কাজে আসছে না, আছে অনিয়মের অভিযোগ
স্বাস্থ্য খাতে সরকারি গবেষণা নিয়ে নানা ধরনের প্রশ্ন উঠেছে। গবেষণা কাজের অনেকগুলোই দেওয়া হয়েছে পছন্দের ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে। বেশ কিছু কাজ ঠিকঠাক সম্পন্নও হয়নি। ফলে সরকারের টাকা নষ্ট হয়েছে, কিন্তু এসব গবেষণার কোনো সুফল মানুষ পায়নি।
অন্তত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগনিয়ন্ত্রণ শাখা (এনসিডিসি) ও রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার (সিডিসি) গত আট বছরের করা বেশ কয়েকটি গবেষণা ও জরিপের ক্ষেত্রে এমন চিত্র দেখা গেছে।
প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, অধিদপ্তরের গুরুত্বপূর্ণ এ দুটি শাখার অধীনে করা এসব গবেষণা ও জরিপের অনেকগুলোর ক্ষেত্রেই স্বজনপ্রীতি, আর্থিক অনিয়ম, গবেষণা প্রতিবেদন জমা না দেওয়া, গবেষণাপত্র যথাযথভাবে সংরক্ষণ না করাসহ নানা অসংগতি রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা তথ্য দিতে গড়িমসি করেছেন। তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করে গত বছরের জুলাই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে চলতি বছরের এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত বারবার যোগাযোগ করেও তাঁদের কাছ থেকে পূর্ণাঙ্গ তথ্য পাওয়া যায়নি। কেউ কেউ বিভ্রান্তিকর তথ্যও দিয়েছেন।
তবু তাঁদের দেওয়া তথ্যেই এসবের আলামত দেখা যাচ্ছে। আরেকটি সমস্যা, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ছাড়া ঢাকার বাইরের কোনো প্রতিষ্ঠানকে গবেষণাকাজ দেওয়া হয়নি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে দল বা গোষ্ঠীস্বার্থ না দেখে নিরপেক্ষভাবে প্রতিষ্ঠান ও গবেষকদের কাজ দিতে হবে এবং ঢাকার বাইরের প্রতিষ্ঠানের কথাও মাথায় রাখতে হবে। অধ্যাপক সায়েবা আক্তার সদস্য, স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনএনসিডিসি জানিয়েছে, ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত সাড়ে আট বছরে তারা ৫১টি গবেষণা ও ৬৯টি সার্ভে বা জরিপ করেছে। এই মোট ১২০টি কাজে খরচ হয়েছে ৯১ কোটি ২১ লাখ টাকা। গবেষণার জন্য প্রতিবছর গড়ে খরচ করা হয়েছে ১১ কোটি টাকার মতো।
আর সিডিসির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত ৭ বছরে তারা ১৫টি গবেষণাকাজ শেষ করেছে। তবে এ কাজে ব্যয়ের হিসাব দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে তারা। জরিপের বিষয়ে কোনো তথ্যই দেয়নি। তবে হিসাব মহানিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ের নিরীক্ষা (অডিট) প্রতিবেদনগুলো থেকে কিছু বরাদ্দের তথ্য পাওয়া গেছে।
যেসব বিষয়ে গবেষণা ও জরিপ হয়েছে, সেগুলো হলো ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, ক্যানসার রোগীর নিবন্ধন, শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহ, অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি, আর্সেনিকজনিত রোগ, থ্যালাসেমিয়া, মানসিক স্বাস্থ্য, প্রশমনসেবা, বায়ু ও শব্দদূষণ, কিডনির রোগ, সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসায় অ্যান্টিভেনম তৈরি, সড়ক দুর্ঘটনা ও পানিতে ডোবা মানুষের চিকিৎসা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক মো. আবু জাফর প্রথম আলোকে বলেন, এসব গবেষণার সময় তিনি এই পদে ছিলেন না। তবে অভিযোগগুলো তিনি তদন্ত করবেন।
