‘এক দমের নাই ভরসা, করো তুমি কার আশা...’
Published: 11th, January 2025 GMT
মকদ্দস আলম উদাসীর মেহমানখানা কাম বেডরুম। আধো আলো, আধো অন্ধকার। সেখানে বসেই তিনি আমাদের কাছে ফেলে আসা জীবনের ঠিকুজি বাতলান। মারা যাওয়ার বছরখানেক আগে, সম্ভবত সেদিন ছুটির দিন ছিল। আমরা সিএনজি অটোরিকশায় চেপে সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরের কেশবপুরে তাঁর ডেরায় গিয়েছিলাম।
উদাসী ছিলেন বৈষ্ণবসাধক রাধারমণের পড়শি। তাঁর ডেরার খানিক দূরেই রাধারমণের সমাধিমন্দির। শাহ আবদুল করিম আর দুর্বিন শাহর পরবর্তী সময়ে সুনামগঞ্জে যে কয়েকজন সাধক-মহাজন আলো ছড়িয়েছেন, উদাসী তাঁদেরই একজন। জন্মেছিলেন ১৯৪৮ সালের ১ ফেব্রুয়ারি। মারা যান ২০২২ সালের ১৪ জুলাই।
সেই ছুটির দিনে উদাসীর দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিই। টানা চার ঘণ্টা! সেদিনের আলাপে বাউল, ফকির, সহজিয়া দর্শন এবং ধর্ম, সমাজ, রাষ্ট্র ও চেনাজানা সাধক কবিদের নিয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন। কীভাবে তিনি মাদ্রাসা থেকে পালিয়ে গানের জগতে ঝুঁকে পড়লেন আর শ্মশান-কবরে রাত কাটাতে থাকলেন দিনের পর দিন, সে গল্পও শোনালেন। পাঁচ সন্তানের মৃত্যু আর ট্রাকের নিচে পিষ্ট হয়ে মর্মান্তিকভাবে স্ত্রীর মৃত্যুযন্ত্রণা তাঁকে ক্রমাগত বিচ্ছেদি করে তুলেছে বলেও জানালেন।
কতশত গল্পকুশল বিনিময় আর অল্পবিস্তর বাতচিতের পর মকদ্দস আলম উদাসী ঘরে থাকা একটা লক্কড়ঝক্কড় বুকশেলফের কাচের দরজা খুলে কিছু পুরোনো বই আর ডায়েরি বের করেন। এর মধ্যে কয়েকটা পাণ্ডুলিপিও আছে। একটাতে লেখা তিনটি বাক্য: ‘উদাসী রচনা। প্রাচীন পাণ্ডুলিপি। ৩ খণ্ড একত্রে।’
বই, পাণ্ডুলিপি, ডায়েরি—সব এনে রাখেন চৌকিতে পেতে রাখা নতুন বিছানার চাদরের ওপর। তিনি নিজেও একসময় বিছানায় পদ্মাসন গেড়ে বসেন। কিছু বই তখন ঊরুতেও রাখলেন।
তিনি বলেন, ‘আমার কোনো ধন (অর্জন) নেই! তুচ্ছ, একেবারেই তুচ্ছ এক মানুষ আমি!’
প্রশ্ন করি উদাসীকে, ‘আপনার নামের শেষে উদাসী শব্দটা কবে থেকে লাগল?’
প্রশ্ন শুনে একটু হাসেন উদাসী। বলেন, ‘ইতা আমি ভালা পাই না। ওই যে মাইনষে শাহ লাগায়। শাহ অমুক আলী, শাহ তমুক আলী। আমি তো আমি-অই। আমি বাদশা না, আমি ফকির। তো, আমার ইতা লাগাইবার দরকার কিতা? আমি তো ওই মকদ্দস-অই। আমার ছোটবেলার নাম মকদ্দস আলী।’
উদাসী বলে চলেন, ‘মাদ্রাসাত যখন লেখাপড়া করি, এক নামে এক ক্লাসে পড়ি গেল দুইজন। উস্তাদে (শিক্ষক) কইলা, তোমার নামের পিছে লাগাও আলম। ওই মকদ্দস আলম। তান আছলা আমার আরবি শিক্ষক। ওউ তান নাম পাল্টাইল্লা। এরপর গানটান যখন শিখলাম, তখন কেউ ডাকে মকদ্দস ভাই, কেউ পাগল, কেউবা ভগল, আর কেউ কয় উদাসী। যার মনে যা আছে, তাই কয়। কউক (বলুক) না। যার যেটা ভালা লাগে, ডাকুক। তখন তো গান গাইতাম, বয়স কম, অঙ্গভঙ্গিমা আছিন ভালা। তখন মাইনষে কইত, থুরা (ছোট) বাইচ্ছাই গান গাইয়া তো উদাস করিলাইছে। পরে মাইনষের মুখ থাকি শুইনা দুর্বিন শাহও আমারে কইন উদাসী। অউ পড়ি গেল নাম উদাসী।’
‘কত সালের ঘটনা এটা?’
