কুমিল্লা নগরের নবাব ফয়জুন্নেছা সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের আঙিনায় আজ শনিবারের সকালটা অন্য দিনের তুলনায় কিছুটা ভিন্ন। চারদিকে যেন উৎসবের আমেজ। দূর থেকেই শোনা যাচ্ছিল শিক্ষার্থীদের আলাপচারিতা। বিভিন্ন স্থান থেকে সেখানে জমায়েত হয়েছে সাড়ে পাঁচ শ খুদে গণিতবিদ। আনন্দ, উচ্ছ্বাস আর উদ্দীপনা নিয়ে তাঁরা অংশ নেয় এবারের ‘ডাচ্-বাংলা ব্যাংক-প্রথম আলো আঞ্চলিক গণিত উৎসবে’।

আজ সকাল ৯টার দিকে বিদ্যালয়টির মাঠে সমবেত কণ্ঠে জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে উৎসবের শুরু হয়। একই সঙ্গে উত্তোলন করা হয় জাতীয়, বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড ও আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডের পতাকা। জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন কুমিল্লার জেলা প্রশাসক মো.

আমিরুল কায়সার। পরে আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডের পতাকা উত্তোলন করেন ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের কুমিল্লা জোনের ইনচার্জ আবু কাউছার ছিদ্দিক এবং বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াডের পতাকা উত্তোলন করেন কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের কলেজ পরিদর্শক অধ্যাপক জহিরুল ইসলাম পাটোয়ারী।

উদ্বোধনী পর্বে উপস্থিত ছিলেন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন, কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের উপপরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (মাধ্যমিক) মোহাম্মদ শহিদুল ইসলাম, নবাব ফয়জুন্নেছা সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রাশেদা আক্তার, শশীদল আলহাজ মোহাম্মদ আবু তাহের কলেজের অধ্যক্ষ মো. আবুল হোসেন। কুমিল্লা বন্ধুসভার সভাপতি ও কুমিল্লা আইডিয়াল কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ মহিউদ্দিন লিটনের সঞ্চালনায় স্বাগত বক্তব্য দেন প্রথম আলোর কুমিল্লা প্রতিনিধি আবদুর রহমান।

অনেক শিক্ষার্থী অভিভাবকের সঙ্গে ভোরে রওনা দিয়ে নির্ধারিত সময়ের আগেই এসে পৌঁছায় গণিত উৎসবস্থলে। কিন্তু তাঁদের চোখেমুখে সেই ক্লান্তির ছাপ যেন উধাও। বরং তাদের চোখে দেখা গেছে স্বপ্ন জয়ের আকাঙ্ক্ষা। গণিত উৎসবকে কেন্দ্র করে নবাব ফয়জুন্নেছা সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের আঙিনায় বসেছে প্রথমা, তাম্রলিপি, স্বপ্ন ৭১, তৌফিক, আদর্শসহ পাঁচটি প্রকাশনীর স্টল। প্রতিটি স্টলেই শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের ভিড় দেখা গেছে। তাঁরা বইয়ের স্টলগুলো ঘুরে দেখেন। অনেকে নিজের পছন্দের বইও কেনেন।

উদ্বোধনের পর সকাল ৯টা ৪৫ মিনিট থেকে বিদ্যালয়ের দুটি ভবনের বিভিন্ন কক্ষে গণিতের পরীক্ষা শুরু হয়। পরীক্ষার পর বিদ্যালয়ের অডিটরিয়ামে কুমিল্লা বন্ধুসভার সদস্যদের পরিবেশনায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করার কথা আছে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পর সেখানে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্নোত্তরপর্ব চলবে।

চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলা নাউলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী তাসপিয়া আক্তার এসেছেন বাবা জামাল হোসেনের সঙ্গে। ভোর সাড়ে ৫টায় রওনা দিয়ে সাড়ে ৮টার আগেই ভেন্যুতে পৌঁছান তাঁরা। তাসপিয়া আক্তার বলেন, ‘গণিত আমার প্রিয় বিষয়। তাই বাবার সঙ্গে গণিত উৎসবে এসেছি।’

এ নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো গণিত উৎসবে অংশ নিয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ তাপবিদ্যুৎ উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সালমান ইসলাম আদিব। গণিত উৎসবে অংশ নিতে আগের দিনই কুমিল্লা নগরের নিকটাত্মীয়ের বাসায় চলে আসে সালমান। সালমান নামের দশম শ্রেণির আরেক শিক্ষার্থী বলেন, ‘এতে অংশ নিয়ে আমার জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধি পাবে। তাই এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছি।’ কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী শারমিন আক্তার বলল, ‘এ নিয়ে তৃতীয়বার গণিত উৎসবে অংশ নিয়েছি। প্রতিবছরই অপেক্ষা করে থাকি দিনটির জন্য।’