গবেষণা প্রতিবেদন লাপাত্তাগোদ রোগ নির্মূল এবং মাটিবাহিত কৃমি (এসটিএইচ) নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির আওতায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে একটি জরিপের জন্য প্রায় ৬০ লাখ টাকা দিয়েছিল সিডিসি। এই জরিপের কোনো প্রতিবেদন জমা পড়েনি। ২০২৪ সালের শুরুর দিকে হিসাব মহানিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, জরিপের এই মূল্য পরিশোধ করা হয়েছে জরিপ প্রতিবেদন ছাড়াই।
গত ৩ মার্চ প্রথম আলো সিডিসির লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক মো. হালিমুর রশিদকে এ অনিয়মের অভিযোগ জানায়। এক মাস পর ৭ এপ্রিল তাঁর সঙ্গে দেখা করেন এই প্রতিবেদক। তিনি বলেন, এসব যখন ঘটেছে, তখন তিনি পরিচালক ছিলেন না। এরপর তিনি তাঁর কার্যালয়ের অন্য একজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। তবে সেই কর্মকর্তা কথা বলতে চাননি।
২০২২-২৩ অর্থবছরে অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা–বিষয়ক একটি প্রকল্পে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তৎকালীন পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজমুল হক ও সহকারী পরিচালক মো. আশরাফুল আলমকে ৩০ লাখ টাকা দেয় সিডিসি। হিসাব মহানিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ের নিরীক্ষা প্রতিবেদন এ কাজে অডিট আপত্তি জানিয়ে বেশ কিছু অনিয়ম চিহ্নিত করেছে।
যেমন একক প্রতিষ্ঠান বাছাই পদ্ধতিতে কাজটি সরাসরি দেওয়া হয়েছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকে। এ গবেষণায় বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিলের (বিএমআরসি) নীতিগত অনুমোদন ছিল না। ৫১টি হাসপাতালকে নমুনা হিসেবে নেওয়ার কথা ছিল, নেওয়া হয়নি। নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, পুরো জরিপ প্রতিবেদন প্রশ্নবিদ্ধ এবং কাজটিতে সরকারি টাকার অপচয় হয়েছে।
৮ এপ্রিল কথা হয় ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজমুল হক ও সহকারী পরিচালক মো. আশরাফুল আলমের সঙ্গে। দুজনই বলেন, অডিট আপত্তির বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর তাঁদের কোনো কিছুই জানায়নি।
নাজমুল হক যশোরে বদলি হয়ে গেছেন। মুঠোফোনে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা প্রটোকল অনুযায়ী গবেষণা করেছেন। সিডিসি কখনো আপত্তি তোলেনি। আর আশরাফুল আলম বলেন, তাঁরা ঢাকা মেডিকেল কলেজের নিজস্ব কমিটি থেকে নীতিগত অনুমোদন নিয়েছেন বলে বিএমআরসির অনুমোদনের দরকার হয়নি। গবেষণায় কয়টি হাসপাতাল অন্তর্ভুক্ত করার কথা ছিল, তা তাঁর মনে নেই। তাঁরা গবেষণায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, নারায়ণগঞ্জ জেলা হাসপাতাল ও মেঘনা উপজেলা হাসপাতালকে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন।
তবে আশরাফুল আলমের কাছ থেকে গবেষণা প্রস্তাব ও গবেষণা প্রতিবেদন পাওয়া যায়নি। ২০২২-২৩ সালে সিডিসির লাইন ডিরেক্টর ছিলেন অধ্যাপক নাজমুল ইসলাম। মুঠোফোনে বারবার চেষ্টা করেও এই প্রতিবেদক তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেননি।
টাকাগুলো সব গেল কইগত ২৭ জানুয়ারি এনসিডিসি আট বছরে করা তাদের মোট ১২০টি গবেষণা ও জরিপের তালিকা প্রথম আলোকে দেয়। লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক জাকির হোসেনের সই করা তালিকাটিতে গবেষণা বা জরিপের শিরোনাম, সাল, প্রতিষ্ঠানের নাম, কত টাকার চুক্তি—সেসব স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা আছে। এগুলোর মধ্যে ৮২টি গবেষণা বা জরিপের প্রধান গবেষকের (প্রিন্সিপাল ইনভেস্টিগেটর বা পিআই) নাম ও সংক্ষিপ্ত পরিচিতিও রয়েছে।
