অস্পষ্টতা ও উদ্বেগ আমলে নিয়ে সবার সঙ্গে আলোচনার তাগিদ
Published: 11th, January 2025 GMT
গণ–অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের পাঁচ মাস পার হলেও আইসিটি আইন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও সাইবার নিরাপত্তা আইনে হওয়া হয়রানিমূলক মামলাগুলো বাতিল হয়নি। সরকার মামলা বাতিলের প্রতিশ্রুতি দিলেও এখন পর্যন্ত তা বাস্তবায়িত হয়নি। এমন অবস্থায় ভুক্তভোগীরা মামলা বাতিলসহ, রাষ্ট্রের ক্ষমা চাওয়া এবং ভুক্তভোগীদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। পাশাপাশি সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশের খসড়া নিয়ে যে অস্পষ্টতা ও উদ্বেগ আছে, তা আমলে নিয়ে সবার সঙ্গে আলোচনা করে চূড়ান্ত করার আহ্বান জানিয়েছেন তাঁরা।
রাজধানীর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে ‘সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ ২০২৪: রাষ্ট্রীয় নিবর্তনব্যবস্থা বহাল ও ভুক্তভোগীদের বয়ান’ শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তারা এ কথা বলেন। ভয়েস ফর রিফর্ম ও ডিএসএ ভিক্টিম নেটওয়ার্ক আজ শনিবার এ আলোচনা সভার আয়োজন করে। হয়রানিমূলক এসব মামলায় গ্রেপ্তার কয়েকজন সেখানে তাঁদের বক্তব্য তুলে ধরেন।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নেওয়া শিক্ষা পাঠ্যক্রম নিয়ে সমালোচনা করায় তিন মাসের বেশি সময় জেল খেটেছিলেন বলে উল্লেখ করেন ভুক্তভোগী মোহাম্মদ আল আমিন হোসেন। তিনি বলেন, তাঁর সঙ্গে আরও কয়েকজন গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। যাঁদের ফেসবুকের নিয়ন্ত্রণ পুলিশ নিয়ে নেয় এবং বিভিন্ন পোস্টও দেয়। তিনি বলেন, যারা এগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছে, হয়রানি করছে, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না।
বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার হওয়ার কথা জানিয়ে আরেক ভুক্তভোগী ইশরাত জাহান বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২ বছর ৭ মাস কারাবাসের পরও তিনি জানেন না পুলিশ তাঁকে কেন গ্রেপ্তার করেছিল। তাঁর বিরুদ্ধে পুলিশ কোনো অভিযোগই বের করতে পারেনি।
সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশে গোঁজামিল আছে উল্লেখ করে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান কামাল আহমেদ বলেন, এখানে সুরক্ষার কথা বলা হয়েছে, তা স্পষ্ট নয়। কোনো কিছুর ব্যাখ্যা না থাকলে তখন আইনের অপব্যবহার হবে। তিনি আরও বলেন, আইনের খসড়া করা হয়েছে সবার মতামত নেওয়া হয়নি। যেসব উদ্বেগ উঠে আসছে, সেগুলো আমলে নিয়ে সরকার তা পুনর্লিখন করবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
ভুক্তভোগীদের প্রসঙ্গে কামাল আহমেদ বলেন, যাঁরা জেল খেটেছেন, তাঁদের ক্ষতিপূরণ পাওয়ার অধিকার আছে। রাষ্ট্রকে এ জন্য ক্ষমা চাইতে হবে। এটা কেন হচ্ছে না, সে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, এগুলো করতে খুব বড় সময় লাগার কথা নয়। একটা সাধারণ ঘোষণার মাধ্যমে সরকার দুঃখ প্রকাশ করে ক্ষতিপূরণের সিদ্ধান্তের কথা জানাতে পারে।
ভয়েস ফর রিফর্মের সহ–আহ্বায়ক মানবাধিকারকর্মী ও আলোকচিত্রী শহিদুল আলম বলেন, আইন করার ক্ষেত্রে মানবাধিকার ও জনগণের স্বার্থের লেন্স ব্যবহার করা হয়নি। নিপীড়ন কীভাবে করা যায়, সেই লেন্স দিয়ে করা হয়েছে। পুলিশকে অনেক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। বর্তমান সরকারের উদ্দেশে তিনি বলেন, জনগণের লেন্স দিয়ে না দেখে ফ্যাসিবাদের লেন্স দিয়ে দেখলে এবং আইন তৈরি করা হলে বলতে হবে সত্যিকারের স্বাধীনতা আসেনি।
আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী রেজাউর রহমান বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের সহায়ক ছিল আইসিটি আইন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও সাইবার নিরাপত্তা আইন। নতুন সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশেও বর্তমান সরকার সেই মানবতাবিরোধী অপরাধের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে চাচ্ছে কি না, সেটা একটা প্রশ্ন।
সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশের খসড়া করার প্রক্রিয়া অস্পষ্ট জানিয়ে রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের অর্থনৈতিক সমন্বয়ক দিদারুল ভূঁইয়া বলেন, এটা গণ–অভ্যুত্থানের স্পিরিটের (চেতনার) সঙ্গে প্রতারণা। এটাকে বরদাশত করা হবে না। কথা বলার জন্য ফৌজদারি মামলা কেন হবে, সে প্রশ্ন তোলেন তিনি।
ডিএসএ ভিক্টিম নেটওয়ার্কের আহ্বায়ক গোলাম মাহফুজ জোয়ার্দার বলেন, সাইবার সুরক্ষার খসড়াতেও সন্দেহকে প্রাধান্য দিয়ে কাউকে গ্রেপ্তারের বিধান রয়েছে। প্রমাণ ছাড়া এভাবে কাউকে তুলে নেওয়ার ক্ষমতা থাকতে পারে না। তিনি হয়রানিমূলক মামলাগুলো দ্রুত বাতিল করে ক্ষতিপূরণের দাবি জানান।
অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন ভয়েস ফর রিফর্মে সহ–আহ্বায়ক ফাহিম মাশরুর। তিনি বলেন, এই সরকারের সময়ে এ ধরনের কালাকানুন প্রত্যাশিত নয়। অজামিনযোগ্য ধারা রাখা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি।
আলোচনা সভায় বক্তব্য দেন সাংবাদিক ও ই-আরকি সম্পাদক সিমু নাসের, সাংবাদিক সালিম সামাদ, মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ, অধিকারকর্মী তৃষিয়া নাশতারান প্রমুখ।
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
বোঝার উপর শাকের আঁটি
বাংলাদেশ যখন ১২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা লইয়া হিমশিম খাইতেছে, তখনই নূতন করিয়া আরও অনুপ্রবেশ আমাদের উদ্বেগকে বৃদ্ধি করিয়াছে। সোমবার সমকালে প্রকাশিত শীর্ষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য হইতে গত শনিবার পর্যন্ত নূতন করিয়া ১ লক্ষ ১৩ সহস্র রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করিয়াছে। শুধু উহাই নহে; বাংলাদেশ ও জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশন যৌথভাবে নবাগত রোহিঙ্গাদের আঙ্গুলের ছাপও গ্রহণ করিয়াছে। সরকার অবশ্য তাহাদের আইরিশের মাধ্যমে পরিচয় শনাক্তের অনুমতি এখনও দেয় নাই। নবাগত রোহিঙ্গাদের আবাসস্থলের ব্যবস্থা করিতে হাইকমিশন প্রেরিত পত্রেরও উত্তর দেয় নাই। উপরন্তু, মৌখিকভাবে সংস্থাটিকে জানাইয়া দিয়াছে, বিদ্যমান বাস্তবতায় লক্ষাধিক নূতন রোহিঙ্গার জন্য আবাসস্থলের ব্যবস্থা সুকঠিন। তবে ২০১৭ সালে যেই মানবিক কারণে বাংলাদেশ মিয়ানমার জান্তার ভয়ংকর নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞের প্রেক্ষাপটে আশ্রয়প্রার্থী রোহিঙ্গাদের সীমান্ত অতিক্রম করিতে অনুমতি দিয়াছিল, সেই মানবিকতা এইবারও বৃহৎ দোহাই হইয়া উঠিতে পারে। ফলস্বরূপ, রোহিঙ্গাদের লইয়া বাংলাদেশ নূতন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়িতে যাইতেছে।