উদ্বোধনের পর সকাল ৯টা ৪৫ মিনিট থেকে বিদ্যালয়ের দুটি ভবনের বিভিন্ন কক্ষে গণিতের পরীক্ষা শুরু হয়। পরীক্ষার পর বিদ্যালয়ের অডিটরিয়ামে কুমিল্লা বন্ধুসভার সদস্যদের পরিবেশনায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করার কথা আছে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পর সেখানে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্নোত্তরপর্ব চলবে। শিক্ষার্থীদের এসব প্রশ্নের উত্তর দেন শিক্ষকেরা। পাশাপাশি বিদ্যালয়ের আরেকটি ভবনে চলবে গণিত উৎসবে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের খাতা মূল্যায়নের কাজ।

গণিত অলিম্পিয়াডের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অভিভাবক, শিক্ষকসহ সবার প্রচেষ্টায় আমাদের আন্তর্জাতিক পর্যায়েও জানান দিতে হবে আমরাও কোনো অংশে পিছিয়ে নেইঅধ্যাপক মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন, গণিত বিভাগের চেয়ারম্যান, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘গণিত অলিম্পিয়াডের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অভিভাবক, শিক্ষকসহ সবার প্রচেষ্টায় আমাদের আন্তর্জাতিক পর্যায়েও জানান দিতে হবে আমরাও কোনো অংশে পিছিয়ে নেই।’

এ আয়োজনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের ব্যাপক উৎসাহ ও উদ্দীপনা দেখে অভিভূত হয়েছেন বলে জানান কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের কলেজ পরিদর্শক অধ্যাপক জহিরুল ইসলাম পাটোয়ারী। তাঁর প্রত্যাশা এ ধারাবাহিকতা যেন ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকে।

‘গণিত শেখো, স্বপ্ন দেখো’ স্লোগানে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের পৃষ্ঠপোষকতায় ও প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনায় গণিত উৎসবের এ আয়োজন করেছে বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি। আয়োজনে সহযোগিতা করে প্রথম আলো বন্ধুসভা ও কুমিল্লার সদস্যরা। অনলাইনে প্রাথমিক বাছাইপর্বে নির্বাচিত শিক্ষার্থীরা উৎসবে যোগ দেয়। কুমিল্লা অঞ্চলের এ গণিত উৎসবে অংশ নিয়েছে কুমিল্লা, চাঁদপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার শিক্ষার্থীরা। তিন জেলার প্রায় সাড়ে ৫০০ শিক্ষার্থী এ গণিত উৎসবে অংশ নেয়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের কুমিল্লা জোনের ইনচার্জ আবু কাউছার ছিদ্দিক তাঁর বক্তব্যে গণিত উৎসবে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের সাফল্য কামনা করেন।

শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে জেলা প্রশাসক মো. আমিরুল কায়সার বলেন, ‘আমরা স্বপ্ন দেখব অনেক দূর যাওয়ার। শিক্ষার্থীদের মেধা ও মননে উৎকর্ষ সাধন করতে হবে। গণিত একটি উপকরণ। নিয়মিত গণিতের চর্চা করতে হবে। আমি বিশ্বাস করি, কুমিল্লা অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিজেদের সাফল্য দেখাবে।’

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

ঈদের দিনটা কেটে যায় কাজে, নিজের জন্য আর কিছুই থাকে না

জীবনের পড়ন্তবেলায় এসে ঈদের উৎসবকে যখন রোমন্থন করি, তখন স্মৃতির গভীরে হারিয়ে যাই। ছোটবেলায় ঈদ ছিল এক অন্য রকম আনন্দের উৎসব। নতুন জামা বানাতে দরজির দোকানে মাপ দিতে যাওয়া, তারপর নতুন জামা হাতে পাওয়ার পর সেটি লুকিয়ে রাখা, যেন কেউ আগে দেখে না ফেলে! ঈদের দিন সইদের সঙ্গে গ্রামে ঘুরে বেড়ানো, ভাই–বোনদের সঙ্গে স্টুডিওতে ছবি তুলতে যাওয়া—এসব আনন্দের মুহূর্ত আজও হৃদয়ে জাগরূক। মনে হয়, সময় যেন আটকে গেছে, আমি এখনো সেই শৈশব–কৈশোরের রঙিন দিনগুলোর মধ্যেই আছি। কিন্তু যখন বাস্তবতায় ফিরি, তখন সবকিছু বিমূর্ত হয়ে যায়, ধূসর ও বিবর্ণ মনে হয়। মনের অজান্তেই চোখের কোণে জল এসে জমে।