অধ্যাপক জাকির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, চুক্তি অনুযায়ী প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। তবে দুটি প্রতিষ্ঠান বলছে, তারা চুক্তি মোতাবেক টাকা পায়নি; কম পেয়েছে।
এ দুটি প্রতিষ্ঠানের একটি সিএমইডি হেলথ। প্রতিষ্ঠানটি মূলত প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটিকে প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি নির্ণয়ের জন্য গবেষণা করতে দেয় এনসিডিসি। এ জন্য ৪০ লাখ টাকার চুক্তি করা হয়। তবে করোনা অতিমারি শুরু হওয়ায় গবেষণা শেষ হয়নি।
সিএমইডি হেলথের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান অধ্যাপক খন্দকার এ মামুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘এনসিডিসির পক্ষ থেকে আমাদের কাজ বন্ধ রাখতে বলা হয়েছিল। আমরা যেটুকু কাজ করেছিলাম, সে জন্য ১৫ লাখ ১৯ হাজার ১২১ টাকার একটি চেক দেওয়া হয়।’
একই অর্থবছরে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের সামাজিক যোগাযোগ, আবেগজনিত বিকাশ এবং শিশুযত্নের ওপর গবেষণা করার জন্য সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশের (সিআইপিআরবি) সঙ্গে এনসিডিসি চার কোটি টাকার চুক্তি সই করে। এটিও করোনা মহামারির কারণে শেষ হয়নি।
এনসিডিসি বলছে, তারা চার কোটি টাকাই সিআইপিআরবিকে দিয়েছে। তবে সিআইপিআরবি প্রথম আলোকে বলেছে, তারা পেয়েছে ৪৪ লাখ ৪৬ হাজার ২৮৭ টাকার একটি চেক। সিএমইডি হেলথ ও সিআইপিআরবি এ-সংক্রান্ত নথি প্রথম আলোকে দিয়েছে।
ওই সময় এনসিডিসির লাইন ডিরেক্টর ছিলেন অধ্যাপক মোহাম্মদ রোবেদ আমিন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, কোনো প্রতিষ্ঠানকে চুক্তির কম টাকা দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। ভ্যাট-ট্যাক্স কেটে রেখে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে চুক্তি অনুযায়ী টাকা দেওয়া হয়েছে।
আমরা আর মামুরা বৃত্তান্তবেসরকারি প্রতিষ্ঠান এমিনেন্স ২২ বছর ধরে স্বাস্থ্য খাতে কাজ করছে। প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শামীম হায়দার তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা একাধিকবার গবেষণার জন্য সিডিসি ও এনসিডিসিতে প্রস্তাব জমা দিয়েছেন। সরকারের অন্য প্রতিষ্ঠান থেকে গবেষণাকাজ পেলেও সিডিসি ও এনসিডিসি থেকে একটি কাজও তাঁরা পাননি। তাঁর অভিযোগ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে একটি গোষ্ঠী গবেষণাকাজ ও অর্থ নিয়ন্ত্রণ করে।
একই অভিযোগ করেন ক্যানসার বিশেষজ্ঞ ডা. মো. হাবিবুল্লাহ তালুকদার। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ২০২১ সালে প্রতিষ্ঠানভিত্তিক ক্যানসার রেজিস্ট্রি-সংক্রান্ত একটি গবেষণার জন্য তিনি দরপত্র জমা দিতে পারেননি। কারণ, নির্দিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি যেন কাজটি পান, সেভাবেই গবেষণার শর্ত তৈরি করা হয়েছিল।
কাগজপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, শর্ত ছিল গবেষণা কর্মসূচির পরিচালককে বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরিরত সহযোগী অধ্যাপক বা অধ্যাপক হতে হবে এবং প্রধান গবেষককে বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরিরত সহযোগী বা সহকারী অধ্যাপক হতে হবে। কাজটি পেয়েছিলেন বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (তৎকালীন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) একজন সহযোগী অধ্যাপক।