‘ধরুকউক্কা, আমার বয়স তখন বাইশ-তেইশ।’
‘আপনে তো তখন মাদ্রাসাত যান না?’
‘না, না। ই-সময় তো পড়া ছাড়ি দিছি। গানের জগতে ঢুকি গেছি।’
আপনার দুর্বিন শাহর সঙ্গে দেখা কবে?
‘তান সাথে আমার আষট্টিত (১৯৬৮ সাল) দেখা।’
জিজ্ঞাসা করি, ‘তিনি (দুর্বিন শাহ) তো মারা গেলেন ১৯৭৭ সালে। তার মানে ৯ বছর ওনার সঙ্গ করেছেন?’
উত্তরে মকদ্দস আলম উদাসী বলেন, ‘অয়, অয়। ৯ বছর সঙ্গ করছি। ই-সময় আমি, সাবুল মিয়া, আছর আলী, এরার সাথে গান গাই। আমার কোনো উস্তাদ নাই। প্রায় পাঁচ-ছয় বছর অইছে তখন আমি গানের রাস্তাত। গান গাই, তো মাইনষে কয়, উস্তাদ কে? উস্তাদ নাই, তে পুঙ্গানি? এই রকম মাইনষে খোঁচা দিত। তো, তখন আমার দুর্বিন শাহর লগে দেখা অয়। সম্ভবত, তান তখন লন্ডন থাকি গানটান গাইয়া আইছইন। এই সময় তানের একটা বই বার (প্রকাশ) অইছে, প্রেমসাগর পল্লিগীতি চতুর্থ খণ্ড।’
উদাসী একনাগাড়ে বলে চলেন, ‘তো অউ বইয়ের (দুর্বিন শাহর বই) গান আমি গাইতাম। আর আমার টুকটাক গান গাইতাম। আমি যে গান লিখি, ধরা দিতাম না। আমি গানে কইতাম, পাগলে কয়। তো, দুর্বিন শাহ একদিন কইলা, এই পাগলের নাম কিতা? আবদুল নামে এক পাগল আছিন, তাইন কইলা, এই তো সে-ই (উদাসী) লেখে। অনেক পরে আমারে তান (দুর্বিন শাহ) কইলা, লেখালেখি যখন করো, ইতা রাইখো। কামও লাগবে নে একদিন।’
প্রশ্ন রাখি উদাসীর কাছে, ‘লেখালেখি কবে থেকে শুরু করেছেন?’
লেখালেখি তো করি মাদ্রাসার পড়া ছাড়ার পর থাকি-অউ। ছোটবেলা থাকি-অউ। আমি তো ছোটবেলা থাকি নাগরী জানি। ছোটবেলায় বাবা আমারে সিলেটি নাগরী (বাংলা বর্ণমালার বিকল্প লিপি) শিখাইছলা। আমার মায় নাগরী জানতা। নাগরীতে লিখা কিতাবগুলা যখন আমি পড়তাম, শিতালং শাহ, ভবানন্দ, শাহনূর—এঁরার অনেক নাগরী কিতাব আছিন (ছিল)। তাঁরার লেখা কিতাব পড়তাম। তো, আমার মায় ইতা অনেক সময় আত (হাত) থাকি নিতা গা, ভবানন্দর বই। কইতা, ‘ইতা হরিবংশ, যে পড়ে, সে হয় নির্বংশ।’ কইতা, ইতা পড়িছ না তুই। তো, আমি লুকাইয়া লুকাইয়া পড়তাম। পড়তাম আর মাঝেমধ্যে ইতা বাংলা করতাম। বাংলা কইরা আমি ইতা আমার মতো কইরা জোড়া দিয়া গাওয়ার চেষ্টা করতাম। অউ, নাগরী লেখতে লেখতে আমার নিজের লেখা আইলো। ছোটবেলায় লেখতাম ইতা টুকটাক। ওই গাঙে দিয়া লঞ্চ যাইত, লঞ্চ নিয়া লেখতাম। কচুপাতা নিয়া লেখতাম। ঢংঢাং করতাম আরকি!
