‘ছোট বেলা থেকেই বাইক্কা বিলে যাওয়া আসা যাওয়া করি। একসময় কত ধরনের পাখি দেখা যেত। কত পাখির ছবি এই বাইক্কা বিল থেকে তুলেছি। কিন্তু এখন দিন দিন পাখির সংখ্যা অনেক কমে গেছে। ১০ বছর আগের সঙ্গে বর্তমানের হিসাব করলে পাখির সংখ্যা ২০ ভাগে নেমেছে। অথচ এই বাইক্কা বিলে হাজার হাজার পাখি একসময় পুরো বিল দখল করে রাখত। পাখির কলকাকলিতে মুখর থাকত বিল।’ কথাগুলো বলছিলেন বন্য প্রাণী নিয়ে কাজ করা সংগঠন স্ট্যান্ড ফর আওয়ার এনডেঞ্জার্ড ওয়াইল্ড লাইফের (সিউ) সদস্য ও ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফার কাজল হাজরা।

মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের হাইল হাওরের বাইক্কা বিলে পাখির সংখ্যা দিন দিন কমে যাওয়ায় কথাগুলো বলছিলেন কাজল হাজরা।

বাইক্কা বিল পর্যটকদের প্রিয় স্থানগুলোর একটি। এই এলাকার মূল আকর্ষণ নানা প্রজাতির নজরকাড়া পাখি। সারা বছরই পাখি দেখা গেলেও কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন কারণে অতিথি পাখির সংখ্যাটা কমে যাচ্ছে। আর এ বিলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে যাঁরা আসছেন, তাঁরাও পাখি না পেয়ে ফিরছেন অনেক হতাশা নিয়েই।

কাজল হাজরা বলেন, ‘আমরা প্রায়ই শুনি শহরে পাখি বিক্রি হচ্ছে। অনেক পাখি আমরা শহর থেকে উদ্ধার করি। বাইক্কা বিলে পাখিশিকারির চক্র রয়েছে। তারা পাখি শিকার করে। পাখিরা ভয়ে এখন আসে না। তা ছাড়া বাইক্কা বিলে যাওয়ার জন্য বড় পাকা রাস্তা হয়েছে। পর্যটকেরা অনবরত গাড়ি নিয়ে যাচ্ছেন। পাখিরা এসব ভয় পায়।’

বুধবার বিকেলে বাইক্কা বিলে গিয়ে দেখা যায়, পুরো বিলে হাতে গোনা কিছু দেশীয় পরিচিত পাখি বসে আছে। কিছু পাখি আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে। সন্ধ্যার পর পর বাইক্কা বিলের পাশের গাছগুলোতে পাখির দেখা মেলে। তবে এর সবই দেশি পাখি।

উপজেলা মৎস্য বিভাগ ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাইক্কা বিলে প্রতিবছর নভেম্বর থেকে অতিথি পাখিরা আসতে শুরু করে। পাখিরা মার্চ পর্যন্ত থাকে। ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি এসে বিলের আকাশে ওড়াউড়ি করে, শাপলা-পদ্মপাতায় বিশ্রাম নেয় এবং জলে ডোবে-ভাসে। এই বিলে বালিহাঁস, খয়রা কাস্তে চরা, তিলা লালসা, গেওয়ালা বাটান, পিয়াং হাঁস, পাতি তিলা হাঁস, নীল মাথা হাঁস, উত্তরে লেঞ্জা হাঁস, গিরিয়া হাঁস, উত্তুরে খন্তিহাঁস, মরচে রং ভুতিহাঁস, মেটে মাথা টিটি, কালা লেজ জৌরালি, বিল বাটান, পাতিসবুজলা, বন বাটান, পাতিচ্যাগা, ছোট ডুবংরি, বড় পানকৌড়ি, ছোট পানকৌড়ি, গয়ার, বাংলা শকুন, এশীয় শামুকখোল, পান মুরগি, পাতিকুট, নিউপিপি, দলপিপি, কালাপাখ ঠেঙ্গি, উদয়ী বাবু বাটান, ছোট নথ জিরিয়া, রাজহাঁস, ওটা, ধুপনি বক, ইগল, ভুবন চিল, হলদে বক, দেশি কানিবক, গো-বক, ছোট বক, মাঝেলা বগা, লালচে বক, বেগুনি কালেম, বড় বগা, দেশি মেটে হাঁস, সরালি, বালিহাঁস, পানমুরগির, শালিক, ঘুঘু, দোয়েল, চড়-ই, বুলবুলি, দাগি ঘাসপাখি, টুনটুনি, ফিঙেসহ নানা প্রজাতির পাখি দেখা যেত। এখন বক, বালিহাঁস, ডুবরি, পানকৌড়ি, কালেম ছাড়া বেশি পাখি চোখে পড়ে না। স্থানীয় ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে পাখি দেখতে আসা পর্যটকেরাও এখানে এসে হতাশ হন।