ডা. হাবিবুল্লাহ তালুকদার জাতীয় ক্যানসার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে প্রায় দুই যুগ কাজ করেছেন। তাঁর দাবি, আওয়ামী লীগ আমলে নানা বৈষম্যের শিকার হয়েছেন তিনি এবং অবসরের বয়স হওয়ার আগেই ২০২৪ সালের শুরুতে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়েছেন।
ডা. হাবিবুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন ক্যানসার নিয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানে প্রশাসনিক কাজ, রোগী দেখা ও গবেষণা করার পরও আমি কাজটি করার জন্য প্রস্তাবই জমা দিতে পারিনি।’
এনসিডিসির দেওয়া ১২০টি গবেষণা ও জরিপের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, মোট ৩৭টি প্রতিষ্ঠান কাজগুলো পেয়েছে। সবচেয়ে বেশি কাজ পেয়েছে সিআইপিআরবি, ১২টি। বাংলাদেশে ডায়াবেটিক সমিতি ও তার অঙ্গ সংস্থাগুলো পেয়েছে ১০টি কাজ। আইসিডিডিআরবি ও জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের চিকিৎসকেরা ৯টি করে গবেষণাকাজ পেয়েছেন। বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (সাবেক বিএসএমএমইউ) পেয়েছে ৮টি।
এ ছাড়া সাতটি করে গবেষণাকাজ পেয়েছে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও সিআরআইএল নামের একটি প্রতিষ্ঠান। এরপর দুটি প্রতিষ্ঠান পেয়েছে চারটি করে, তিনটি প্রতিষ্ঠান তিনটি করে এবং আটটি প্রতিষ্ঠান দুটি করে। বাদ বাকি ১৮টি প্রতিষ্ঠান গবেষণাকাজ পেয়েছে ১টি করে।
এনসিডিসি ও সিডিসি থেকে পাওয়া তালিকা পর্যালোচনায় দেখা যায়, তৎকালীন ক্ষমতাসীন প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সংস্পর্শে থাকা গবেষকেরা বা প্রতিষ্ঠান বেশি কাজ পেয়েছে। কাজ পেয়েছিলেন বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন উপাচার্যসহ আওয়ামীপন্থী হিসেবে পরিচিত বেশ কয়েকজন শিক্ষক।
যেমন একটি গবেষণার ক্ষেত্রে প্রধান গবেষক হিসেবে দুজনের নাম উল্লেখ আছে। সূচনা ফাউন্ডেশনের সায়মা ওয়াজেদ হোসেন ও সিআইপিআরবির অধ্যাপক সায়দুর রহমান মাশরেকি। সায়মা জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মেয়ে।
নথি ঘেঁটে দেখা যায়, সূচনা ফাউন্ডেশনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল এমন গবেষকেরা, আওয়ামী লীগ-সমর্থিত চিকিৎসকদের সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সদস্য বা নেতা এবং ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের রাজনীতি করতেন—এমন ব্যক্তিরা বারবার কাজ পেয়েছেন। বিএনপি বা জামায়াতে ইসলামীর সমর্থক বা সমর্থক হিসেবে পরিচিত কোনো চিকিৎসক বা গবেষক কাজ পাননি।
যিনি দাতা, তিনিই গ্রহীতাগবেষণার ক্ষেত্রে ‘কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট’ বা স্বার্থের দ্বন্দ্ব গুরুতর প্রশ্নের জন্ম দেয়। তহবিল বরাদ্দদাতা নিজেই যদি সেই গবেষণায় যুক্ত হন, তা হলে প্রশ্ন ওঠে তিনি নিজের স্বার্থে বরাদ্দটি দিয়েছেন কি না।
গবেষণার তালিকা দেখাচ্ছে, এনসিডিসি বা সিডিসির কাজ পেয়েছে মূলত ঢাকার প্রতিষ্ঠানগুলো। একমাত্র ব্যতিক্রম চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ। এ মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগ সাপ ও সাপের বিষ (ভেনম) নিয়ে গবেষণা করে। প্রতিষ্ঠানটি সাতটি গবেষণা কাজ পেয়েছে।
অধ্যাপক মোহাম্মদ রোবেদ আমিন এনসিডিসির লাইন ডিরেক্টর থাকার সময় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেনম রিসার্চ সেন্টারকে গবেষণার জন্য একাধিকবার অর্থ বরাদ্দ দিয়েছেন। পরবর্তী সময়ে প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধে অন্য গবেষকদের সঙ্গে তাঁর নামও ছাপা হয়েছে।
