নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণে অন্তর্বর্তী সরকার ক্রমান্বয়ে ব্যর্থতার দিকে ধাবিত হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। তিনি বলেন, নতুন করে শতাধিক পণ্যে ভ্যাট বাড়ানোর সিদ্ধান্তে সাধারণ মানুষের ওপর আরও চাপ বাড়বে। ৫ টাকার জায়গায় ১৫ টাকা কর বসানো সরকারের ভুল নীতি। এমন সিদ্ধান্তে ইউনূস সরকারের প্রতি জনগণের আস্থায় চিড় ধরতে পারে।

আজ শনিবার রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে রুহুল কবির রিজভী এ কথা বলেন। সদ্য প্রণীত কয়েকটি পাঠ্যবইয়ে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) ‘ভুল তথ্য’ এবং ‘ইতিহাস বিকৃতি’ সম্পর্কে অবহিত করতে এ সংবাদ সম্মেলন করা হয়।

রুহুল কবির রিজভী অভিযোগ করে বলেন, নবম-দশম শ্রেণির পৌরনীতির নতুন বইয়ে এনসিটিবি ভুল তথ্য তুলে ধরেছে। ফ্যাসিবাদের পতনের পরও পাঠ্যবইয়ে পতিত আওয়ামী লীগকে ‘হিরো’, আর বিএনপিকে হেয়প্রতিপন্ন করে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টির ষড়যন্ত্র চলছে। তিনি নতুন পাঠ্যবইয়ে যেসব জায়গায় আওয়ামী বন্দনা করা হয়েছে, তা দ্রুত সংশোধন করার দাবি জানান। তিনি বলেন, বিএনপির বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই আওয়ামী দোসররা ইতিহাস বিকৃতি করছে।

‘নতুন পাঠ্যবইয়ে এখনো আওয়ামী বন্দনা’

রিজভী বলেন, ‘নতুন শিক্ষাবর্ষে পরিমার্জিত, নতুন করে ছাপানো নবম-দশম শ্রেণির “পৌরনীতি ও নাগরিকতা” বইয়ের ৭৩ নম্বর পৃষ্ঠার “গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দল ও নির্বাচন ব্যবস্থা” অধ্যায়ে “বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ” সম্পর্কে হাসিনার অলিগার্করা লিখেছে, আওয়ামী লীগ এ দেশের সবচেয়ে বৃহত্তম রাজনৈতিক দল। আর বিএনপিকে নিয়ে অতিকথন, অপপ্রচার আর কুৎসা রটানোর বিরতিহীন যে ধারাভাষ্য চালানো হয়েছে শেখ হাসিনার ১৬ বছরে, তারই প্রতিফলন এখনো আমরা দেখছি পাঠ্যপুস্তকে।’

রিজভী আরও বলেন, বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানকে ‘সাবেক রাষ্ট্রপতি’র পরিবর্তে ‘সাবেক সেনাপ্রধান’ হিসেবে উল্লেখ করে বলা হয়েছে, সাবেক সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের ‘সামরিক শাসনামলে’ ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) গঠিত হয়। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) ভেতরে-বাইরে ঘাপটি মেরে বসে থাকা আওয়ামী ভূতেরা শেখ হাসিনারই মিথ্যা বয়ান লিপিবদ্ধ করেছে পাঠ্যপুস্তকে।

‘বিএনপি সেনাছাউনিতে গঠিত দল নয়’

বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব বলেন, ‘আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছি, দেশের জনগণের ভালোবাসায় ধন্য বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির বিরুদ্ধে একটি গভীর ষড়যন্ত্র চলছে। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের পাঠ্যপুস্তকেও বিএনপি সম্পর্কে ভুল তথ্য সন্নিবেশিত করা হচ্ছে। আমরা রাজনীতিসচেতন দেশবাসীর সামনে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিতে চাই, বিএনপি সেনাছাউনিতে জন্ম হওয়া কোনো দল নয়। সামরিক প্রশাসক কিংবা সেনাবাহিনী প্রধান হিসেবে নয়, বরং ঢাকার রমনা রেস্তোরাঁয় এক সংবাদ সম্মেলনে ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান যখন বিএনপি গঠনের ঘোষণা দিয়েছিলেন, তখন তিনি ছিলেন দেশের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট। সুতরাং বিএনপি সেনাছাউনিতে গঠিত হয়েছে, এ তথ্য ইতিহাস বিকৃতি ছাড়া কিছুই নয়।’

