৩৫ বছর ধরে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর গয়নাগাটি সংগ্রহ করে চলেছেন প্রবাল দে
Published: 11th, January 2025 GMT
তখন সপ্তম কি অষ্টম শ্রেণিতে পড়েন প্রবাল দে। পত্রপত্রিকায় যুক্তরাষ্ট্রের হিপিদের খবরাখবর পড়ে তাদের পোশাক-পরিচ্ছদের প্রতি আগ্রহ জন্মাল। ১৯৬৯-৭০ সালের সেই সময়ে মাত্রই তাঁর সংগ্রাহকজীবন শুরু হয়েছে। তাই হিপিদের জিনস প্যান্ট, টি-শার্ট, লকেট দেওয়া গলার চেইন ইত্যাদি তাঁর কিশোর মনে দাগ কেটে যায়। কিন্তু চট্টগ্রামে বসে দূরদেশের হিপিদের পোশাক-পরিচ্ছদ আর অলংকার হাতে পাওয়া তো সহজ নয়। তবে তিনি হাল ছাড়লেন না। অনেক কষ্ট করে একদিন সংগ্রহও করে বসলেন হিপি পুরুষের প্যান্টের সঙ্গে লাগানো দুটি চেইন। যে চেইনের সঙ্গে হিপিরা চাবি লাগিয়ে রাখে। প্রবাল দের আনন্দ আর ধরে না। কিন্তু চেইন তো পাওয়া গেল কিন্তু অন্যান্য বস্তু পাবেন কী করে?
সদ্য কৈশোরে পা দেওয়া প্রবাল তখন বিদেশ থেকে আসা পুরোনো কাপড়ের দোকানে হানা দিলেন। ধীরে ধীরে সেসব দোকান থেকে সংগ্রহ করলেন পোশাকের সঙ্গে থাকা বিভিন্ন গয়না, কোটপিন, লকেট ইত্যাদি। হিপিদের পোশাক-পরিচ্ছদ, গয়নাগাটির পাশাপাশি তাঁর সংগ্রহে ধীরে ধীরে যুক্ত হতে থাকল ধাতব মুদ্রা, অ্যান্টিকসহ বিচিত্র সব বস্তু। এভাবেই নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর গয়নার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠলেন প্রবাল দে।
৩৫ বছরের সংগ্রহ
পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে–ছিটিয়ে রয়েছে, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষেরা। তাঁদের ভাষা, ধর্ম, সামাজিক রীতিনীতিসহ পোশাক-পরিচ্ছদ ও অলংকারেও রয়েছে নিজস্বতা। ৩৫ বছর ধরে এসব সংগ্রহ করে চলেছেন প্রবাল। তাঁর সংগ্রহের বড় একটি অংশ আবার ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর গয়নাগাটি। বর্তমানে তাঁর সংগ্রহে ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায়ের যেসব গয়না রয়েছে, তার বেশির ভাগই রুপার তৈরি। অন্যান্য ধাতুর মধ্যে আছে টিন ও তামা।
ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর গয়নায় একসময় রৌপ্যমুদ্রা খুব ব্যবহৃত হতো, বিশেষ করে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের রাজা পঞ্চম ও ষষ্ঠ জর্জের আমলে প্রচলিত বিভিন্ন মুদ্রা। রৌপ্যমুদ্রার মূল্যমানের তারতম্যের ভিত্তিতে গয়নাগুলোর বাজারমূল্যেও দেখা যেত ভিন্নতা। এক রুপির মুদ্রায় গড়া গয়নার দাম ছিল বেশি। প্রবাল দের সংগ্রহে মুদ্রা দিয়ে বানানো এ রকম বেশ কয়েকটি গয়না রয়েছে।
বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর নারীরা গলায়, কানে, নাকে, হাতে, পায়ে ভিন্ন ভিন্ন গয়না পরে থাকেন। অঞ্চলভেদে একই গয়না ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচয় পেয়েছে, যেমন নারীদের গলায় পরা নেকলেস কোথাও হাঁসুলি, কোথাও আবার চাম্বেল নামে পরিচিত। কয়েকটি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীতে নারীদের পাশাপাশি পুরুষদের মধ্যেও গয়না পরার চল আছে। প্রবাল দের সংগ্রহে পুরুষদের ব্যবহৃত তেমন কিছু গয়নাও আছে, মুরং পুরুষেরা এগুলো পরে থাকেন।