ঢাকা থেকে ঘুরতে আসা পর্যটক সুমাইয়া শিমু বলেন, ‘বাইক্কা বিল নিয়ে অনেক কথা শুনেছি। বাইক্কা বিলে অনেক পাখি রয়েছে এ ধরনের ভিডিও দেখেছি। বাস্তবে এসে দেখলাম কিছুই নেই। এখানে এসে হতাশ হলাম। হাতে গোনা কয়েকটি পাখি পেয়েছি। সেগুলোও অনেক দূরে থাকে।’

বাইক্কা বিল দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা বড়গাঙ্গিনা সম্পদ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি মিন্নত আলী প্রথম আলোকে বলেন, এ বছর পাখির সংখ্যা অনেক কম। এ বছর বিলের কচুরিপানা বিল থেকে সরে যাওয়ায় পুরো বিল প্রায় ফাঁকা দেখা যাচ্ছে। পাখিরা এসব কচুরিপানা ও বিভিন্ন জলজ উদ্ভিদের ওপরেই বেশি থাকে। বিলের কিছু অংশে শাপলা-পদ্ম টিকে থাকলেও জলজ উদ্ভিদ প্রায় নেই। পাশাপাশি বাইক্কাবিলের প্রচুর পর্যটক আসায় পাখিরা একটু দূরে থাকে। অনেক পর্যটকই পাখিদের বিরক্ত করে। হাওরের পানিতে শিকারিরা জাল নিয়ে ঘুরে বেড়ান। হাওরে বাঁধ দিয়ে মেশিন লাগিয়ে পানি সেচা হয়। কারেন্ট জাল বিছিয়ে রাখা হয় পাখিদের ধরার জন্য। তা ছাড়া বাইক্কা বিলে নৌকা নিয়ে প্রায়ই চলাচল করতে দেখা যায়, যা পাখির জন্য খুবই ভয়ানক বিষয়।

পাখি শিকার হয় কি না, জিজ্ঞেস করলে মিন্নত আলী বলেন, স্থানীয় কিছু মানুষ শিকারের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন। বর্তমানে আমাদের পাঁচজন লোক বিলের পাহারায় থাকেন। কয়েক দিন আগেও শিকারির উৎপাত ছিল। এখন সেটা নেই।

শ্রীমঙ্গল সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা বিনয় কুমার রায় বলেন, ‘বিলের পাখি এখন আর কেউ শিকার করে না। এখানে বিলের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য একটি কমিটি রয়েছে। তারাই পাহারার ব্যবস্থা করে। আমরা সব সময় খবরাখবর রাখি। এখন পাখির সংখ্যা দিন দিন কেন কমছে, সেই বিষয়ে আমরা একটি সার্ভে করব। পাখিবিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করবে।’

.

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

এক সময়ের বনদস্যুর ‘বয়ানে’ সুন্দরবনে দস্যুতার দিনগুলো

সুন্দরবনে দস্যুতায় টাকা ছিল। কিন্তু সে অবৈধ টাকা নিজেরা উপভোগ করতে পারতেন না। বনের মধ্যে সব সময় মৃত্যুঝুঁকি তাড়িয়ে বেড়াত, এক ঘণ্টা শান্তির ঘুমও হতো না। মোটেও সুখ ছিল না। দস্যুতার জগতে গিয়ে নিজের প্রাপ্তি বলতে নামের সঙ্গে জুড়ে গেছে ডাকাত শব্দটি। স্ত্রী-সন্তানদেরও চলতে হতো মাথা নিচু করে। কথাগুলো একসময়ের বনদস্যু আল-আমীনের।

আল-আমীন বলেন, দস্যুতা ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে তিনি ভালোই আছেন। আর কখনো ওই অন্ধকার পথে পা বাড়াতে চান না তিনি। সম্প্রতি তাঁর সঙ্গে দেখা হয় কয়রা উপজেলার সুন্দরবনঘেঁষা খোড়লকাঠি বাজারসংলগ্ন কয়রা নদীর তীরে। ছোট বাজারটিকে সুন্দরবন থেকে আলাদা করেছে পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া কয়রা নদী।

