নাটোরের সিংড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসা কর্মকর্তা মিলি আকতার ও অফিস সহকারী সালমা খাতুনের প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেছে উপজেলা বিএনপি। শনিবার দুপুরে সিংড়া গোডাউনপাড়ায় উপজেলা বিএনপির কার্যালয়ে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন উপজেলা বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ও কলম ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক চেয়ারম্যান ইব্রাহিম খলিল। এ সময় উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক শাহাদত হোসেন, পৌর বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সাখাওয়াত হোসেন, বিএনপি নেতা সাইদুর রহমান, উপজেলা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক আতাউল গনি, উপজেলা ছাত্রদলের সদস্যসচিব উৎপল কুমার প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলেও বিভিন্ন দপ্তরে এখনো ফ্যাসিবাদের দোসররা ঘাপটি মেরে আছে। সিংড়ার ইটালী ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি সোহাগ মোল্লার নেতৃত্বে ইউনিয়ন ছাত্রদলের সদস্যসচিব জাকারিয়া হোসেনের জমির ধান কেটে নেওয়ার ঘটনায় থানায় অভিযোগ দেওয়ার পরও কোনো পদক্ষেপ নেয়নি পুলিশ। উল্টো ছাত্রদল নেতার বাবা কৃষক আবু বক্কর সিদ্দিক ও ইটালী ইউনিয়ন যুবদলের সহসভাপতি শামীম হোসেনকে পিটিয়ে হাত ভেঙে দেয় যুবলীগ নেতা সোহাগ মোল্লা ও তাঁর বাহিনী।

বিএনপি নেতাদের অভিযোগ, গুরুতর আহত কৃষক ও যুবদল নেতাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তির জন্য নিলে যুবলীগ নেতা সোহাগ মোল্লার বোন ও হাসপাতালের কর্মচারী সালমা খাতুনের সহায়তায় কর্তব্যরত চিকিৎসক মিলি আকতার তড়িঘড়ি করে তাঁদের দুজনের ভাঙা হাত প্লাস্টার করে অসুস্থ অবস্থায় বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। এ ঘটনায় চিকিৎসক মিলি আকতার ও কর্মচারী সালমা খাতুনকে দ্রুত প্রত্যাহার ও অভিযুক্ত যুবলীগ নেতা সোহাগ মোল্লাকে গ্রেপ্তারের দাবি জানান বিএনপির নেতারা।

তবে অভিযুক্ত চিকিৎসা কর্মকর্তা মিলি আকতার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমি আবু বক্কর সিদ্দিক ও শামীম হোসেনকে যথাযথ চিকিৎসাই দিয়েছি। তাঁদের প্রথমে ইনজেকশন দিয়েছি। এরপর এক্স-রে করিয়ে হাতের আঙুল ভাঙা পাওয়া যায়। তখন তাঁদের হাত প্লাস্টার করে বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছি। কারণ, হাসপাতালে তাঁদের থাকার প্রয়োজন ছিল না। এ ছাড়া হাসপাতালে শয্যার অভাব ছিল। সংবাদ সম্মেলনে তাঁদের করা অভিযোগ ভিত্তিহীন।’

এর আগে গতকাল শুক্রবার সকালে জমিজমাসংক্রান্ত বিরোধের জেরে উপজেলার ইটালী ইউনিয়ন যুবদলের সহসভাপতি শামীম হোসেন ও কৃষক আবু বক্কর সিদ্দিকের হাত ভেঙে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে ইউনিয়ন যুবলীগ সভাপতি সোহাগ মোল্লার বিরুদ্ধে। পরে তাঁদের উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়। ওই ঘটনায় চিকিৎসক ও কর্মচারীর বিরুদ্ধে তাঁদের ভর্তি না করানোর অভিযোগ ওঠে।

আজ সংবাদ সম্মেলনে যুবদল নেতা শামীম হোসেন বলেন, তাঁকে বেধড়ক পিটিয়ে হাত ভেঙে দেওয়া হয়। খুব অসুস্থতাবোধ করছিলেন। হাসপাতালে ভর্তি হতে চাইলে তড়িঘড়ি করে হাত প্লাস্টার করে অসুস্থ অবস্থায় বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

অভিযোগের বিষয়ে যুবলীগ নেতা সোহাগ মোল্লা বলেন, ‘বিরোধপূর্ণ জমিতে জোর করে ধান লাগানো নিয়ে ধাক্কাধাক্কির ঘটনা ঘটে। হাত ভেঙে দেওয়ার অভিযোগ সঠিক না।’

উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, কোনো রোগীর সঙ্গে এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সিংড়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) রফিকুল ইসলাম বলেন, জমি নিয়ে বিরোধে দুই পক্ষের সংঘর্ষ হয়। তবে কেউ অভিযোগ দিয়েছে কি না তাঁর জানা নেই।

.