এসব গয়না সংগ্রহ করার জন্য বাংলাদেশের নানা প্রান্ত চষে বেড়িয়েছেন প্রবাল। তবে জন্মস্থান চট্টগ্রাম হওয়ায় একটা সুবিধা হয়েছে, হাতের কাছেই পেয়েছেন অনেক জাতিগোষ্ঠীর সান্নিধ্য। কিন্তু কেউ তো আর এমনি এমনি গলার গয়না খুলে তার হাতে গুঁজে দেবে না, তার জন্য দিতে হবে টাকা। অনেক সময় টাকার পরিমাণ হতো তার সাধ্যের বাইরে। অর্থাভাবে কিনতে না–পারা তেমন কিছু গয়নার কথা ভেবে এখনো দীর্ঘশ্বাস ফেলেন তিনি।
ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর গয়না ছাড়াও এ অঞ্চলের প্রাচীন ও মধ্যযুগের ধাতব মুদ্রা সংগ্রহের নেশাও প্রবাল দের তীব্র। মুদ্রার পাশাপাশি বিভিন্ন পুরোনো বস্তু দিয়ে তাঁর চট্টগ্রামের বাসাটিকে বিশাল এক সংগ্রহশালায় পরিণত করেছেন প্রবাল, যেসব বস্তুর ঐতিহাসিক মূল্য অপরিসীম।
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
মাইক্রোবাসে গান বাজাতে বাজাতে প্রকৌশলীকে হত্যা
হা-মীম গ্রুপের ‘দ্যাটস ইট স্পোর্টস ওয়্যার’ লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) আহসান উল্লাহকে হত্যার লোমহর্ষক তথ্য উঠে আসছে। ব্যক্তিগত মাইক্রোবাসে উচ্চ শব্দে গান শুনতে শুনতে প্রথমে তাঁর ওপর নির্যাতন চালানো হয়। হাত-পা বাধা বেঁধে আহসানকে গাড়ির পেছনের অংশে নিয়ে শুইয়ে রাখা হয়েছিল। এরপর পা দিয়ে বুক ও শরীরের নানা অংশে আঘাত করা হয়। একপর্যায়ে গলায় গামছা পেঁচিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে খুনিরা। পরে টেনেহিঁচড়ে গাড়ি থেকে নামিয়ে লাশ গুম করে। নিহতের পিঠ ছিল ক্ষতবিক্ষত। মাইক্রোবাসের ভেতরকার চিৎকার ও গোঙানির শব্দ যাতে বাইরে না পৌঁছে এ জন্য চার ঘণ্টা উচ্চ শব্দে গান ছেড়ে রাখা হয়। আদালতে আসামির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
২৩ মার্চ হত্যার শিকার হন হা-মীমের ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইঞ্জিনিয়ার আহসান। আশুলিয়ার কর্মস্থল থেকে ব্যক্তিগত গাড়িতে ঢাকার বাসায় ফিরছিলেন তিনি। এই ঘটনায় জড়িত চারজনকে এরই মধ্যে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। তাদের মধ্যে আহসানের গাড়ি চালক সাইফুল ইসলাম ও তার বন্ধু নুরুন্নবীও রয়েছেন। তারা এরই মধ্যে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এছাড়া ইসরাফিল ও সুজন ইসলাম আরও দু’জনকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে তুরাগ থানা পুলিশ। জড়িতদের জবানবন্দি ও জিজ্ঞাসাবাদে হত্যার পরিকল্পনা, বাস্তবায়ন ও টার্গেট করার কারণ উঠে এসেছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জিজ্ঞাসাবাদে চালক সাইফুল দাবি করেন- ১২ মার্চ হত্যার ছক চূড়ান্ত করা হয়। এটি বাস্তবায়নের পূর্ব পরিচিতি নুরুন্নবীকে ভাড়া করেন তিনি। এক সময় নুরুন্নবী ও সাইফুল একসঙ্গে গার্মেন্টেসে চাকরি করতেন। পুরো মিশন সফল করতে ইসরাফিল ও সুজনকে ম্যানেজ করেন নুরুন্নবী। ঘটনার দু’দিন আগে তুরাগ এলাকা রেকি করেন তারা। আহসানকে নিয়ে অফিস থেকে ফেরার পথে কোথায় প্রস্রাব করার নাম করে গাড়ি থামাবেন তা দেখিয়ে দেন। সাইফুল অন্যদের টোপ দেন- গাড়িতে আহসানকে জিম্মি করা গেলে অনেক টাকা আদায় করা সম্ভব হবে।
