কালোবাজারে লঞ্চের কেবিন, ডেকে তোশক বিছিয়ে টাকা আদায়
Published: 12th, January 2025 GMT
পদ্মা সেতু চালুর পর যাত্রী–সংকটে ঢাকা-বরিশাল নৌপথে লঞ্চ কমানোর উদ্যোগ নেয় লঞ্চমালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল (যাপ) সংস্থা। প্রতিদিন চারটি লঞ্চের স্থলে সিন্ডিকেট করে প্রথমে তিনটি ও পরে দুটি লঞ্চ চলাচলের উদ্যোগ নেয়। এতে যাত্রীদের মধ্যে কেবিনের চাহিদা বাড়ে। এ সুযোগে সক্রিয় হয়ে ওঠে টিকিট কালোবাজারি চক্র। বর্তমানে চক্রের দৌরাত্ম্যে লঞ্চের কেবিন যেন সোনার হরিণে পরিণত হয়েছে।
যাত্রীদের অভিযোগ, কালোবাজারি চক্র ঢাকা ও বরিশাল দুই প্রান্তে আগে-ভাগে সব টিকিট বুকিং করে রাখে। লঞ্চ ছাড়ার দিন কিংবা আগের দিন বুকিং অফিসে গিয়ে টিকিট পাওয়া যায় না। সরাসরি লঞ্চে গেলেও কর্মচারীরা টিকিট নেই বলে যাত্রীদের ফিরিয়ে দেন। কিন্তু কালোবাজারে সেই টিকিট দ্বিগুণ বা তারও বেশি দামে পাওয়া যায়। শুধু কেবিন নয়; ডেকে তোশক বিছিয়ে যাত্রীদের থেকে অতিরিক্ত ২০০ থেকে ৩০০ টাকা আদায় করছে চক্রটি।
যাত্রীদের ভাষ্য, কালোবাজারি সিন্ডিকেটের এমন দৌরাত্ম্য শুরু হয় গত বছরের নভেম্বর থেকে। এখন চক্রটি আরও বেশি সক্রিয়।
গত বৃহস্পতিবার ঢাকা থেকে বরিশালে আসতে লঞ্চের কেবিন বুকিং দিতে যান বেসরকারি চাকরিজীবী আদিলুর রহমান। তাঁরা তিন বন্ধু কুয়াকাটায় যাওয়ার জন্য লঞ্চে বরিশাল আসতে চেয়েছিলেন। তাঁরা ২ হাজার টাকা ভাড়ার একটি ডাবল এবং এক হাজারের একটি সিঙ্গেল কেবিন বুকিং দিতে যান। কিন্তু সুন্দরবন-১৬ লঞ্চের কোনো টিকিট পাননি। পরে কালোবাজারি চক্রের এক সদস্য ডাবল কেবিন ৪ হাজার এবং সিঙ্গেল কেবিন ২ হাজার টাকা ভাড়া দিলে দেওয়া যাবে বলে জানান। আদিলুর প্রথম আলোকে বলেন, কালোবাজারে কেবিনের ভাড়া দ্বিগুণ হওয়ায় তাঁরা পরে বাসে কুয়াকাটায় গিয়েছেন।
হারুন অর রশিদ নামের আরেক যাত্রী শুক্রবার ঢাকায় যেতে একই লঞ্চে একটি সিঙ্গেল কেবিনের জন্য ঘুরেও টিকিট পাননি বলে অভিযোগ করেন।
সুন্দরবন-১৬ লঞ্চের পরিদর্শক সিরাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের ঢাকা থেকে বরিশালের টিকিট দুদিন আগেই সব বুকিং হয়ে গিয়েছিল।’ কিন্তু কালোবাজারে টিকিট কীভাবে গেল—প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘এটা আমরা বলতে পারব না।’
পদ্মা সেতু চালুর আগে প্রতিদিন ঢাকা থেকে অন্তত ৫০ হাজার মানুষ লঞ্চে বরিশালসহ উপকূলীয় বিভিন্ন জেলায় যেতেন। সেতু চালুর এক বছর পর এ সংখ্যা ১৭ হাজার কমে ৩৩ হাজার হয়েছিল। এ হিসাবে ঢাকার লঞ্চযাত্রী কমেছিল ৩৪ শতাংশ। ২০২৩ সালের ২৪ আগস্ট শিপিং অ্যান্ড কমিউনিকেশন রিপোর্টার্স ফোরামের (এসসিআরএফ) এক প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রকাশ করা হয়েছিল।