নদীর ওপারের সুন্দরবনের ত্রাস ছিলেন আল-আমীন। তিনি বলেন, তখন শরীফ বাহিনী ছিল বড় দস্যুদল। সেই দলে যোগ দিয়ে ডাকাত হয়েছিলেন। কিছুদিনের মধ্যে এলাকায় নাম ছড়িয়ে গেলে বাড়ি ফেরার পথ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। তাঁরা সুন্দরবনের মধ্যে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে বনজীবীদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করতেন। র‍্যাব আর কোস্টগার্ডের অভিযানের ভয়ে বনের মধ্যে প্রতিটি মুহূর্ত ভয় আর উৎকণ্ঠায় কাটত তাঁদের।

আল-আমীনের বলতে থাকেন, ধীরে ধীরে ছোট হয়ে আসছিল তাঁর গণ্ডি। বাড়ি ফেরার জন্য মনটা ব্যাকুল হয়ে উঠত। অপরাধের জগৎ ছেড়ে ভালো হতে চাইতেন, তবে সুযোগ পাচ্ছিলেন না। ২০১৮ সালের শেষের দিকে সুযোগ আসে। আত্মসমর্পণের মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফেরেন। দস্যুনেতা শরীফ না চাইলেও তাঁকে কৌশলে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করা হয়েছিল। তাঁরা দলের ১৭ জন সদস্য ১৭টি অস্ত্র আর ২ হাজার ৫০০ গুলিসহ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন।

দস্যুজীবন যাঁরা একবার দেখেছেন, তাঁরা না খেয়ে থাকলেও আর দস্যুতায় ফিরতে চান না—এমনটাই দাবি আল-আমীনের। নদীর তীরে দাঁড়িয়ে গল্প গল্পে তিনি বলেন, ডাঙায় থাকা মাছ ব্যবসায়ীরা ডাকাতদের বাজার, বন্দুক, গুলি সবই সাপ্লাই দিতেন। সব জিনিসের দাম নিতেন তিন থেকে চার গুণ বেশি।

বন বিভাগ ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ থেকে ২০১৮ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ধাপে ধাপে সুন্দরবন অঞ্চলের ৩২টি দস্যু বাহিনীর ৩২৮ জন দস্যু ৪৬২টি অস্ত্র, ২২ হাজার ৫০৪টি গোলাবারুদসহ আত্মসমর্পণ করেছিলেন। পরে ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর সব শেষ দস্যুদল হিসেবে আত্মসমর্পণ করে শরীফ বাহিনী। সেদিনই প্রাণবৈচিত্র্যে ভরা সুন্দরবনকে ‘দস্যুমুক্ত’ ঘোষণা করা হয়। তবে দস্যুনেতা শরীফ গত বছরের ৫ আগস্টের পর আবার সুন্দরবনে দস্যুতায় নেমেছেন বলে তাঁর একসময়ের সাথীদের ভাষ্য।
সুন্দরবন দস্যুমুক্ত করার কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সাংবাদিক মোহসীন-উল হাকিম। তিনি বলেন, দলনেতা শরীফের পুরো নাম করিম শরীফ। কয়রার আল-আমীন ছিল বাহিনীর সর্বকনিষ্ঠ সদস্য। শরীফ প্রথমে আত্মসমর্পণে রাজি থাকলেও পরে বেঁকে বসেন। অন্যরা আত্মসমর্পণ করেন। তবে শরীফ এখন পুনরায় সুন্দরবনে দস্যুতায় নেমেছেন।

কয়রা কপোতাক্ষ মহাবিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক অধ্যাপক আ ব ম আবদুল মালেক বলেন, বনের নিরাপত্তায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা কমে আসায় সুন্দরবনে আবারও দস্যুদের উৎপাত বেড়েছে। এভাবে দস্যুতা চলতে থাকলে বনজীবীদের জীবিকা, সুন্দরবন থেকে রাজস্ব আদায় ও পর্যটন হুমকির মুখে পড়বে; বিপন্ন হবে বন্য প্রাণী আর প্রাণবৈচিত্র্য। দস্যুতা দমনে প্রশাসনকে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার অনুরোধ করেন তিনি।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • মুখোশের অন্তরালে…
  • আফগানিস্তানের যা আছে, বাংলাদেশের সেটাও নেই
  • এক সময়ের বনদস্যুর ‘বয়ানে’ সুন্দরবনে দস্যুতার দিনগুলো
  • ট্রাম্প–জেলেনস্কির বাগ্‌বিতণ্ডা কেন ন্যাটোর জন্য বড় সংকটের ইঙ্গিত