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমবে

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস আগের চেয়ে কমিয়েছে বিশ্বব্যাংক। আন্তর্জাতিক সংস্থাটির অনুমান, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির প্রবৃদ্ধি হবে মাত্র ৩ দশমিক ৩০ শতাংশ। তাদের এ পূর্বাভাস যা গত বছরের অক্টোবর এবং চলতি বছরের জানুয়ারির বেশ কম।

আগের দুই পূর্বাভাসে বলা হয়, বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি যথাক্রমে ৪ শতাংশ এবং ৪ দশমিক ১০ শতাংশ হতে পারে। তবে আগামী অর্থবছর প্রবৃদ্ধি বেড়ে ৪ দশমিক ৯০ শতাংশে উন্নীত হবে বলে অনুমান করছে সংস্থাটি। এটিও আগের পূর্বাভাস থেকে কম। 

অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস কমানোর পেছনে দেশের রাজনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তাকে অন্যতম কারণ বলে উল্লেখ করেছে বিশ্বব্যাংক। সর্বশেষ পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে গতকাল প্রকাশিত সাউথ এশিয়া ডেভেলপমেন্ট আপডেটে। এই প্রতিবেদনে বাংলাদেশের পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর ওপর পর্যালোচনা ও পূর্বাভাস রয়েছে। গত জানুয়ারিতে বিশ্বব্যাংক ‘গ্লোবাল ইকোনমিক প্রসপেক্টস’ রিপোর্টে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি কম হওয়ার অনুমানের পেছনে মূলত গত জুলাই-আগস্টে গণঅভ্যুত্থানে অর্থনৈতিক কার্যক্রম বিঘ্নিত হওয়াকে মূল কারণ উল্লেখ করা হয়। 

বিশ্বব্যাংকের রিপোর্টে রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্সে উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক দিক বলে মন্তব্য করা হয়েছে। বলা হয়েছে, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স আনুষ্ঠানিক চ্যানেলের মাধ্যমে আসা বেড়েছে। এর কারণ, হুন্ডি কমা এবং ব্যাংকের সঙ্গে খোলাবাজারে বৈদেশিক মুদ্রার দরের পার্থক্য কমে যাওয়া। 

গত আগস্টে পতনের মাত্র দুই মাস আগে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার চলতি অর্থবছরের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ ধরে সংসদে জাতীয় বাজেট পাস করেছিল। ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ৫ দশমিক ৫০ শতাংশ নির্ধারণ করে। গত মঙ্গলবার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক’ শিরোনামে প্রকাশিত তথ্যে পূর্বাভাসে জানিয়েছিল, বাংলাদেশে চলতি অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৩ দশমিক ৭৬ শতাংশ হতে পারে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে। রাজস্ব সংস্কার, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং আর্থিক খাতের সংস্কার না হলে প্রবৃদ্ধির গতি আরও মন্থর হতে পারে। বিশ্বব্যাংক বলছে, এই সংকট কাটিয়ে উঠতে সাহসী ও লক্ষ্যভিত্তিক সংস্কার উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার পাশাপাশি আর্থিক খাতের দুর্বলতা বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি কমিয়ে দেবে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে নতুন বিনিয়োগ কম হতে পারে। এর আগে ২০২৪ সালের মাঝামাঝি সরকারবিরোধী আন্দোলন এবং একই বছরের আগস্টে রাজনৈতিক পরিবর্তনের কারণে অর্থনৈতিক কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি, টাকার অবমূল্যায়ন এবং জ্বালানির দাম বৃদ্ধিও ভোক্তাদের ওপর চাপ বাড়িয়েছে। যার প্রভাব শেষ পর্যন্ত অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির গতিকে কমিয়েছে।