এসসিআরএফ জানায়, আগে ঢাকা থেকে নৌপথে বিভিন্ন গন্তব্যে যাওয়া ৫০ হাজার মানুষের মধ্যে ৭০ শতাংশ ছিল বরিশাল, পটুয়াখালী, ভোলা, বরগুনা, পিরোজপুর ও ঝালকাঠিগামী লঞ্চের যাত্রী। পদ্মা সেতু চালুর পর এসব জেলার উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষ সড়কপথে যাতায়াত করেন। এ জন্য নৌপথে যাত্রী ও লঞ্চ—দুটোই কমেছে।
গত শুক্রবার সন্ধ্যায় বরিশাল নদীবন্দরে গিয়ে দেখা যায়, সুন্দরবন ১৫ ও ১৬ লঞ্চ বরিশাল বন্দর থেকে ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে যায়। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় দেখা যায়, দুটি লঞ্চেই ডেকে তোশক বিছিয়ে রাখা। লঞ্চের কর্মচারীরা প্রতিজনের ৩০০ টাকা ভাড়াসহ তোশক ৫০০ টাকায় বিক্রি করছেন। অনেক যাত্রী অতিরিক্ত ভাড়ার কারণে বসার স্থান পাচ্ছিলেন না। অনেকের হাতে চাদর থাকলেও তা বিছানোর জায়গা পাচ্ছিলেন না।
আবদুর রহমান নামের এক যাত্রী বলেন, ‘টাকা ছাড়া এখন ডেকেও জায়গা পাওন যায় না। এ কেমন নিয়ম!’ তিনি বলেন, লঞ্চের ডেকে তোশক বিছিয়ে যাত্রীদের থেকে ভাড়ার বাইরে অতিরিক্ত ২০০ থেকে ৩০০ টাকা করে আদায় করা হচ্ছে। তাই ডেকে বসার জায়গা না পেয়ে অনেকে বাধ্য হয়ে অতিরিক্ত টাকা দিয়ে জায়গা কিনছেন।
আল আমিন নামের আরেক যাত্রী জানান, গত ২৭ ডিসেম্বর তিনি দুটি কেবিনের জন্য দুই দিন আগে যোগাযোগ করেন। কিন্তু কোনো কেবিন পাননি। বাধ্য হয়ে তাঁদের ডেকে যেতে হয়েছে।
কেবিন ফাঁকা, তবু যাত্রীরা কেবিন চাইতে গেলে কেবিন ফাঁকা নেই বলে কালোবাজারে বিক্রি করা হচ্ছে। শুক্রবার সন্ধ্যায় সুন্দরবন-১৬ লঞ্চে.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
এক সময়ের বনদস্যুর ‘বয়ানে’ সুন্দরবনে দস্যুতার দিনগুলো
সুন্দরবনে দস্যুতায় টাকা ছিল। কিন্তু সে অবৈধ টাকা নিজেরা উপভোগ করতে পারতেন না। বনের মধ্যে সব সময় মৃত্যুঝুঁকি তাড়িয়ে বেড়াত, এক ঘণ্টা শান্তির ঘুমও হতো না। মোটেও সুখ ছিল না। দস্যুতার জগতে গিয়ে নিজের প্রাপ্তি বলতে নামের সঙ্গে জুড়ে গেছে ডাকাত শব্দটি। স্ত্রী-সন্তানদেরও চলতে হতো মাথা নিচু করে। কথাগুলো একসময়ের বনদস্যু আল-আমীনের।
আল-আমীন বলেন, দস্যুতা ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে তিনি ভালোই আছেন। আর কখনো ওই অন্ধকার পথে পা বাড়াতে চান না তিনি। সম্প্রতি তাঁর সঙ্গে দেখা হয় কয়রা উপজেলার সুন্দরবনঘেঁষা খোড়লকাঠি বাজারসংলগ্ন কয়রা নদীর তীরে। ছোট বাজারটিকে সুন্দরবন থেকে আলাদা করেছে পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া কয়রা নদী।