রোবেদ আমিন অবশ্য প্রথম আলোকে বলেন, তিনি গবেষণায় যুক্ত হননি। তবে গবেষণা প্রবন্ধ লেখার ক্ষেত্রে তিনি সহায়তা করেছেন, লিখেছেন। তাঁর মতে, গবেষক হিসেবে এটা করতে কোনো বাধা নেই। ভিন্ন প্রসঙ্গে রোবেদ আমিন বলেন, অন্য রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসী চিকিৎসকেরা আবেদন করেননি বলেই অর্থ বরাদ্দ পাননি।
চাই জবাবদিহিগবেষণার ফলাফল কাজে লাগানোর কোনো পরিকল্পনা বা ব্যবস্থা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে নেই। অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, শুধু দুই বছর গবেষণা ফলাফল আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়েছে।
প্রথম আলোর হাতে ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রকাশনাগুলো এসেছে। এর মধ্যে রয়েছে ৭২ পৃষ্ঠার একটি বই। সেখানে ওই অর্থবছরে করা ১৭টি গবেষণার সংক্ষিপ্তসার ও মূল ফলাফল ছাপা হয়। এগুলোর ইনফোগ্রাফিকস নিয়ে ৭২ পৃষ্ঠার আরেকটি প্রকাশনা হয়। আবার এগুলোরই নির্বাহী সারসংক্ষেপ নিয়ে ৩৩ পৃষ্ঠার পুস্তিকা ছাপা হয়।
একই বিষয়ে তিনটি আলাদা প্রকাশনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন মূলত প্রভাবশালী দুজন উপ-কর্মসূচি পরিচালক (ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার বা ডিপিএম)। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে ব্যাপক রদবদল হলেও তাঁরা একই পদে আছেন।
৭ এপ্রিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে এনসিডিসির কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে লাইব্রেরি নেই। গবেষণাপত্রগুলো এক জায়গায় সংরক্ষণেরও কোনো ব্যবস্থা নেই। একজন কর্মকর্তা দেখালেন, ২০২৩-২৪ সালের গবেষণাপত্রগুলো তাঁর আলমারির মধ্যে রয়েছে। দেখা গেল, বারান্দায় টয়লেটের কাছে বস্তায় ভরে অনেকগুলো গবেষণাপত্র রাখা।
একই দিনে সিডিসি কার্যালয়ে গিয়ে শোনা গেল, গবেষণাপত্রগুলো এক জায়গায় নেই। লাইন ডিরেক্টর বললেন, সেগুলো বিভিন্ন কর্মকর্তার দপ্তরে আছে।
এসব গবেষণার কোনো প্রবন্ধ দেশে বা দেশের বাইরের কোনো সাময়িকীতে ছাপা হয়েছে কি না, তা কেউ জানেন না বা জানার উপায় নেই। অন্যদিকে সরকার এসব গবেষণার ভিত্তিতে স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে কিছু করেছে কি না, তা-ও জানে না অধিদপ্তর।
২০০৯ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ও বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল (বিএমআরসি) যৌথভাবে জাতীয় স্বাস্থ্য গবেষণা কৌশলপত্র তৈরি করেছিল। সেখানে গবেষক, ব্যবস্থাপক ও নীতিনির্ধারকদের জবাবদিহি নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে।
স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের সদস্য ও বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিলের (বিএমআরসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক সায়েবা আক্তার বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে দল বা গোষ্ঠীস্বার্থ না দেখে নিরপেক্ষভাবে প্রতিষ্ঠান ও গবেষকদের কাজ দিতে হবে এবং ঢাকার বাইরের প্রতিষ্ঠানের কথাও মাথায় রাখতে হবে। তিনি মনে করেন, এসব গবেষণা যত্নের সঙ্গে সংরক্ষণ করতে হবে। পাশাপাশি গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে যে এসব গবেষণা দেশ বা মানুষের কতটুকু কাজে লাগছে। প্রতিটি ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা জরুরি।