একফাঁকে এক নারী একটি থালায় তেলে ভাজা বেশ কিছু পুলি পিঠা আর কয়েকটি বাটিতে নুডলস দিয়ে গেলেন। একটু পর কয়েকটি চায়ের কাপে করে সেই নারীই নিয়ে এলেন মিরিন্ডা বা ফানটা–জাতীয় পানীয়। পিঠা আর ঠান্ডা পানীয় খেতে খেতে বারকয়েক কাশলেন উদাসী, কফও ঝাড়লেন। কফ-কাশের ছাঁট আমার ডান হাতে শীতল পরশ বুলিয়ে দেয়। বাঁ হাতের তর্জনী দিয়ে তা মুছে উদাসী ভাইয়ের কথায় মনোযোগ দিই। তিনি বলে চলেন জীব, পরম আর মনের মানুষ নিয়ে নিগূঢ়তত্ত্ব-কথা।
সময় যায়, কথা চলে। একসময়ে জানা হয়ে যায় উদাসীর দুর্বিন শাহকে মুর্শিদ ধরা আর তাঁর কাছে দোতরাবাদন শেখার গল্প। এ সময়ই উদাসী জানান তাঁর দুই থেকে আড়াই হাজার গান লেখার প্রসঙ্গও। স্মৃতিচারণা করেন নেত্রকোনা-সিলেটের ঐতিহ্যবাহী মালজোড়া গানের আসর ও প্রখ্যাত শিল্পীদের নিয়েও।
এক দমের নাই ভরসাসাক্ষাৎকার পর্ব শেষে বাইরে বেরোই। তাঁর ডেরা লাগোয়া যে পাকা রাস্তা আছে, সেখানে আমরা নিঃশব্দে কিছুক্ষণ হাঁটতে থাকি। রাস্তার দুই পাশে বাঁশঝাড়, কলা-নারকেল-সুপারিগাছ। সামান্য দূরে, রাস্তার ঠিক মাথার কোনায় একটা পাকা কবর। এমন পরিবেশে উদাসীকে গান গাইতে অনুরোধ করি। তিনি গাইলেন তাঁরই লেখা গান, ‘এক দমের নাই ভরসা, করো তুমি কার আশা।’
উদাসী গাইছেন আর বারবার হাঁপিয়ে উঠছিলেন, দু-একবার কাশলেনও। তীব্র শ্বাসকষ্ট চেপে তিনি অবলীলায় পুরো গান গাওয়া শেষ করলেন। কবরের সামনে নিজের গানের বই হাতে দাঁড়িয়ে তা দেখতে দেখতে গান গাইতে থাকা উদাসী হাতের ইশারায় কবর দেখিয়ে গাইছিলেন—‘আসা-যাওয়া একা, কবরে একা থাকা/ তাই ভাবিয়া সোনার অঙ্গ নাশ।/ আমার সংসারের অংশ নিতে আপন বংশ/ ভাই বন্ধু করিয়াছে আশ॥’
সেদিন খালি গলায় গেয়েছিলেন মকদ্দস আলম উদাসী। মাথা দুলিয়ে হাত নাড়িয়ে সাদা পাঞ্জাবি-লুঙ্গি পরা সফেদ চুল-দাড়িওয়ালা উদাসীর কণ্ঠে একদলা বিরহ ভর করেছিল। তাঁর পাঞ্জাবির বুকপকেটে ছিল কলম আর চোখমুখে ছিল একরাশ ক্লান্তি। এ ক্লান্তি যে দ্রুতই চিরবিশ্রামে রূপ নেবে, ঘুণাক্ষরেও ভাবিনি। সেদিন গানযাপন আর আড্ডা শেষে উদাসীর ডেরা থেকে আসার পর সিলেটে শেষবারের মতো তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল বইয়ের দোকান বাতিঘরে, পরে আমার অফিসে। এ ঘটনার কিছু পরে উদাসীর মুঠোফোন থেকে কোনো এক নারী কান্নারত কণ্ঠে সংবাদ দিয়েছিলেন, উদাসী দেহ রেখেছেন। সে সংবাদ পাওয়ার পর থেকে মকদ্দস আলম উদাসীর প্রসঙ্গ এলেই শুরুতে এ গান স্মৃতিতে প্রথম উঁকি দেয়। এ গান তরঙ্গ হয়ে ঢেউ তোলে বুকে। অগণিত না-বলা বাস্তবতা আর খেদ গানের শরীরে লেপটে আছে।