বিপুলসংখ্যক নূতন রোহিঙ্গা এমন সময়ে অনুপ্রবেশ করিল যখন ইতোপূর্বে আগত রোহিঙ্গাদের স্বীয় দেশে প্রত্যাবাসন লইয়া বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহিত দেনদরবার চালাইতেছে। এই আশঙ্কা অমূলক নহে, নূতন আবাসস্থল নির্মাণের মাধ্যমে কার্যত প্রত্যাবাসনের পরিবর্তে আরও অধিক সংখ্যক রোহিঙ্গাকে এই দেশে স্বাগত জানানো হইবে। কারণ ইহাতে রাখাইনে অবস্থানকারী অপরাপর রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আসিতে উৎসাহ পাইবে। পরিণামে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া আরও জটিল হইয়া পড়িবে। প্রসংগত, রাখাইন রাজ্যে স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় প্রত্যাশী আরাকান আর্মির অব্যাহত আক্রমণের মুখে মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় জান্তা সরকার পশ্চাদপসরণ করিলেও রোহিঙ্গারা শান্তিতে নাই। বরং সংখ্যাগুরু বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর প্রাধান্য বিস্তারে অঙ্গীকারবদ্ধ আরাকান আর্মির আচরণে অতিষ্ঠ হইয়া নূতনভাবে বাংলাদেশে পালাইয়া আসিতেছে। এখন প্রায় প্রতিদিন শুধু নাফ নদ পারই নহে, পাহাড়ি পথেও রোহিঙ্গারা প্রবেশ করিতেছে।
আমরা জানি, যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্প প্রশাসন ক্ষমতা গ্রহণের পর হইতে রোহিঙ্গাদের জন্য বরাদ্দ সংকট দেখা দিতেছে। যৌথ সাড়াদান কর্মসূচির আওতায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কক্সবাজারে আশ্রয় গ্রহণকারী রোহিঙ্গা ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জন্য যেই আর্থিক সহায়তা দেয়, তাহা প্রতি বৎসর প্রতিশ্রুতির তুলনায় ক্রমহ্রাসমান। এই বাস্তবতায় নূতনভাবে রোহিঙ্গা প্রবেশ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে চাপ সৃষ্টি করিতেছে।
স্মরণযোগ্য, দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত বাংলাদেশের রোহিঙ্গাদের জন্য অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়ের সামর্থ্য নাই। বোঝার উপর হইতে শাকের আঁটি অপসারণের বিকল্প নাই। আশ্রিত জনগোষ্ঠীর কারণে বিশেষত পরিবেশ-প্রতিবেশগতভাবে স্পর্শকাতর কক্সবাজার ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের নাজুকতা কী মাত্রায় বৃদ্ধি পাইয়াছে, তাহাও এখন অজানা নহে। সামাজিক-সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক কারণে স্থানীয় বাসিন্দাদের সহিত রোহিঙ্গাদের বিবিধ প্রকার সংঘাতমূলক ঘটনাও ঘটিতেছে। এই কথাও সর্বজনবিদিত, আশ্রয় শিবিরগুলি মিয়ানমার হইতে পাচারকৃত মাদক কারবারিদের আখড়ায় পরিণত হইয়াছে। কক্সবাজারের শিবিরগুলিতে মিয়ানমারভিত্তিক সশস্ত্র সংগঠনের সমাজবিরোধী তৎপরতার কারণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটিতেছে। পাশাপাশি রাখাইন রাজ্যের বিস্তীর্ণ এলাকার নিয়ন্ত্রণ সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মির হস্তে যাইবার পর হইতে সীমান্ত নিরাপত্তাও ভঙ্গুর হইয়া পড়িয়াছে। এই অবস্থায় একটা দেশের জাতীয় নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়া স্বাভাবিক। বাস্তবে সেই আশঙ্কাই ক্রমশ দৃঢ় হইতেছে।
আমরা মনে করি, সময় সমাগত বাংলাদেশ সরকারের রোহিঙ্গা প্রশ্নে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করিবার। যত চাপই থাকুক; মানবিকতা প্রদর্শন করিতে গিয়া কোনোক্রমেই রাষ্ট্রের সংহতি ও নিরাপত্তাকে লঘু করিয়া দেখা যাইবে না। বরং রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে আন্তর্জাতিক মহলের উপর চাপ বৃদ্ধির কৌশল অন্বেষণ করিতে হইবে।