আমাদের ছোটবেলার ঈদ আজকের মতো জৌলুশময় ছিল না। মধ্যবিত্ত যৌথ পরিবারে ছিল আর্থিক টানাপোড়েন, ছিল পরিমিত জীবনের শিক্ষা। দাদা–দাদার ভাইদের বিশাল পরিবারের সদস্যদের জন্য রান্না হতো বড় বড় পাতিলে। ঈদের এক সপ্তাহ আগেই শুরু হতো প্রস্তুতি। পুরোনো শাড়ির পাড় জোড়া লাগিয়ে দরজা–জানালার পর্দা বানানো হতো, সোডা দিয়ে কাপড় ধোয়ার আয়োজন চলত। মুড়ি, চিড়া ও খই সংগ্রহ করে রাখা হতো ঈদের সকালে মলিদা তৈরির জন্য। ময়দার সঙ্গে রং মিশিয়ে কাঁঠালপাতায় গোলা লেপে শুকিয়ে বানানো হতো পিঠা। এত কাজ, এত পরিশ্রমের মধ্যেও ক্লান্তি ছিল না; বরং ঈদের প্রস্তুতিই ছিল এক অন্য রকম আনন্দ।

ঈদের দিন ভোরে সাবান দিয়ে গোসল করে নতুন ছাপা থান কাপড়ের ফ্রক পরার আনন্দ আজও মনে পড়ে। তারপর পরিবারের মুরব্বিদের সালাম করে বয়সভেদে চার আনা থেকে এক টাকা পর্যন্ত ঈদের সালামি পাওয়া ছিল আমাদের কাছে বিরাট প্রাপ্তি! ঈদের সকালের শুরু হতো মলিদা দিয়ে, এরপর গুড়ের পায়েস কিংবা গুড়ের সেমাই। দুপুরের খাবারে থাকত মুরগির মাংস আর আলুর ঝোল, যার স্বাদ আজও স্মৃতির পাতায় অমলিন।

তারুণ্যে পা রাখার পর ঈদের উৎসব বদলে গেল। বরিশালে পড়াশোনার সময় ঈদ পায় নতুন রূপ—সেমাই, ফিরনি, জর্দা, পোলাও–কোরমার ভিড়ে ঈদ যেন ভোজন উৎসবে পরিণত হলো। এরপর কর্মজীবন, বিয়ে ও সংসারের দায়িত্ব এসে ঈদের রং পাল্টে দিল। নারীদের জন্য ঈদ মানে তখন শুধুই স্বামী–সন্তান ও সংসারের তাগিদ।

আজকের ঈদ আর আমাদের শৈশবের ঈদের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান। একসময় ঈদ মানে ছিল সীমিত সম্পদের মধ্যেও অপরিসীম আনন্দ। এখন ঈদের বাহারি আয়োজন, নতুন কাপড়–গয়না, খাবারের জৌলুশ বেড়েছে; কিন্তু সেই আনন্দ কোথায় যেন হারিয়ে গেছে! আগে একটা সাধারণ ফ্রকেই যে আনন্দ লুকিয়ে ছিল, এখন অসংখ্য পোশাকের মধ্যেও তা খুঁজে পাওয়া যায় না। কারণ, নারীদের ঈদ শুরু হয় গভীর রাতে—ফিরনি, সেমাই, হালিম, জর্দা, চটপটিসহ বাহারি রান্নার আয়োজন করে। সকালে রান্নার কাজ শেষ হতেই দুপুরের ও রাতের খাবারের প্রস্তুতি নিতে হয়। ফলে ঈদের দিনটাই কেটে যায় কাজে, নিজের জন্য কিছুই আর থাকে না।

অধ্যাপক শাহ্ সাজেদা

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • রান্না-খাওয়া পর্ব ভিন্ন আঙ্গিকে চিন্তা করলে নারীরাও আনন্দ করতে পারবেন
  • উৎসবে হজমের সমস্যা এড়াতে যা করবেন
  • ছোটবেলার ঈদ ঝামেলাবিহীন, সহজ-সরল ছিল: নুসরাত ফারিয়া
  • দল বেঁধে বেড়ানোর যে উৎসব ছিল, তা আর নেই, কী কঠিন বড় হওয়াটা
  • উৎসবে পারিবারিক দ্বন্দ্ব ও হতাশা কাটাতে করণীয়
  • আগামী বছর থেকে আরও বড় পরিসরে ঈদ আয়োজন করা হবে: আসিফ মাহমুদ
  • একটা জিনিস বুঝেছি, বাবা-মা ছাড়া ঈদ করা কঠিন: ন্যান্সি
  • সেই সুযোগ এখন আর হয় নেই: ন্যান্সি
  • ঈদে সেই সুযোগ এখন আর হয় নেই: ন্যান্সি
  • ঈদের দিনটা কেটে যায় কাজে, নিজের জন্য আর কিছুই থাকে না