উদাসী কবরের পাশে দাঁড়িয়ে গাইছিলেন:
‘এক দমের নাই ভরসা, করো তুমি কার আশা,
মিছামিছি দুই দিনের পরবাস।
না করলে সাধন মন, না হলো ভজন।
হইলে না বন্ধেরই দাস॥’
উদাসীর কণ্ঠে পরম বন্ধুর প্রতি আত্মনিবেদন ঝরে পড়ছিল। আর এ জগৎ-সংসার যে ‘দুই দিনের পরবাস’ তা-ও তাঁর কণ্ঠের আর্তিতেই অনুভব করা যায়। কিংবা তিনি যখন বলছিলেন, ‘আমার সংসারের অংশ নিতে আপন বংশ/ ভাই বন্ধু করিয়াছে আশ॥’ তখন বাস্তবতা এসে এক কঠিন সত্য উন্মোচন করে। এ দুটো পঙ্ক্তির কারণে কয়েকটি প্রশ্নও তাৎক্ষণিক সামনে এসে উঁকিঝুঁকি দেয়। তবে কি এ জন্যই উদাসী সব সময়ে বৈষয়িক ব্যাপার থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করেছেন? এ কারণেই কি স্থানীয় প্রশাসন উদাসীকে দুবার জায়গাসহ ঘর তৈরি করে দিতে চাইলেও তিনি তা নিতে অপারগতা প্রকাশ করেছিলেন? তাঁর স্বভাব-বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী এটা অনুমান করে নেওয়া যেতেই পারে সম্ভবত তিনি মনে করেছিলেন, তাঁর মৃত্যুর পর ছেলে, স্বজন কিংবা বংশীয়-আত্মীয়রা সহায়-সম্পত্তির ভাগ বসাতে দ্বন্দ্ব-বিবাদ করতে পারেন। ফলে সংসারে বিষয়সম্পত্তি বাড়াতে তাঁর কোনো আগ্রহই ছিল না!
একই গানে উদাসী যখন বলে যান, ‘আহা রে দুনিয়া, দুদিনের মায়া/ কার লাগি কাটলে রে মন ঘোড়ারই ঘাস।/ হাওয়ার পাখি, দিবে যে দিন ফাঁকি/ কবরে পড়ে রইবে লাশ॥’, তখন মৃত্যুচিন্তা এসে ঠাঁই নেয়। জনমভর জীবন যাপন করতে যে খাটাখাটুনি মৃত্যুর পর যে এর কোনো মূল্যই নেই, তা-ও এসব পঙ্ক্তির পলে পলে অনুভূত হয়।
গানের একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে উদাসীর কণ্ঠে আবেগের ঘনত্ব অনেকটাই বেড়ে গিয়েছিল। তিনি গাইছিলেন, ‘পাড়ি দিতে সাগর, মনেতে বড় ডর,/ অন্ধকারে চেয়ে দেখি কেউ নাই আশপাশ।/ মকদ্দস উদাসী, হাওয়ার পাখিরে ভালোবাসি/ গেলে পাখি ছাড়িব নিশ্বাস॥’
গান শেষে উদাসী বারকয়েক কাশলেন। এরপর তিনি হেঁটে চলেন সামনের পাকা সড়ক ধরে। আমিও তাঁর সঙ্গী হই। তিনি অনবরত কেশেই চলেছেন। সম্ভবত গলায় কাশ আটকে আছে। গলা ঝেড়ে থুতু ফেলে সেই কাশ ফেলার বৃথা চেষ্টাও করলেন দু-একবার। হাঁটতে হাঁটতেই মকদ্দস আলম উদাসীকে আবার গান গাইতে বললাম। তিনি আমাকে অবাক করে দিয়ে আবারও একই গানের পুনরাবৃত্তি করলেন। এবার আর বই দেখে নয়। এবার স্মৃতি আওড়েই গাইতে শুরু করলেন তিনি, ‘এক দমের নাই ভরসা, করো তুমি কার আশা.