নদীর ওপারের সুন্দরবনের ত্রাস ছিলেন আল-আমীন। তিনি বলেন, তখন শরীফ বাহিনী ছিল বড় দস্যুদল। সেই দলে যোগ দিয়ে ডাকাত হয়েছিলেন। কিছুদিনের মধ্যে এলাকায় নাম ছড়িয়ে গেলে বাড়ি ফেরার পথ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। তাঁরা সুন্দরবনের মধ্যে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে বনজীবীদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করতেন। র্যাব আর কোস্টগার্ডের অভিযানের ভয়ে বনের মধ্যে প্রতিটি মুহূর্ত ভয় আর উৎকণ্ঠায় কাটত তাঁদের।
আল-আমীনের বলতে থাকেন, ধীরে ধীরে ছোট হয়ে আসছিল তাঁর গণ্ডি। বাড়ি ফেরার জন্য মনটা ব্যাকুল হয়ে উঠত। অপরাধের জগৎ ছেড়ে ভালো হতে চাইতেন, তবে সুযোগ পাচ্ছিলেন না। ২০১৮ সালের শেষের দিকে সুযোগ আসে। আত্মসমর্পণের মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফেরেন। দস্যুনেতা শরীফ না চাইলেও তাঁকে কৌশলে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করা হয়েছিল। তাঁরা দলের ১৭ জন সদস্য ১৭টি অস্ত্র আর ২ হাজার ৫০০ গুলিসহ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন।
দস্যুজীবন যাঁরা একবার দেখেছেন, তাঁরা না খেয়ে থাকলেও আর দস্যুতায় ফিরতে চান না—এমনটাই দাবি আল-আমীনের। নদীর তীরে দাঁড়িয়ে গল্প গল্পে তিনি বলেন, ডাঙায় থাকা মাছ ব্যবসায়ীরা ডাকাতদের বাজার, বন্দুক, গুলি সবই সাপ্লাই দিতেন। সব জিনিসের দাম নিতেন তিন থেকে চার গুণ বেশি।
বন বিভাগ ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ থেকে ২০১৮ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ধাপে ধাপে সুন্দরবন অঞ্চলের ৩২টি দস্যু বাহিনীর ৩২৮ জন দস্যু ৪৬২টি অস্ত্র, ২২ হাজার ৫০৪টি গোলাবারুদসহ আত্মসমর্পণ করেছিলেন। পরে ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর সব শেষ দস্যুদল হিসেবে আত্মসমর্পণ করে শরীফ বাহিনী। সেদিনই প্রাণবৈচিত্র্যে ভরা সুন্দরবনকে ‘দস্যুমুক্ত’ ঘোষণা করা হয়। তবে দস্যুনেতা শরীফ গত বছরের ৫ আগস্টের পর আবার সুন্দরবনে দস্যুতায় নেমেছেন বলে তাঁর একসময়ের সাথীদের ভাষ্য।
সুন্দরবন দস্যুমুক্ত করার কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সাংবাদিক মোহসীন-উল হাকিম। তিনি বলেন, দলনেতা শরীফের পুরো নাম করিম শরীফ। কয়রার আল-আমীন ছিল বাহিনীর সর্বকনিষ্ঠ সদস্য। শরীফ প্রথমে আত্মসমর্পণে রাজি থাকলেও পরে বেঁকে বসেন। অন্যরা আত্মসমর্পণ করেন। তবে শরীফ এখন পুনরায় সুন্দরবনে দস্যুতায় নেমেছেন।
কয়রা কপোতাক্ষ মহাবিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক অধ্যাপক আ ব ম আবদুল মালেক বলেন, বনের নিরাপত্তায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা কমে আসায় সুন্দরবনে আবারও দস্যুদের উৎপাত বেড়েছে। এভাবে দস্যুতা চলতে থাকলে বনজীবীদের জীবিকা, সুন্দরবন থেকে রাজস্ব আদায় ও পর্যটন হুমকির মুখে পড়বে; বিপন্ন হবে বন্য প্রাণী আর প্রাণবৈচিত্র্য। দস্যুতা দমনে প্রশাসনকে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার অনুরোধ করেন তিনি।