বিএনপির এই মুখপাত্র বলেন, পাঠ্যবইয়ে নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরা জরুরি, তৎকালীন প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশে সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে একদলীয় বাকশাল গঠন করেছিলেন। এরপর ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসের পটপরিবর্তনে দেশে সামরিক শাসন জারি করে খন্দকার মোশতাক আহমেদের নেতৃত্বাধীন তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার। এ সময় দেশে কোনো রাজনৈতিক দল ছিল না। এমনকি একদলীয় বাকশালের নাম নেওয়ারও কেউ ছিলেন না। এমন পরিস্থিতিতে জিয়াউর রহমান দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রবর্তনের সিদ্ধান্ত নিয়ে ‘রাজনৈতিক দলবিধি ১৯৭৬’ জারি করেন। কমপক্ষে ১৯টি রাজনৈতিক দলকে দেশে নিজ নামে রাজনীতি করার অনুমতি দেওয়া হয়। শুরু হয় বহুদলীয় গণতন্ত্রের পথচলা। এসব তথ্যপ্রমাণে স্পষ্ট, জিয়াউর রহমান আগে নিজে দল গঠন করেননি। বরং অন্য সব দলকে দেশে নিজ নামে রাজনীতি করার সুযোগ দিয়ে, দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তন করে স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালে যখন বিএনপি গঠনের ঘোষণা দেন, তখন তিনি আর সেনাপ্রধান নন, বরং তিনি ছিলেন জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট।

রিজভী বলেন, এসব তথ্যপ্রমাণ বিশ্লেষণ করলে এটি স্পষ্ট, বিএনপি প্রতিষ্ঠার সঙ্গে ক্ষমতা নয়, বরং দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নিবিড় সম্পর্ক ছিল। এসব সত্য ইতিহাস কেন এখন পাঠ্যপুস্তকে সন্নিবেশিত হবে না।

বিএনপির এই নেতা আরও বলেন, পতিত স্বৈরশাসকের অনুচরেরা হাসিনা পালানোর পর ভীষণ মনঃকষ্ট নিয়ে দিনরাত চক্রান্তে মেতে থাকছে। তারাই পাঠ্যবইয়ে আওয়ামী লীগের শ্রেষ্ঠত্ব, স্তুতিবন্দনা আর বিএনপি সেনাছাউনিতে জন্ম বলে হেয়প্রতিপন্ন-বিতর্কিত করার মাধ্যমে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মগজধোলাইয়ের প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে চাচ্ছে। তারা নৈরাজ্য সৃষ্টি করে চলেছে ছদ্মবেশে। তাদের পালিয়ে যাওয়া ‘গডমাদার’ হাসিনাকে ফিরিয়ে আনার জন্য নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নাল আবদীন ফারুক, যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স, কেন্দ্রীয় নেতা সেলিমুজ্জামান সেলিম, আসাদুল করিম শাহীন, আবদুস সাত্তার পাটোয়ারী, তারিকুল আলম তেনজিং প্রমুখ।

.

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

ন্যায় প্রতিষ্ঠায় অবিচল

পাঠ্যপুস্তকে তাঁর জীবনী নেই। অথচ কোথায় ছিলেন না তিনি! ১৯৪৩ সালে অবিভক্ত বাংলার দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের পাশে ছিলেন। ১৯৪৬ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময়ে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে মানবিক ও সমাজসেবামূলক কাজে অংশ নিয়েছিলেন। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মন্দিরে গিয়ে অভয় দিয়েছিলেন। ব্রিটিশ শাসনের শৃঙ্খল থেকে মুক্তির সংগ্রামে যুক্ত ছিলেন। ১৯৪৯ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-বিধ্বস্ত পূর্ব পাকিস্তান, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরা অঞ্চলের সংখ্যালঘু ও উদ্বাস্তুদের আশ্বস্ত করতে এবং তাদের অধিকারকে স্বীকৃতি দিতে ঐতিহাসিক ‘নেহরু-লিয়াকত’ চুক্তি প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। ষাটের দশকে সুপ্রিম কোর্টে বিচারক থাকাকালে রেড ক্রসের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তিনি বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তিনি তাঁর মামা অবিভক্ত বাংলার অবিসংবাদিত নেতা শেরেবাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হকের সঙ্গে ১৪৪ ধারা ভেঙেছিলেন। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষাশহীদদের জানাজায় অংশ নিয়ে তিনি ও তাঁর মামা দু’জনেই আটক হয়েছিলেন। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা কর্মসূচি প্রণয়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের সংসদীয় গণতন্ত্রের বিধান-সংবলিত শাসনতন্ত্র প্রণয়নে গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে সাহায্য করেছিলেন। ১৯৬১ সালে পাকিস্তানি সামরিক নেতৃত্বের বাধা মোকাবিলা করে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে সভাপতির দায়িত্ব পালন করে বাঙালির সাংস্কৃতিক স্বাধীনতার লড়াইয়ে শামিল হয়েছিলেন। ১৯৬৪ সালে ঢাকা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি ছিলেন। ১৯৬৬ সালে স্বাধিকার আন্দোলনে ছয় দফার চূড়ান্ত খসড়া প্রণয়নে ভূমিকা রেখেছিলেন। ১৯৬৭ সালে  ছয় দফা আন্দোলন তুঙ্গে থাকাকালে প্রধান বিচারপতির পদ থেকে পদত্যাগ করে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে শামিল হয়েছিলেন। মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে তিনি সক্রিয় অংশ নিয়েছিলেন এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিরুদ্ধে আইনি লড়াইয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন। মূলত মওলানা ভাসানী ও তাঁর কারণেই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্তরা নিঃশর্ত মুক্তি পেয়েছিলেন।