গান শোনা হলে সিলেট থেকে নিয়ে আসা সিএনজি অটোরিকশাতে উঠে পড়ি। ততক্ষণে মাগরিবের নামাজ শেষ হয়েছে। সূর্যও হেলে পড়েছে। গ্রামের রাস্তা ধরে কয়েকজন মুসল্লি তসবিহ হাতে ধীরলয়ে হাঁটছেন। আগের রাতে ঘুম না হওয়ায় আমার চোখে ঝিমানি ভাব। আধো ঘুম, আধো ঝিমানি আসা চোখে ভাসছে সেই মেহমানখানা কাম বেডরুম, যেখানে বসা ধ্যানমগ্ন এক ঋষি বলে চলেছেন জীবন-জগৎ-সৃষ্টি-ধ্বংসের মর্মভেদ।
উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
কাশ্মীরে হামলা নিয়ে মন্তব্য করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আক্রমণের শিকার সিপিআইএমের মহম্মদ সেলিম
কাশ্মীরের পেহেলগামে পর্যটকদের ওপর বন্দুকধারীদের হামলায় ২৬ জনের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ভারতজুড়ে প্রায় সব রাজনৈতিক দলের নেতারা আরও জাতীয়তাবাদী ও শক্তিশালী নিরাপত্তাব্যবস্থার দাবি তুলেছেন। এর মধ্যে খানিকটা স্রোতের বিপরীতে হাঁটলেন পশ্চিমবঙ্গ সিপিআইএমের (কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া-মার্ক্সবাদী) সাধারণ সম্পাদক মহম্মদ সেলিম। তিনি সাধারণ মানুষকে সাবধান করেছেন, যাতে এই ঘটনাকে কাজে লাগিয়ে কোনো পক্ষ সাম্প্রদায়িক উসকানি ও বিভাজন বাড়াতে না পারে। কাশ্মীরের ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভারতে অনেকটা জাতীয়তাবাদের সুনামি তৈরির মধ্যে তাঁর এই মন্তব্যকে ভালোভাবে দেখেননি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীরা। মহম্মদ সেলিমের তীব্র সমালোচনা শুরু হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, বিশেষত ফেসবুকে।
বুধবার দুপুরে সিপিআইএমের প্রচার বিভাগ ফেসবুকে রাজ্য সম্পাদকের একটি ছবি দিয়ে তাঁর একটি মন্তব্য প্রকাশ করে। সেখানে মহম্মদ সেলিম বলছেন, ‘কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বাতিল করে বিজেপি সরকার যে পদক্ষেপ নিয়েছিল, তাতে সন্ত্রাসবাদকে আরও উসকে দেওয়া হয়েছে। এখন পর্যটকদের ওপর এই হামলা ঘিরে সারা দেশে সাম্প্রদায়িক উসকানি ছড়ানো ও বিভাজনের চেষ্টা হবে। অমরনাথ যাত্রার প্রাক্কালে হামলা বলে দেখিয়ে নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের ওপরে হামলা বলে প্রচার করা হবে। আমরা কাশ্মীরের ঘটনার তীব্র নিন্দা করছি এবং কোনোরকম সাম্প্রদায়িক উসকানিতে সাড়া না দেওয়ার আবেদন করছি।’
সিপিআইএমের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্ষদ পলিটব্যুরোও একটি বিবৃতি প্রকাশ করেছে, কিন্তু এখানেও তারা এই ধরনের ‘সাহসী’ মন্তব্য করেনি বলে মনে করছেন সিপিআইএম দলের সদস্যদের একাংশ। বিবৃতিতে ভুক্তভোগীদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করে পলিটব্যুরো বলেছে, ‘এই জঘন্য অপরাধের সাথে জড়িতদের গ্রেপ্তার