মূল্যস্ফীতি ও আর্থিক খাত প্রসঙ্গ 

বিশ্বব্যাংকের গতকালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির গড় হার এখন পর্যন্ত ৯ দশমিক ৩০ শতাংশে রয়েছে। যদিও ২০২৪ সালের জুলাইয়ে তা ১১ দশমিক ৭০ শতাংশে পৌঁছে ছিল, যা ভোক্তাদের ব্যয় সক্ষমতা কমিয়েছে। এর ফলে দেশের ভোগব্যয় ও অভ্যন্তরীণ চাহিদা কমেছে। যদিও রপ্তানিতে কিছুটা প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি রেমিট্যান্স প্রবাহ অনেকটাই বৃদ্ধি অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে সহায়তা করলেও অর্থনীতির চাকাকে বেগবান করতে যথেষ্ট ভূমিকা রাখতে পারেনি।

প্রবৃদ্ধিতে আর্থিক খাত যথেষ্ট সহায়তা করতে পারছে না জানিয়ে বিশ্বব্যাংক আরও বলছে, বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদের হার বাড়ালেও তা কার্যকরভাবে আর্থিক খাতে পৌঁছায়নি। ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতা, বিশেষ করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর উচ্চ অনাদায়ী ঋণ অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি তৈরি করছে। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ, সরকারকে কয়েকটি ব্যাংককে নগদ সহায়তা দিতে হয়েছে।

বিশ্বব্যাংক মনে করে, অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে কাঙ্ক্ষিত ফল আনতে না পারার একটি বড় কারণ নির্ধারিত মুদ্রা বিনিময় হার থেকে পুরোপুরি বাজার নির্ধারিত বিনিময় হারে যাওয়ার কার্যক্রম বিলম্বিত হওয়া। অর্থনীতি ব্যবস্থাপনায় এই ধীরগতি আন্তর্জাতিক আস্থাকে ক্ষুণ্ণ করছে। ব্যাংক খাতের দুর্বলতা বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। 

রাজস্ব ঘাটতি ও কর নীতি

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনের বিষয়বস্তু ছিল কর বা রাজস্ব। এতে বলা হয়, বাংলাদেশের মতো দক্ষিণ এশিয়ার বেশির ভাগ দেশে কর হার তুলনামূলক বেশি হলেও রাজস্ব আদায় কম। ২০১৯-২৩ সালে দক্ষিণ এশিয়ায় গড় সরকার রাজস্ব ছিল জিডিপির মাত্র ১৮ শতাংশ, যেখানে অন্যান্য উন্নয়নশীল অঞ্চলে তা ২৪ শতাংশ। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে রাজস্ব আদায়ের হার এখনও কম। বাংলাদেশে রাজস্ব আদায়ের হার সম্ভাব্য জিডিপির তুলনায় অনেক কম, যা আর্থিক সংকট কমাতে বড় বাধা হয়ে আছে।

বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের চিফ ইকোনমিস্ট ফ্রান্সিসকা ওহনসরগ বলেন, রাজস্ব আদায়ের দুর্বলতা দক্ষিণ এশিয়ার আর্থিক ভঙ্গুরতার মূল কারণ। করের হার তুলনামূলকভাবে বেশি হলেও কর আদায় দুর্বল। এর ফলে যারা কর দেন, তাদের ওপর করের বোঝা বেশি পড়ে। অথচ সরকার জনগণের মৌলিক চাহিদা মেটাতে পর্যাপ্ত অর্থ পায় না।

দক্ষিণ এশিয়ার পরিস্থিতি 

শুধু বাংলাদেশ নয়, দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাসও কমিয়েছে বিশ্বব্যাংক। দক্ষিণ এশিয়ায় মোট প্রবৃদ্ধি ২০২৪ সালে ছিল ৬ শতাংশ। ২০২৫ সালে তা কমে ৫ দশমিক ৮০ শতাংশে নামবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ অঞ্চলের মধ্যে ভুটান, ভারত, নেপাল স্বাভাবিক গতিতে ফিরে এলেও বাংলাদেশ, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কা এখনও অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চাপে রয়েছে বলে জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক। 

সম্পর্কিত নিবন্ধ