ছক মোতাবেক তুরাগ এলাকার পূর্ব নির্ধারিত স্পটে বিকেল ৪টার দিকে গাড়ি থেকে নেমে পড়েন চালক। এরপর তার তিন সহযোগী মাইক্রোবাসে উঠে পড়েন। যাদের আগে থেকে ভাড়া করেন সাইফুল। তাদের মধ্যে দু’জন গাড়ির পেছনের আসনে আহসান উল্লাহ’র পাশে, অন্যজন বসেন চালকের বাম পাশের আসনে। প্রশ্রাব করার নাম করে মাইক্রোবাস থেকে নেমে যাওয়ার পর সাইফুল ফের গাড়িতে ফিরে নতুন নাটক সাজান। তিনি সহযোগীকে দেখে না চেনার ভান করে বলে উঠেন- ‘আপনারা কারা আমার গাড়িতে উঠেছেন।’ তারা কোনো উত্তর দেননি। এরপরই আহসানের হাত-পা বেঁধে ফেলা হয়। চোখ বাঁধা হয়নি। বাজানো হয় উচ্চ শব্দে গান। চারজনের কথোপকথন ও কর্মকাণ্ড দেখে অল্প সময়ের মধ্যে আহসান বুঝতে পারেন তারা সবাই একে অপরের পরিচিত। প্রাণে বাঁচতে আহসান তাদের ৫০ হাজার টাকা মুক্তিপণ দেওয়ার কথা জানান। তবে তারা সাড়া দেননি।
বেড়িবাঁধ, গাবতলী, দিয়াবাড়ি রেলস্টেশন, ১৬ নম্বর সেক্টরে ঘুরাতে থাকেন। খুনের আগে গাবতলী এলাকায় আহসানকে ইফতার করান তারা। এরই মধ্যে তার ব্যাংকের কার্ড থেকে দু’টি মোবাইল ব্যাংকিং নম্বরে ৫০ হাজার টাকা ট্রান্সফার করেন জড়িতরা। এরই মধ্যে একটি নম্বর সাইফুলের স্ত্রীর নামে নিবন্ধন করা। আরেকটি নম্বর তার বোনের। আরও ১০ হাজার টাকা কার্ড থেকে তুলে নেয় তারা। এছাড়া নগদ ২৫ হাজার টাকা লুট করে। সব মিলিয়ে ৮৫ হাজার হাতিয়ে নেওয়া হয়। তার মধ্যে নুরুন্নবীকে মাত্র এক হাজার ও ইসরাফিলকে দুই হাজার টাকা দেওয়া হয়। সুজন কোনো টাকা পায়নি। ভাগের টাকা সবাইকে পরবর্তীতে দেওয়া হবে জানান সাইফুল। নির্যাতনের এক পর্যায়ে তাঁকে হাসপাতালে নেওয়ার কথা বলেন নুরুন্নবী। তখন সাইফুল সহযোগীদের বলেন- হত্যা না করলে একজনও বাঁচব না। এরপর অন্যরা তাদের হত্যা মিশনে সহযোগিতা করেন।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট আরেক কর্মকর্তা জানান, আহসানকে হত্যার কারণ হিসেবে দু’টি বিষয়ের কথা এখন পর্যন্ত দাবি করছেন চালক সাইফুল। প্রথমত- গত আগস্টে সামান্য দুর্ঘটনায় সাইফুলের মাইক্রোবাসের কিছু ক্ষতি হয়েছিল। এরপর সাইফুল নিজ উদ্যোগে ইন্সুরেন্স থেকে মেরামত বাবদ টাকা আদায় করতে সহায়তা করেন। তার ধারণা ছিল ওই টাকা থেকে একটি ভাগ আহসান তাকে দেবেন। তবে সেটা না দেওয়ায় ক্ষোভ ছিল তার। আবার মাসে ১৯ হাজার টাকা বেতনের বাইরে কোনো সুযোগ-সুবিধা না দেওয়ার মনক্ষুন্ন ছিলেন তিনি। সাইফুলের ভাষ্য- এ ক্ষোভ থেকে মালিককে জিম্মি করে অর্থ আদায়ের ফন্দি আঁটেন।
র্যাব-১ এর কোম্পানি কমান্ডার মেজর মুহাম্মদ আহনাফ রাসিক বিন হালিম সমকালকে বলেন, অফিস থেকে বাসায় না ফেরায় তুরাগ থানায় জিডি করেছিল পরিবার। এরপর শুরু হয় তদন্ত। একে একে জড়িত চারজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশে হস্তান্তর করা হয়েছে। তুচ্ছ কারণে নৃশংসভাবে প্রকৌশলীকে হত্যা করা হয়েছে।
জানা গেছে, ২৫ মার্চ দিয়াবাড়ির ১৬ নমম্বর সেক্টরের ৩ নম্বর সড়কের রাস্তার পাশ থেকে আহসানের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। ঘটনার পর র্যাব ছায়াতদন্ত করে হত্যাকাণ্ডের জড়িত থাকার অভিযোগে গাইবান্ধা থেকে মূল পরিকল্পনাকারী সাইফুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করে। ২৬ মার্চ লালমনিরহাট থেকে নূরন্নবী ও গাজীপুরের কাশিমপুর থেকে ইসরাফিলকে গ্রেপ্তার করে র্যব। সবশেষে ধরা হয় সুজনকে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই ফরহাদুজ্জামান নবীন বলেন, ছুরি, স্ট্যাম্প, ব্যাংকের চেক, ভিকটিমের মোবাইল ফোনসহ বেশকিছু আলামত জব্দ করা হয়েছে। ভয় দেখানোর জন্য ছুরি রাখা হয়।