করে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনী কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে। এই নৃশংস হামলার জন্য দায়ীদের বিচারের আওতায় আনতে কেন্দ্রীয় সরকারকে সর্বতোভাবে চেষ্টা করতে হবে। অপরাধকারীরা জাতির ও কাশ্মীরের জনগণের শত্রু। জনাকীর্ণ পর্যটন স্থানগুলোতে নিরাপত্তার অভাবসহ হামলার সমস্ত বিষয় নিয়ে তদন্ত চালানো কেন্দ্রীয় সরকারের দায়িত্ব। চরমপন্থী মৌলবাদী শক্তির বিরুদ্ধে এই ট্র্যাজেডির মুহূর্তে সিপিআই-মার্ক্সবাদী ভারতের জনগণের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ।’
অর্থাৎ যে কথা মহম্মদ সেলিম বলেছেন, এই ঘটনার জেরে ভারতে আগামী দিনে সাম্প্রদায়িকতা ও বিভাজনের রাজনীতি বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে, সেই ধরনের কোনো মন্তব্য করেনি দলের শীর্ষ পর্ষদ।
মহম্মদ সেলিমের মন্তব্যের জন্য তাঁকে প্রবল আক্রমণ করেছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীরা। একজন লিখেছেন, ‘সিপিআইএমের আজ এই অবস্থা আপনাদের এই মতামতের জন্যই।’ সিপিআইএমের প্রচার বিভাগের ওই ফেসবকু পোস্টে রাত পর্যন্ত প্রায় দুই হাজার মন্তব্য করা হয়েছে এবং এর প্রায় প্রতিটিই মহম্মদ সেলিমকে আক্রমণ করে। আরেক ব্যক্তি লিখেছেন, ‘সেলিম বিষয়টিকে নিয়ে রাজনীতি করছেন, যা কাম্য নয়।’ ফেসবুকে সিপিআইএমের রাজ্য সম্পাদককে ব্যক্তিগত আক্রমণও করেছেন অনেকে।
তবে সিপিআইএম দলের সদস্যদের একাংশ মনে করছেন, এই মন্তব্যের প্রয়োজন ছিল। দক্ষিণ কলকাতার কসবায় সিপিআইএমের স্থানীয় কমিটির সাবেক সদস্য ও বর্তমানে পার্টির সাধারণ সদস্য কৌশিক রায় এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা বলে আমি যেটা মনে করি সেটা হলো “পপুলিস্ট” চিন্তাভাবনার বিরুদ্ধে গিয়ে পাল্টা ন্যারেটিভ (আখ্যান) আমরা দিতে পারছি না। মানুষ বাম রাজনীতি থেকে সব সময় অন্য কিছু শুনতে চান। অন্য একটা ন্যারেটিভ চান। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমরা মূলস্রোতের ন্যারেটিভই অনুমোদন করি এবং সেটাই বলি। এই যে রাজ্য সম্পাদক কথাটা বললেন যে, এই ঘটনাকে ব্যবহার করে কিছু সংগঠন সম্প্রদায়িক রাজনীতি করার চেষ্টা করবে, এটা একটা বিকল্প ন্যারেটিভ। কাশ্মীরের ঘটনার ফলে সাম্প্রদায়িক বিভাজন এবং মেরুকরণের রাজনীতি বাড়তে পারে, এটা একটা বাস্তব সত্য এবং বিকল্প ন্যারেটিভও, যেটা এই মুহূর্তে অন্য রাজনৈতিক দল বলছে না। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের অনেক মানুষই সেটা মনে করেন। মূলস্রোতের বিরুদ্ধে গিয়ে আমাদের কথা বলাটা এই সময় খুব জরুরি।’
রাজ্য সম্পাদকের সঙ্গে সহমত প্রকাশ করে আগামী শুক্রবার (এপ্রিল ২৫) কাশ্মীরের সহিংসতা এবং সম্ভাব্য সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরোধিতায় পথে নামবে পশ্চিমবঙ্গ সিপিআইএম।