আত্মমর্যাদাশীল বাঙালি জাতির প্রতিনিধি হিসেবে ১৯৬৯ সালের গোলটেবিল সম্মেলনে তিনি ‘এক মানুষ, এক ভোট’ নীতি বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছিলেন। এই নীতিতে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে পূর্ব পাকিস্তানবাসীর সংখ্যাগরিষ্ঠতার যৌক্তিক কারণ দেখিয়ে মোট ৩০০ আসনের মধ্যে ১৬৯টি আসন আদায় করেছিলেন। এভাবেই তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে বিজয়ীদের জাতীয় সরকার গঠনের পথ প্রশস্ত করেছিলেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পাঞ্জাবি শাসকগোষ্ঠীর পরাজয় নিশ্চিত করেছিলেন।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি পাকিস্তানের অবৈধ সামরিক সরকারকে সহযোগিতা করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। অবৈধ পাঞ্জাবি শাসক চক্রের জুলুম-নির্যাতনের প্রতিবাদ করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষাবলম্বন করেছিলেন। সাংবিধানিক ব্যত্যয়ে তৎকালীন হাইকোর্ট বারকে নিয়ে তিনি যে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন, তা এত চরমে পৌঁছে যে, ১৯৭১ সালের মার্চে জেনারেল টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হিসেবে শপথবাক্য পাঠ করাতে কোনো বিচারকই রাজি হননি। মুক্তিযুদ্ধের পরও তিনি থেমে যাননি। গণতন্ত্র, মানবাধিকার, আইনের শাসন ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার থেকে বিচ্যুত হননি। মুক্তিযুদ্ধের আগেও নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথককরণের দাবি তুলেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের পরেও নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথককরণের দাবি জানিয়েছিলেন। প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে সার্ক গঠনের পরামর্শ দিয়েছিলেন তিনি। সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়ে তিনি ধীরে ধীরে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং ১৯৭৯ সালের ৩ এপ্রিল শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগ পর্যন্ত তিনি শেরেবাংলা এ.কে. ফজলুল হকের যোগ্যতম উত্তরাধিকারী হিসেবে বেঁচে ছিলেন।

হাসনাত আরিয়ান খান: লেখক ও গবেষক

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ট্রাম্পবিরোধী বিক্ষোভ
  • ইউরোপের শহরগুলোতে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ
  • নির্বাচনের কথা বলে মুখে ফেনা তুলে ফেললেই গণতন্ত্র হয় না: নুসরাত তাবাসসুম
  • নির্বাচনের কথা বলে ফেনা তুলে ফেললেই গণতন্ত্র হয় না: নুসরাত তাবাসসুম
  • ট্রাম্প, নেতানিয়াহু, মোদি ও এরদোয়ানের মধ্যে কেন এত মিল
  • নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশে গণতন্ত্র দেখতে চায় ভারত
  • সেজার ভ্যালেজোর প্রেমজীবন
  • গণহত্যার বিচার বানচালে অর্থ বিনিয়োগের প্রমাণ মিলেছে: চিফ প্রসিকিউটর 
  • রাজনীতি ছাড়ছেন না লো পেন, আইনি লড়াই করবেন
  • ন্যায় প্রতিষ্ঠায় অবিচল